রূপগঞ্জ হাসেম ফুডের অগ্নিকাণ্ড ‘কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড’

নাগরিক তদন্ত কমিটি

0

সিটি নিউজ,ঢাকা : নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার কর্ণগোপ এলাকার হাসেম ফুডস লিমিটেডের কারখানায় অগ্নিকাণ্ড ও হতাহতের ঘটনাকে ‘কাঠামোগত হত্যা’ উল্লেখ করে সরকারি দায়িত্বপ্রাপ্ত দপ্তরগুলোকে দায়ী করছেন এবং ঘটনার পর তদন্ত করে ১০টি সুনির্দিষ্ট সুপারিশ দিয়েছে নাগরিক তদন্ত কমিটি।

মঙ্গলবার (৩১ আগস্ট) সকালে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে আয়োজিত ‘হাসেম ফুড কারখানায় অগ্নিকাণ্ড ও নিহতের ঘটনা: তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন কমিটির নেতৃবৃন্দ।

তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, বিগত ৮ জুলাই নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাসেম ফুডস লিমিটেডের একটি কারখানায় এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে। বছরের পর বছর কাঠামোগত অবহেলা ও গাফিলতির কারণে বিভিন্ন কারখানায় বারবার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। বাংলাদেশের নাগরিকদের অধিকার আছে তাদের জীবন-জীবিকা ও সম্পদের ওপর হুমকি কারা তৈরি করছে এবং এর সমাধানের পথ কী সে বিষয়ে বিশদভাবে জানা।

প্রতিবেদনে বলা হয়, হাসেম ফুডস লিমিটেডের কারখানার অগ্নিকাণ্ডে সরকারিভাবে ৫২ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করা হলেও নাগরিক তদন্ত কমিটি বিভিন্ন মাধ্যম থেকে প্রাপ্ত তালিকা যাচাই-বাছাই ও মাঠপর্যায়ে তদন্ত করে নিহতের সংখ্যা ৫৪ জন এবং আহতের সংখ্যা ৩৩ জন সম্পর্কে নিশ্চিত করে। এছাড়া এই অগ্নিকাণ্ডে হতাহতের সংখ্যা আরও বেশি বলে আমরা আশঙ্কা করছি।

নাগরিক তদন্ত কমিটির সদস্য অধ্যাপক আনুু মুহাম্মদ বলেন, আমরা দেখেছি কোনো তদন্ত কমিটি দুর্ঘটনার পর তাদের তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে না। এটা মূলত দায়ী ব্যক্তিদের মুক্তি দেওয়ার একটা প্রক্রিয়া। এর ফলে আর কোনো অপরাধীকেই শাস্তির আওতায় আনা যাচ্ছে না।

তিনি আরও বলেন, আমরা যে মজার মজার খাবার খাচ্ছি এর পেছনে রয়েছে এক নারকীয় গল্প, যেটা আমরা জানি না। এই নারকীয় গল্পের একটি প্লট হলো হাসেম ফুড কারখানার আগুন। আমরা দেখেছি সেখানে কত শিশু-কিশোরে প্রাণ হারিয়েছে। কিন্তু দোষীরা জামিনে বেরিয়ে এসেছে। হত্যা মামলার আসামিদের এমন জামিন আমাদের বিচারহীনতাকেই ইঙ্গিত করে।

সংঘটিত অগ্নিকাণ্ডে কারখানা ভবনের অনুমোদন, কাঠামোগত ত্রুটি-বিচ্যুতি, কারখানার কর্মপরিবেশ; শ্রম আইনসহ অপরাপর আইনসমূহ এবং এ সংক্রান্ত বিধিমালাসমূহ প্রতিপালন করা হয়েছিল কি না এসব বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।

এতে বলা হয়, প্রথম কারণটি উপকরণগত। ভবনটিতে ফায়ার অ্যালার্ম ছিল না। এর ফলে আগুন লাগার অব্যবহিত পরই তা কেউ টের পায়নি। কর্মীরা মূলত দেখে ও পরস্পরের কাছ থেকে শুনে জানতে পারেন।

দ্বিতীয় কারণটি অবকাঠামোগত। ভবনটিতে আগুনরোধী সিঁড়ি ছিল না। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের কাছ থেকে ফায়ার সেফটি সনদ পেতে হাসেম ফুডস যে লেআউট প্রদান করে তাতে দেখা যায় ভবনের দুটি সিঁড়িই পরিকল্পনা অনুযায়ী আগুনরোধী উপকরণ দিয়ে মূল অংশ থেকে আলাদা করা। পরিকল্পনা অনুযায়ী সিঁড়ি তৈরি হলে সেখানে ধোঁয়া ঢুকতে পারত না। কার্যত সিঁড়ি দুটি দিয়েই ধোঁয়া উঠে গেছে এবং তাদের মৃত্যুর কারণ হয়েছে।

রুপগঞ্জ ঘটনায় তদন্ত কমিটির ১০টি সুপারিশ :

১. ব্যাংক ঋণসহ বিভিন্ন বিবেচনায় দেখা যায় যে, আলোচ্য কারখানাটি রপ্তানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠান হিসেবে আর্থিকভাবে যথেষ্ট শক্তিশালী। এই শিল্প গ্রুপের অধীনে আরও ১০টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কাজেই কোনো যুক্তিতেই কারখানায় ন্যূনতম নিরাপত্তা না থাকা, নিম্ন মজুরি, অনিরাপদ কর্মপরিবেশ তাদের অক্ষমতার ফলাফল নয়, বরং অনিচ্ছা, অবহেলা, জীবন ঝুঁকির মধ্যে ফেলে মুনাফা বৃদ্ধির তাড়না থেকে এই ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছে। সেজন্য এটিকে আমরা দুর্ঘটনা না বলে কাঠামোগত হত্যা বলে চিহ্নিত করছি এবং সেভাবেই দায়ীদের শাস্তি নিশ্চিত করা আবশ্যক বলে মনে করছি। কর্মস্থলে নিরাপত্তা নিশ্চিত না করা এবং শ্রমিকদের ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করতে বাধ্য করার কারণে যে দুর্ঘটনা ঘটছে তা কার্যত হত্যাকাণ্ড।

২. কারখানা ভবনের নকশা অনুমোদন, অগ্নিনির্বাপণ ও শ্রম আইনের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহ তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করেনি বলে দায়িত্ব অবহেলাকারী কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করে তাদেরও বিচারের আওতায় আনতে হবে।

৩. বিদ্যমান আইনের বহু রকম দুর্বলতা ও ঘাটতির অন্যতম দৃষ্টান্ত ক্ষতিপূরণ বিষয়ক আইন। আমরা মনে করি, কর্মস্থলে একজন শ্রমিক যদি নিহত হন তাহলে ক্ষতিপূরণ এমন হতে হবে যা তার বেঁচে থাকলে সারাজীবনের সম্ভাব্য আয়ের বেশি হয় এবং আহতদের পূর্ণসুস্থতা পর্যন্ত সমস্ত চিকিৎসা ব্যয়।

৪. কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর, শ্রম অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিসসহ সংশ্লিষ্ট সকল প্রতিষ্ঠানে সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে লোকবল বাড়াতে হবে। পরিদর্শকের সংখ্যা ও দক্ষতা বাড়ানো এবং যেখানে আইনের ব্যত্যয় ঘটছে, সেখানে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া।

৫. সকল শিল্প প্রতিষ্ঠানে কর্মপরিবেশ ও শ্রমিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অগ্নি নির্বাপণের সকল শ্রমিক ও কর্মকর্তাদের এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ বাধ্যতামূলক করতে হবে।

৬. কর্মস্থল ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়লে বা সেখানে আইনানুগ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা না হলে, শ্রমিকেরা যেন পরিদর্শন অধিদপ্তরকে যেকোনো সময় অবহিত করতে পারে এবং পরিদর্শন অধিদপ্তর যেন খবর পাওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কর্মস্থলে হাজির হয়ে ব্যবস্থা নিতে পারে, সেজন্য আইনি বিধান রাখা জরুরি।

৭. শ্রমিকদের ইউনিয়ন করার অধিকার নিশ্চিত করা এবং অবাধে ইউনিয়ন করার সুযোগ নিশ্চিতে সংগঠকদের প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা (পেশাগত, আইনি ও সামাজিক) প্রদান করতে হবে।

৮. কর্মস্থলে চিকিৎসা ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করতে হবে। কারখানা কর্তৃপক্ষ বা নিয়োজককে নিজ খরচে ও দায়িত্বে চিকিৎসা করতে হবে।

৯. শিশুশ্রম নিরসনে প্রধানত দরকার শিশুদের অভিভাবকদের আয় বৃদ্ধি করা। সেজন্য জাতীয় ন্যূনতম মজুরি এমন পর্যায়ে নির্ধারণ করতে হবে, যা দিয়ে তারা শিশুর শিক্ষার পুরো ব্যয় এবং তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও পুষ্টি আংশিক হলেও নিশ্চিত করতে পারেন।

১০. সমগ্র শিল্পখাতে তালিকাভুক্ত ও তালিকা বহির্ভূত কারখানাসমূহের ভবন নিরাপত্তা, কর্মপরিবেশ ও শ্রমিক অধিকার, বিদ্যমান আইনের ঘাটতি ও আইন প্রয়োগের দুর্বলতা, সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্যসহ সরকারের পক্ষ থেকে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করতে হবে। বর্তমান বিপজ্জনক, প্রাণঘাতী পরিস্থিতি পরিবর্তনের জন্য করণীয় নির্ধারণ ও তা বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের প্রতিনিধি ও বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি কমিশন গঠন করতে হবে।

জানা যায়, হাসেম ফুড কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে তিনটি তদন্ত কমিটি করা হয়। জেলা প্রশাসন ও ফায়ার সার্ভিস অধিদপ্তরের তদন্ত কমিটি এবং পুলিশের করা কারখানা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে মামলাটির তদন্ত করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি)।

হাসেম ফুডস লিমিটেডের কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে হতাহতের ঘটনায় ১৩ জুলাই নাগরিক কমিটির সমন্বয়ে ১৯ সদস্যের একটি নাগরিক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।

কমিটির পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখেন সদস্য সচিব সিনিয়র আনজীবী মাহবুবুর রহমান ইসমাইল, ডা. মো. হারুন রশিদ।

কমিটির সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন, নাগরিক কমিটির সদস্য মোবাশ্বের হোসেন, অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, অধ্যাপক সি আর আবরার, সাংবাদিক কলামিস্ট সোহরাব হাসান, অধ্যাপক তানজীম উদ্দিন খান, গবেষক ও সাংবাদিক প্রিসিলা রাজ, বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতির সভাপ্রধান তাসলিমা আখতার লিমা, গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরামের সাধারণ সম্পাদক শহীদুল ইসলাম সবুজ, গার্মেন্টস শ্রমিক মুক্তি আন্দোলনের সভাপতি শবনম হাফিজ, প্রকৌশলী মোশাররফ হোসেন, বাংলাদেশ শ্রম ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি গোলাম মুর্শেদ, সাংবাদিক কলামিস্ট ফারুক ওয়াসিফ, তথ্যচিত্র নির্মাতা ব্রাত্য আমিন, গবেষক মাহা মির্জা, শিল্পী ও সংগঠক বীথি ঘোষ এবং গবেষক ও মানবাধিকার কর্মী রেজাউর রহমান লেনিন।

সিটি নিউজ / জি এস

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.