অস্ত্র সমর্পণ করলো এমএনডিপি সদস্যরা

0

বান্দরবান প্রতিনিধি : খুন, অপহরণ, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়েছিলেন ম্রো ন্যাশনাশ ডিফেন্স পার্টির (এমএনডিপি) সদস্যরা। টানা সাত বছর ধরে তাদের কাছে কার্যত জিম্মি ছিলেন পার্বত্য জেলা বান্দরবানের লামা-আলীকদমের বাসিন্দারা। সেনাবাহিনীর কাছে অস্ত্র সমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসায় সেখানকার মানুষের মধ্যে স্বস্তি ফিরেছে।

বৃহস্পতিবার (৫ নভেম্বর) বান্দরবান জেলার আলীকদম উপজেলার কুরকপাতা গ্রামে সেনাবাহিনীর আলীকদম জোন (ত্রিশ বীর) আয়োজিত অনুষ্ঠানে এমএনডিপি’র ৭৯ সদস্য আত্মসমর্পণ করেন। তারা ৫৫টি দেশিয় তৈরি বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র, বেশকিছু গোলাবারুদ এবং ইউনিফর্ম সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করেন।

স্থানীয় ক্ষুদ্র দোকানিদের কাছে এমএনডিপি’র সদস্যরা ছিল চরম আতংকের মতো। অধিকার আদায়ের নামে সংগঠন গড়ে তারা এই কাজ করতেন।

আত্মসমর্পণকারী ম্রো বিদ্রোহীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আলীকদম উপজেলার ছোট বেতি মিনসিং পাড়া, কুরুকপাতা, ঢুকুপাড়াসহ দুর্গম বিস্তির্ণ পাহাড়ি এলাকা জুড়ে টানা সাত বছর ধরে দাপটের সঙ্গে বিচরণ ছিল এমএনডিপি সদস্যদের। গহীন পাহাড়ের ভেতরে ছোট ছোট আস্তানা গড়ে তারা চালিয়ে যাচ্ছিলেন তাদের কর্মকান্ড। নিজেরাই অস্ত্র বানাতেন, কমান্ডার অধীনস্থ সদস্যদের প্রশিক্ষণ দিতেন আর অপহরণের মাধ্যমে মুক্তিপণ আদায় ও চাঁদাবাজি করতেন।

এমএনডিপি’র কমান্ডার মেনরুম ম্রো অবশ্য দাবি করেছেন, তাদের সব সদস্য এসব অপরাধে জড়িত ছিলেন না। কিছু সদস্য বিপথগামী হয়ে পড়েছিলেন। আর তাদের কর্মকান্ডের দায়ভার নিয়ে তাকে আত্মসমর্পণ করতে হয়েছে।

ম্রো বিদ্রোহীরা আত্মসমর্পণ করেন সেনাবাহিনীর আলীকদম জোনের ত্রিশ বীর ক্যাম্পের কাছে। মাতামুহুরী নদীর তীরে কুরুকপাতা এলাকায় ত্রিশ বীর ক্যাম্পের কাছে আয়োজন করা হয় আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের।

আলীকদম সেনা জোন থেকে দুর্গম অরণ্যের ভেতর দিয়ে ৩৫ কিলোমিটার মাতামুহুরী নদী পাড়ি দিয়ে যেতে হয় কুরুকপাতা এলাকায়। পাহাড়ের পর পাহাড় যেন সবুজ ফসলের বিছানা। মরিচ, হলুদসহ বিভিন্ন ফসলের সম্ভার। দুর্গম পাহাড়ে পাহাড়িদের ফলানো এসব ফসল কিনে বান্দরবান জেলা সদরে নিয়ে আসেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। সেই ফসল পৌঁছে যায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। কিন্তু সেই ফসল সংগ্রহে আলীকদম থেকে কুরুকপাতা পর্যন্ত পৌঁছানোটাই ছিল বড় বিপত্তি।

পাহাড়ের ভেতরে প্রত্যেক পাড়ায় পাড়ায় এমএনডিপির আস্তানা আছে। তিন বছর আগে থেকে তারা হঠাৎ করে পাহাড়ে অপহরণ, চাঁদাবাজি শুরু করে। তারা আত্মসমর্পণ করেছে শুনে অনেকে খুশি হয় । এখন মনে হয় আমরা একটু শান্তিতে ব্যবসা করতে পারব।

কুরুকপাতা বাজারের মুদি দোকানদার আজিজুল ইসলাম জানান, ছোট ছোট ছেলে বাজারের মধ্যে এসে অস্ত্র নিয়ে হাঁটত। সবাই ভয়ে থাকত। তবে বাজারের দোকানদারদের কোন ক্ষতি তারা কখনও করেনি।

ম্রো পাড়ার অধিবাসীদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিদ্রোহীদের নিয়ে ম্রো পাড়ায়ও অস্বস্তি ছিল। দল চালানোর জন্য তারা ম্রো পরিবারগুলোর কাছ থেকে টাকাপয়সা তুলত। পাহাড়ের, বাগানের গাছ কেটে বিক্রি করে দিত। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, অনেক পরিবারের কিশোর-যুবকরা ঘর ছেড়ে গিয়েছিল। পরিবারের সঙ্গে তাদের কোন যোগাযোগ ছিলনা। তারা নিজেরাই সশস্ত্র সংঘাতে জড়িয়ে গিয়েছিলেন।

ম্রো সোশ্যাল কাউন্সিলের হিসেবমতে, সাত বছরে দলের প্রতিষ্ঠাতা মেনরুম ম্রো সিনিয়রসহ অন্ত:ত ২৫ জন সদস্য সশস্ত্র সংঘাতে নিহত হয়েছেন।

তবে বর্তমানে দলের কমান্ডার মেনরুম ম্রো জুনিয়রের দাবি, ম্রো পরিবারের চাঁদার টাকায় তারা দল চালাতেন। তারা কাউকে চাঁদা দিতে বাধ্য করতেন না। আর ব্যবসায়ীদের অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়ের মত ঘটনাগুলো কিছু বিপথগামী সদস্য ঘটিয়েছিল।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল সফিকুর রহমান জানান, নিজেদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে এরা একটি সংগঠন গড়ে তুলেছিল। পরে বিপথগামী হয়ে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। অবশেষে অস্ত্র জমা দিয়ে তারা আত্মসমপর্ণ করেছে। আর কেউ এ ধরনের কর্মকান্ডে জড়িত আছে কিনা সেটা দেখে আমরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।

আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন আলীকদম জোনের ব্রিডেগ কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নকিব আহমেদ। আলোচনার মধ্য দিয়ে ম্রো বিদ্রোহীদের আত্মসমর্পণ করানোর মধ্য দিয়ে পাহাড়ে শান্তি ফিরিয়ে আনায় চোখেমুখে স্বস্ত্বির ছাপ দেখা গেছে তার মধ্যে।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.