“তাহলে কত দূর এগুলো ছাত্রসমাজ”- জাফর ওয়াজেদ

0

জাফর ওয়াজেদ, সম্পাদকীয় : আমাদের বিশ্বাসে টান পড়ে, বোধবুদ্ধিতে বিস্ময় জাগে, যখন শুনি এবং দেখতে পাই, বুকে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি ঝুলিয়ে, কণ্ঠে জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগান দিয়ে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীরা ক্যাম্পাস এলাকায় মিছিল করছে। ধন্দ জাগে এবং বাড়ে যখন দেখি তাদের মিছিলে বাম নামধারী ছাত্রদের সম্মিলন ঘটে। আর হতবাক ও হতোদ্যম হই, যখন দেখতে পাই, প্রায় ষাটোর্ধ একটি ছাত্রসংগঠন; যার রয়েছে গৌরবদীপ্ত ঐতিহাসিক অবদান, সেই সংগঠনের নেতাকর্মীরা দেশ ও জাতির শত্রু বলে বিবেচিত ও চিহ্নিতদের ফাঁদে পা দিয়ে আত্মহননে মত্ত হয়েছে। আমাদের ভাবনায় আসে না, বঙ্গবন্ধুর নিজ হাতে গড়া সংগঠনটির এমন পরিণতি ঘটবে। দুর্বলতার পরিধি এমন স্থানে এসে দাঁড়িয়েছে যে, সংগঠনটি ভ্রান্তির বেড়াজালে আবদ্ধ হয়েছে, তা থেকে তুলে আনা সহজসাধ্য নয়। নীতি, আদর্শ, সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক চর্চার ক্ষেত্র তৈরি করে, তার মাধ্যমে হৃতরাজ্য তথা হৃত সুনাম পুনরুদ্ধারে সচেষ্ট হলেই যে আবার গৌরবদীপ্ত হতে পারবে কি না সন্দেহ থেকে যায়। দুর্ভাগ্য বলি আর দুঃখজনকই বলি, বাস্তবে যা ঘটছে, ঘটতে পারে, ঘটে এসেছে- সবকিছু বিবেচনা নিয়েই সংগঠনের সংস্কার করা না গেলে বিপর্যয় আরও বাড়বে বৈকি। পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনা ছাড়া কেবল কতিপয়দের দিয়ে একটি কমিটি দাঁড় করালেই সংগঠন সচল হবে না। যে ধস গত দশ বছরে বেড়েছে, তা পুনঃনির্মাণ করার পরিকল্পনা যদি না হয় বাস্তবসম্মত ও যুগোপযোগী, তা হলে ফলাফল ভিন্নতর হবে না। দায়িত্বে যারা, তাদের কর্তব্য হওয়া সঙ্গত বিপর্যয় আর বাড়তে না দেয়া এবং তা এড়াতে করণীয় নির্ধারণ করে তা কার্যকর করার মধ্যে সঠিক পন্থা পাওয়া যেতে পারে। কেবল মধুর ক্যান্টিন নিয়ন্ত্রণ থাকলেই যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মনোজগৎ নিয়ন্ত্রণে থাকে না, এটা তো প্রমাণিত এখন। সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংযোগ না থাকলে মধুর ক্যান্টিন কেন, অন্য কোথাও বসে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করা যায় না। সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ নামক হঠাৎ গজিয়ে ওঠা সংগঠনটি মূলত ইসলামী ছাত্রশিবির পরিচালিত। এদের সমর্থনে রয়েছে বামপন্থী নামধারী ছাত্র ফেডারেশন, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রফ্রন্ট ইত্যাকার সংগঠন। স্খলন হলে বামপন্থীদের অবস্থা কি দাঁড়ায়, অতীতের মতো এবারও তা স্পষ্ট হয়েছে। বঙ্গবন্ধু বলতেন, ঘড়ির পেন্ডুলাম একবার বাঁ দিকে, একবার ডানদিকে যায়। সুতরাং বামদের কট্টর ডান হয়ে ওঠার অজস্র উদাহরণ বিশ্বজুড়েই মিলবে। পশ্চিমবঙ্গেতো বামফ্রন্টের অনেক নেতাকর্মী এখন বিজেপির নেতাকর্মীতে রূপান্তরিত হয়েছে।

কথিত কোটা সংস্কারকে কেন্দ্র করে যে নৈরাজ্য ও নৈরাশ্য দেশবাসী প্রত্যক্ষ করেছে, তার পেছনে অন্য ইন্ধন যে ছিল, তা তদন্ত না করেই অনায়াসে বলা যায়। জামায়াত-শিবির ও ইসলামী ছাত্রী সংস্থার তৎপরতা সবসময়ই ছিল, কৌশলে তারা বিভিন্ন জনদাবির সঙ্গে মিশে যেতে পারে। সন্ত্রাস ও নাশকতা চালাতে পারে। নব্বই-এর গণআন্দোলনের সময় এরা ১৫, ৭ ও ৫ দলীয় তিন জোটের সমান্তরালে আন্দোলনের মাঠে নেমেছিল। তখন তারা পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে রাজাকার পুনর্বাসনকারী সংগঠন বিএনপির। ২০১৩, ১৪ ও ১৫ সালে পেট্রোলবোমা মেরে জীবন্ত মানুষ হত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, বৃক্ষ নিধনসহ নির্মমতা ও নৃশংসতার নজির রেখেছে জামায়াত-শিবির। কোটা সংস্কারের কথিত এই আন্দোলন জামায়াতী-বিএনপির এজেন্ডা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পরিচালিত। এই কথিত আন্দোলন বহুমাত্রিক ষড়যন্ত্রের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। স্বাভাবিক আন্দোলন হিসেবে তাই পরিচালিত হতে পারেনি। দাবি যৌক্তিক বা অযৌক্তিক হতে পারে। কিন্তু সহিংসতা যে যৌক্তিক নয়, আন্দোলনকারীরা তা জানা সত্ত্বেও নাশকতার পথ বেছে নিয়েছিল। যা শিবির ও ইসলামী ছাত্রী সংস্থার মূল লক্ষ্য। এই কাজে তারা প্রশিক্ষিত এবং পারদর্শীও বটে। ওরা জানে, একটি মিথ্যা অপপ্রচার অনেক সহজেই জনগণের কোন কোন অংশকে উত্তেজিত করে ভয়ঙ্কর কা- তথা লুটপাট, ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ ঘটিয়ে দেশে দাঙ্গা-হাঙ্গামা লাগাতে পারে। এর অসংখ্য দৃষ্টান্ত এ দেশবাসী প্রত্যক্ষ করেছে অতীতে এবং নিকটকালেও। প্রত্যেক সমাজের এবং সংগঠনের একটি নিজস্ব বৈশিষ্ট্য থাকে। বিশ্বায়নের ফলে মানব সমাজেও সংগঠনের বহুল উন্নতি হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি আরও সহজ করে দিয়েছে। মানবজীবন হয়েছে অনেক সহজ। কিন্তু সমাজে ও সংগঠনে কী পরিমাণ ঘুণ ধরেছে, তা চারপাশে তাকালেই স্পষ্ট হয়। কথিত কোটা সংস্কারের নামে বিএনপি-জামায়াতের ক্যাডার সংগঠন শিবির ও বাম মার্গীয় সশস্ত্ররা যে তান্ডব চালিয়েছে, তা আন্দোলন নয়, নাশকতা এবং অমার্জনীয় অপরাধ। কিন্তু ছাত্রলীগের ‘দুর্গ’ বলে দাবিদার ক্যাম্পাসের ছাত্রলীগাররা বুঝতে পারেননি যে তাদের দুর্গ নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে। দুর্গ রক্ষা করা আর সহজসাধ্য যে নয়, তারা এখনও বুঝতে পেরেছে বলে মনে হয় না। তাদের মস্তিষ্ককোষে এটা প্রকটিত হয়নি যে, আন্দোলনের নামে কথিত আন্দোলনকারীরা ভিন্ন উদ্দেশ্য সাধনের জন্য অর্থাৎ অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করে চরম অরাজকতা সৃষ্টি করার জন্যই রাতের বেলায় ক্যাম্পাস দখল করে, তাদের অসুদদ্দেশ্য সাধন করতে পারে। ইসলামী ছাত্রী সংস্থা যে গত কয়েকবছর ধরে মেয়েদের হলে এক ধরনের তৎপরতা চালিয়ে মেয়েদের সংগঠিত করে শক্তিমত্তা অর্জন করেছে, তা বোঝার ক্ষমতা বর্তমান ছাত্রলীগ নেতাদের মধ্যে অনুপস্থিত। দেখা গেছে, ছাত্রলীগেরই কেন্দ্রীয় ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখার অনেক নেতা ফেসবুকে ছাত্রলীগ থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়ে শিবির পরিচালিত কথিত আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করছে। এমনকি সরকারবিরোধী স্ট্যাটাসও দিয়েছে। তবে এদের সংগঠন থেকে কারণ দর্শানো হয়নি অদ্যাবধি। কেন হয়নি, তা অস্পষ্ট। পুরো ঘটনার বিষয়ে সংগঠনের কোন পর্যালোচনাও পাওয়া যায়নি। দলীয় গ্রুপিংয়ের মাত্রা কী পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে, কবি সুফিয়া কামাল ছাত্রী হলের ঘটনাসমূহ তার প্রমাণ বহন করে। এই বিষয়গুলোর ‘বেনিফিসিয়ারি’ হয়েছে বলা যায়, আন্দোলনরত শিবির ও বাম মার্গীয়রা। তাদের সকল অপকর্ম তথা আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে নিয়ে যাওয়া, মঙ্গল শোভাযাত্রার উপকরণ ভাংচুর, উপাচার্যের বাসভবনে তা-ব ও উপাচার্যকে হত্যার চেষ্টা, সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনা এই ফাঁকে চাপা পড়ে গেছে। ছাত্রলীগাররা বুঝতে অক্ষম ছিল যে, এই কথিত আন্দোলন মূলত মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধা বিরোধিতার নামান্তর। শিবিরের সাফল্য যে, তারা এই বিষয়ে সাধারণ ছাত্রদের বিভ্রান্ত করে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি বিষোদগারের মাত্রা বাড়িয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের উত্তরসূরিদের কোটা কত শতাংশ রাখা উচিত সে নিয়ে আলোচনা হতে পারে। কিন্তু সে পথে না গিয়ে বাঙালীর বীর যোদ্ধা, যারা দেশ স্বাধীন করেছে বলে এই প্রজন্ম উচ্চশিক্ষা লাভের সুযোগসহ চাকরি পাচ্ছে, অথচ তাদের বিরুদ্ধাচরণ করছে। পাকিস্তান যুগে বাঙালীর উচ্চ শিক্ষাগ্রহণ ও চাকরি পাবার পথ ছিল দুর্গম। স্বাধীনতার পর বাঙালী সেই অবস্থা থেকে অনেক দূর এগিয়েছে। আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ এই মুক্তিযুদ্ধে ছিল সর্বাগ্রে। বাস্তবতা এই যে, পঁচাত্তর পরবর্তী সামরিক জান্তা ও তাদের উত্তরসূরিরা প্রশাসনে চাকরির ক্ষেত্রে জামায়াত শিবিরকেই প্রাধান্য দিয়েছে। তাই প্রশাসনে এখনও স্বাধীনতাবিরোধী চেতনাধারীরা সংখ্যায় কম নয়, এরা অনেকে ‘জয়বাংলা’ বলে কৌশলগত কারণে। সরকারের কাছে এদের গ্রহণযোগ্যতাও অনেক বেশি। দেখা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিবির ও ছাত্রদলের যেসব কর্মী ও সমর্থক প্রকাশ্যে সাংগঠনিক কাজ চালাতে পারছে না, তাদের একটি অংশ কোটা নিয়ে রাজপথে নেমেছে শুধু নয়, নেতৃত্বও তাদের হাতে। যে চারজন নেতৃত্ব দিচ্ছে, তারা সবাই শিবির নামক সংগঠনের নেতা। সাধারণ শিক্ষার্থীদের আড়ালে তারা নানা অপকর্ম অতীতেও চালিয়েছে চট্টগ্রাম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেদিনের হামলার মতো জঘন্য, বিকৃত, বীভৎস ঘটনার হোতাদের চরিত্র বিশ্লেষণ সমাজ বিজ্ঞানীদের পক্ষেও কঠিন। তারা বলছেন, এটা এক ধরনের বিশেষায়িত আনন্দ। এক ধরনের বিকারগ্রস্ততা। মনোবিজ্ঞানীদের মতে, মানসিক রোগীরা হয় নিরীহ প্রকৃতির। কিন্তু শিবিরকর্মীরা নিরীহ নয়। তাদের চেহারায় এক ধরনের অমানবিকতার ছাপ থেকে হিংস্রতায় তারা উদ্দীপ্ত হয়। গত নয় বছর ধরে প্রকাশ্য রাজনীতিতে সুবিধা করতে না পেরে আত্মগোপনে থাকা শিবির অন্য সংগঠনে আশ্রয় নিয়েছে অবলীলায়। তাদের ছাত্রী সংস্থা সক্রিয়। মেয়েদের হলে হলে তারা ধীরে ধীরে অবস্থান নিয়েছে।

এমনিতে গত ক’বছর ধরে শুনে আসছি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে ছাত্রশিবির এবং ছাত্রদল অনুপ্রবেশ করেছে। যা ক্রমান্বয়ে জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন পর্যায়ে সংক্রমিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, আদি আকৃত্রিম ছাত্রলীগারদের হটিয়ে তারা পদ ও পাদবি বাগাতে পেরেছে। পদ পেয়ে তারা আরও শিবির ও ছাত্রদল কর্মীদের ছাত্রলীগে অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছে। আবার দেখা গেছে, বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসংগঠনের শাখা না থাকলেও সেখানকার ছাত্রদের মহানগর ও থানা কমিটির নেতৃত্বে রাখা হয়েছে। এমন বিতিকিচ্ছিরি কা-কারখানা রোধে কেউ এগিয়ে আসেনি। প্রচার রয়েছে যে, অর্থের বিনিময়ে এসব পদ ও পদবি বণ্টন করা হয়েছে। এদের অনুপ্রবেশের বিষয়ে সহযোগী সংগঠন আওয়ামী লীগে অবস্থান নেয়া পদ পদবিধারী জামায়াত-বিএনপি নেতারাই ছিল উদ্যোগী। বর্তমান জামায়াত-শিবির নেতৃত্ব সম্পর্কে আওয়ামী লীগের অনেক নেতাই ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করেন। ঘৃণাভাব নেই তাদের। বরং অনেক নেতা তো তাদের সাদরে দলে পুষ্প দিয়ে বরণ করে নিয়ে পদ-পদবি দিয়ে পুষছেন জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন পর্যায়েও। বলেছেনও এমন, এরা নতুন প্রজন্মের জামায়াত-শিবির। এরা যুদ্ধাপরাধী নয় বলে অতি সরলীকরণ ভাষ্যও দিয়েছেন কোন কোন নেতা। তাই দেখা যায়, ২০১৩, ১৪ ও ১৫ সালে নাশকতা চালানোর পর আত্মগোপনে থাকা জামায়াত-শিবির তাদের রণকৌশল পাল্টেছে। তাদের সুচতুর ক্যাডাররা ক্রমান্বয়ে সরকারী দল ও অঙ্গ এবং সহযোগী সংগঠনগুলোতে সুঁই হয়ে ঢুকে পড়েছে। আগামীতে ফাল হয়ে বেরুবে হয়ত। ভোটের রাজনীতিকে সামনে রেখে দলভারি করার জন্য এদের দলে ঠাঁই দিলেও, তারা যে শেষ পর্যন্ত অনুগত থাকবে, বলা যায় না। পদ-পদবি বাগিয়ে নিয়ে আদি অকৃত্রিম আওয়ামী লীগরদের হটিয়ে বা খেদিয়ে নিজেদের অবস্থান পাকাপোক্ত করে দলটিকে জামায়াতী রাজনীতির ধারায় নিয়ে যাবার স্বপ্ন পূরণ করতে চায় তারা। ছাত্রলীগে তাদের অবস্থান বেশ ভাল। ছাত্রলীগের শিবিরপন্থীরা সেদিন রাতে ভেবেছিল তাদের উদ্দেশ্য সাধন হতে যাচ্ছে, সরকারের পতন ঘটবে, তাই তারা ছাত্রলীগ থেকে পদত্যাগ করে নাশকতায় শরীক হয়েছিল। জামায়াতীরা যেমন আওয়ামী লীগের রাজনীতির ধারক ও বাহক হয়ে উঠছে, তেমনি ছাত্রলীগেও শিবির। তাদের হাতে সংগঠনটি যেন ‘অদ্ভুত জন্ম’ লাভ করেছে। হাঁস আর শজারু মিলে সুকুমার রায় হাঁসজারু বানিয়েছিলেন। শিবির-ছাত্রলীগ মিলে ‘খেচর’ দাঁড়াবে হয়ত।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে জামায়াত-বিএনপির অনুপ্রবেশ ঘটেনি। কিন্তু অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলো থেকে নিচ পর্যন্ত তারা ছেয়ে আছে। ক্রমশ পঙ্গপালের মতো ছড়িয়ে পড়বে। আওয়ামী লীগ অবশ্য এমনটাও বলে যে, দলে হাইব্রিড আর কাউয়া বেড়েছে। দেড় বছর আগে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কাউন্সিল অধিবেশনে ঘোষণা হয়েছিল যে, এদের চিহ্নিত করে দল থেকে বের করে দেয়া হবে। এদের কারণে নাকি দল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কিন্তু এ সময়কালে কাউকে চিহ্নিত করা দূরে থাক, একটি হাইব্রিড বা একটি কাউয়াও বহিষ্কৃত হয়নি। বরং অনুপ্রবেশ বেড়েছে আরও নির্বাচনকে সামনে রেখে।

কোটা সংস্কারের কথিত আন্দোলনের মাধ্যমে তরুণদের যেভাবে বিভ্রান্ত করা হয়েছে যা হচ্ছে, তাতে ছাত্রলীগের একাংশের ইন্ধন হয়ত থাকতে পারে। পরিস্থিতি তারা এমনভাবে তৈরি করেছে যে, সাধারণ ছাত্ররাও তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে পড়েছে। তারা যে শিবির, তা আড়াল করার জন্য, জয়বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু পর্যন্ত পাপিষ্ঠ মুখে উচ্চারণ করছে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এখন খৈ ফোটাচ্ছে। অথচ তাদের আন্দোলন শুরু হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা কোটার বিরুদ্ধে। ১৯৯৬ সালে যখন এই কোটার ঘোষণা দেয়া হয়, তখনই শিবির এর বিরোধিতা করলেও হালে পানি পায়নি। নতুন করে আবার ২০১৩ সালে শুরু করলেও সুবিধে করতে পারেনি। এরপর গোপনে গোপনে তৎপরতা চালিয়ে এক সময় প্রকাশ্য হয়। গত ফেব্রুয়ারিতে এই দাবি নিয়ে সমাবেশ করে সাধারণ ছাত্রদের ব্যানারে। সে জন্য গত ফেব্রুয়ারি, মার্চ মাসে সারাদেশের শিবিরের ক্যাডাররা ঢাকায় জড় হতে থাকে। অবরোধ, হরতাল, মানুষ হত্যা করেও আন্দোলন সফল করতে না পারা বিএনপি-জামায়াত এই আন্দোলনকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করে আসছে। এদের অভিন্ন লক্ষ্য হচ্ছে দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি, সরকারকে আত্মরক্ষামূলক অবস্থানে ঠেলে দিয়ে বেগম জিয়ার মুক্তি ত্বরান্বিত করা, জেল থেকে যুদ্ধাপরাধীদেরকে উদ্ধার করা। আর এজন্য রাতের বেলা ক্যাম্পাস জুড়ে নাশকতা চালিয়েছিল। গুলির ব্যবহার করেছে। রড, লাঠি নিয়ে উপাচার্যের বাসভবনে নাশকতা ও তা-ব চালানোর শক্তিমত্তা অর্জনে শিবিরপন্থী ছাত্রলীগারদের পেয়েছে পাশে। কোটার জন্যই যদি আন্দোলন, তাহলে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে এমনকি স্পীকারের কাছেও স্মারকলিপি দিয়ে আলোচনা চালাতে পারত। কিন্তু সে পথে গেলে যে তাদের লক্ষ্য হাসিল হবে না। তাই ওই পথ মাড়ায়নি। সুতরাং রাতকেই বেছে নিয়েছিল। শিবিরের শক্ত ‘চেইন অব কমান্ড’ এমন ছিল যে, দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাধারণ ছাত্রদের রাস্তায় নামাতে বেগ পায়নি। বরং তুরুপের তাসের মতো দেশের অন্যান্য স্থানেও ছাত্রলীগ তাদের সহযোগী হয়েছে। কোটা পদ্ধতির এই কথিত আন্দোলন সম্পর্কে সরকারী দল যেমন অন্ধকারে ছিল, তেমনি ছাত্রলীগেরও সম্যক ধারণ ছিল না। এ বিষয়ে তাদের করণীয় কি? নিশ্চয় তাদের অথর্বতার কারণে শিবির নেতৃত্ব শুধু নয়, ক্যাম্পাসে অবস্থান নিতে পেরেছে। ছাত্র সমাজের সমর্থন যেমন পেয়েছে, তেমনি গণমাধ্যমের আশীর্বাদও তাদের প্রতি। এখানেই শিবিরের সাফল্য। সরকারের মনে রাখা উচিত ছিল, বিশৃঙ্খলা তৈরি হলে তা কিন্তু চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। তাই আগে ভাগেই এই পরিস্থিতি সৃষ্টির পথ বন্ধ করে দেয়াটাই সঙ্গত। এক্ষেত্রে তা হয়নি বোধের ঘাটতির জন্য হয়তবা। প্রশাসনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাও ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে শিবিরের নেতৃত্বাধীন আন্দোলনকে সমর্থন করেছেন। দুঃখজনক যে, এসব ঘটনায় সরকারের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক কোন ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি। একজন ছাত্র নিহতের গুজব ছড়িয়ে যে তা-ব চালানো হয়েছে, সে ব্যাপারে সরকার তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নিতে পারেনি। সরকার তো আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনা আগেই করতে পারত। কিন্তু ‘দেখি না কী হয়’ মার্কা চেতনা ধারণ করলে তো সবই ‘গুবলেট’ হতে বাধ্য। সব ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীকেই সিদ্ধান্তে নিতে হচ্ছে। মন্ত্রী, এমপি, আমলারা তবে কি ¯্রফে শোভাবর্ধন? তাদের থাকা না থাকায় তবে কী এসে যায়?

ক্যাম্পাসে এখন শিবিরের অধিপত্য। কী করে তাদের আধিপত্য বেড়ে গেল, কাদের ছত্রছায়ায় তারা অবস্থান নিতে পারল, নেতৃত্ব তাদের হাতে কীভাবে গেল, সে সব প্রশ্ন আসছেই।

ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সম্পাদক প্রিন্স এনামুল হক গত ২০ এপ্রিল রাত নয়টা ৩৫ মিনিটে ফেসবুকে লিখেছেন, ছাত্রশিবির এখন বিভিন্ন নামে ক্যাম্পাসে সোচ্চার হয়েছে। নানা ধরনের গুজব ছড়িয়ে ছাত্রসমাজের মাঝে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনে ঢুকে বিশৃঙ্খলা করছে, ধ্বংসাত্মক কর্মকা- পরিচালনা করছে। এরা হিং¯্র হয়ে উঠছে। এদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে সরকার উৎখাত করা এবং খালেদার মুক্তি না হলে সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সহিংসতা ছড়িয়ে দেয়া এবং ক্যাম্পাস নিয়ন্ত্রণে রাখা। তার বক্তব্য প্রমাণ করে, ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে পারছে না। তাদের দুর্গ ভেঙ্গে ভেঙ্গে পড়ছে। বাম মার্গীয় ছাত্রদের সে রাতের ভূমিকাও ছিল শিবিরের সহযাত্রী হয়ে অরাজক অবস্থা সৃষ্টি। কোটা প্রথার সংস্কারের নামে শিবিরের কথিত আন্দোলনে ছাত্রলীগের একটি অংশের যোগদান সম্পর্কে ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক সহ-সভাপতি এনায়েত হোসেন রেজা বলেন, ছাত্রলীগের শিবিরপন্থীরা এই গোপন তৎপরতা সম্পর্কে নিশ্চয় জানতেন। ঘটনা চলাকালীন ফেসবুকে তাদের অনেকের স্ট্যাটাস সেই কথাই প্রমাণ করে। সম্ভবত পুরো বিষয়টি সম্পর্কে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতারা অন্ধকারে ছিলেন। সবাই ব্যস্ত ১১ মে’র সম্মেলন আয়োজন নিয়ে। ছাত্রলীগ এই আন্দোলনকে ছাত্রদের স্বাভাবিক আন্দোলন ভেবেছিল। কিন্তু কোটার আড়ালে যে নাশকতার লক্ষ্য তা স্পষ্ট হয়, চারুকলা ও উপাচার্যের বাসভবনে তা-ব চালানোর পর। সংগঠনের অভ্যন্তরে ঘাপটি মেরে থাকা শিবির ও ছাত্রদলকে সম্মেলনের মাধ্যমে উচ্ছেদ করা হবে। আসলে গুজব এমনভাবে ছড়ানো হয়েছিল যে ছাত্রলীগের অনেকে তাতে বিভ্রান্ত হয়েছে। তবে সে রাতে মেয়েরা হল থেকে বেরিয়ে এসে ছিল স্রেফ গুজবের কারণেই নয়, ইসলামী ছাত্রী সংস্থার উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচীর অংশ হিসেবেও। এনায়েত হোসেনের ভাষ্য সম্ভবত বাস্তবতার কাছাকাছি। কিন্তু সংগঠন যে দুর্বল হয়ে পড়েছে, সে কথা তিনি মানতে রাজি নন। ইতিহাস বলে, শক্তিশালী সংগঠন ছিল বলেই বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ে তুলতে পেরেছিলেন। শিবিরের প্রচার-প্রচারণা যেহেতু গোয়েবলসীয় কায়দার, তাই তাদের প্রচারণায় সাধারণ ছাত্র শুধু নয়, ছাত্রলীগাররাও প্রভাবিত হয়েছে। বিভীষিকাময় সে রাতের পূর্বাপর ঘটনাগুলো একসূত্রে গ্রথিত করলে শিবিরের এক ধরনের জয় এবং ছাত্রলীগের এক ধরনের পরাজয় হয়েছে বলা যায়। নেতৃত্ব দুর্বল হলে সংগঠনকে গতিশীল রাখা দুরূহ। এই কথিত আন্দোলনের পেছনে বিশাল অঙ্কের অর্থ কাজ করছে। সেই অর্থের একটা অংশ যে ছাত্রলীগের কতিপয় ভ্রান্তিবিলাসীকে নষ্ট পথে নিয়ে গিয়েছে, তা অনুমান করা যায়। সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তুলছে। তার সুবিধাভোগী শিবির ও জঙ্গী সন্ত্রাসীরা। কিন্তু ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ এক্ষেত্রে পেছনে পড়ে আছে। প্রযুক্তির ব্যবহার শিবির শিখে নিচ্ছে, দক্ষ হচ্ছে, তবে মননে আধুনিক না হয়েই। এতে তাদের মানসিক বৈকল্যও জন্ম দিচ্ছে। এই অবস্থা যেন ছাত্রলীগের না হয়। ঐতিহ্যবাহী সংগঠনটি আজকের করুণ দশা থেকে উঠে আসবে। তবে তা আলৌকিকভাবে নয়, হতে হবে লৌকিকভাবে। আদি অকৃত্রিম দক্ষ, যোগ্য, মেধাবীদেরই নেতৃত্বে আনা উচিত। বয়সের সীমা নির্ধারণ করে দুর্বল নেতৃত্বকে সমাসীন করা কতটা সঙ্গত, তা ভাবা উচিত। কোটা নামক কথিত আন্দোলনকারীরা সাত মে’র পর কোনদিকে ধাবিত হয়, তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। সরকার এ সময়ে মধ্যে বিষয়টির নিষ্পত্তি করতে আগ্রহী।
লেখক : কবি, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক, মহাপরিচালক, প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.