আপনি কি রাজাকার ছিলেনঃ মানুষ ভাল-তবে প্রশ্নে ছিল ঝাল

রিপোর্টারের ডায়রী-৬

0

জুবায়ের সিদ্দিকীঃ বক্তার বক্তব্যই খবর। প্রতিদিনের কাগজে প্রতিবেদন ও বিশেষ প্রতিনিধিরা বিভিন্ন ধরণের সান্নিধ্যে আসেন। তা যেমন বক্তব্য জানার জন্য আবার তেমনি সাংবাদিক সম্মেলন, আলোচনা সভা বা বিবৃতি দেবার সময়েও হতে পারে। বিভিন্ন ধরনের বক্তব্য থেকে যেমন খবর করতে হয় তেমনি আবার প্রশ্ন করে খুঁটিয়ে বের করে নিতে হয় যে কোন জিজ্ঞাসার উত্তর।

কিন্তু নেওয়াটাও অত সহজ ব্যাপার নয়। সাক্ষাৎকার নেবারও কিছু ধরণ ধারণ আছে।  সাক্ষাৎকার যিনি নেন, অর্থাৎ প্রশ্নকর্তা, তাকে এগুলি মেনে চলতে হয়। আমার বাস্তব অভিজ্ঞতায় মনে করি নিম্নে বর্ণিত বিষয় মাথায় রাখা প্রয়োজন। যেমন (১) বিষয়ের সাথে ভালো করে পরিচিত হওয়া দরকার। প্রয়োজনে গবেষণা করতে হবে। সাক্ষাৎকার দাতার কাছ থেকে কি ধরণের তথ্য উপাত্ত পাওয়া যাবে তার সম্পর্কে ধারণাও থাকতে হবে।

(২) শুরু করা দরকার খোলাখুলিভাবে, শান্তভাবে। (৩) গল্প করে অন্তরঙ্গ হয়ে উঠে আলাপ জমিয়ে সহজভাবে তথ্য উপাত্ত্ গ্রহণ গ্রহনযোগ্য। সময় শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা উচিত শক্ত ও প্যাঁচে ফেলা প্রশ্নগুলির ক্ষেত্রে। কারণ এগুলি বক্তাকে চটিয়ে দিতে পারে। চটে যাওয়ার আগে অন্য বিষয়গুলি জেনে নেওয়া দরকার। (৪) শ্রোতা হিসেবে আদর্শ হওয়া দরকার। নিজের অস্তিত্বও ভূলে যেতে হবে প্রয়োজনে। মনে রাখা দরাকার, বক্তার বক্তব্য বলার সুযোগ দিলেই লাভ হবে বেশী।

সংশ্লিষ্ট বিষয়ের উপর প্রতিবেদকের কতখানি দক্ষতা আছে তা দেখানোর জন্য বেশী কথা বলে চালাকি না করাই ভালো। ’৯০ দশকের প্রথম দিকে আজকের সূর্যোদয়ের জন্য একটি সাক্ষাৎকার নিতে গেলাম একজন ব্যবসায়ী ও নব্য আওয়ামী লীগার থেকে। মিনি টেপ রেকর্ডার অন করতেই বললেন, “আরে রাখেন রাখেন, আমি আগে মহড়া দিয়ে নিই। তারপরে রেকর্ড করবেন। এখন প্রশ্ন করেন, জবাব দেব। সেই লোক এখন সরকারের মন্ত্রি”।

সারাজীবন সাংবাদিকতায় রাজনৈতিক বিটে কাজ করেছি। আমার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করতে হয়েছে রাজনীতিবিদ, এমপি ও মন্ত্রিদের। সাক্ষাৎকার গ্রহন করতে গিয়ে দীর্ঘ ৩০ বছর আমার নানা অভিজ্ঞাতা যেমন হয়েছে তেমনি বিচিত্র মানুষেরও দেখা পেয়েছি।

একজন দায়িত্বশীল রাজনৈতিক নেতার সাক্ষাৎকার গ্রহন করি তার বাসভবনে। সাক্ষাৎকারের শেষ প্রশ্ন ছিল আপনি কি রাজাকার ছিলেন? তিনি রাগ সামলে বললেন, না না রাজাকার হতে যাবো কেন। আমি মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের লোক। পরের দিন ভ্রদ্রলোক ঢাকায় সম্পাদককে ফোন করে বললেন, আপনার সহকর্মী আমার একটা পলিটিক্যাল সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তবে শেষ প্রশ্নটা ছিল মারাত্মক। মানুষটা ভাল, প্রশ্নে ছিল ঝাল। হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন করল বুঝতে পারছিনা। সম্পাদক বললেন, আপনার দল রাজাকারের সাথে সরকার গঠন করায় এই প্রশ্ন সে করেছে বলে মনে হয়। যাক বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদকের সাথে কথা বলব। আপনি মনে কিছু নেবেন না।

চট্টগ্রামের এক প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাকে সাক্ষাৎকার গ্রহণের জন্য ফোন করলাম একদিন সন্ধ্যার পর। তিনি বললেন, তোমাকে ভোর ৬টায় আসতে হবে আমার বাসায়। সেইভাবেই গেলাম।

৯০ দশকের শেষ সময়ে একদিন মহিউদ্দিন চৌধুরীর সাক্ষাৎকার নিতে গেলাম তার বাসায়। মেয়র মহোদয় তখন বাসা থেকে বাচ্চাদের নিয়ে বের হচ্ছিলেন বেড়াতে। আমাকে দেখে বললেন, কেন এসেছেন। বললাম সাক্ষাৎকার নিতে এসেছি। বাচ্চাদের পাশে রেখেই দীর্ঘ সময় সাক্ষাৎকার প্রদান করলেন ধৈর্য্যসহকারে। সদালাপী ও প্রাণখোলা সাক্ষাৎকার পত্রিকায় ছাপা হলে সার্কুলেশন বেড়ে যায়।
১/১১ তে তিনি গ্রেফতার হয়ে বান্দরবানে চলে যান। এরপর মুক্ত হয়ে ফিরে আসেন।

তার আদরের কন্যা টুম্পার মুত্যু সংবাদ পেয়ে বাসায় ছুঁটে গেলাম। আমাকে দেখে বললেন, আজ কি আমাকে সাক্ষাৎকার দিতে হবে। আমি বললাম, না। আমি আপনার বেদনার ও শোকের অংশীদার হতে এসেছি। মহিউদ্দিন চৌধুরী বললেন, আলহামদুলিল্লাহ। একজন সাংবাদিকের এটাই বৈশিষ্ট্য।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.