বাম্পার ফসল হওয়ার পরও কৃষকের দূর্দশা

নতুন ফসল উঠেছে। অথচ বাজার সয়লাব কম দামের ভারতীয় চালে। চালের এ অতিরিক্ত সরবরাহের কারণে বাজারে ধানের দাম কমে যাচ্ছে। ফলে উৎপাদনমূল্য পাবেন না দেশের কৃষকেরা। দেশজুড়ে চালের বাজারের এ পরিস্থিতির মধ্যেও বেসরকারি পর্যায়ে চাল আমদানি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না সরকার। বরং শূন্য শুল্কে ব্যবসায়ীরা চাল আমদানি বাড়িয়ে দিয়েছেন। ব্যাংকগুলোও নিজেদের আয় বাড়াতে ভারতীয় চাল আমদানিতে উৎসাহ দিচ্ছে বলে চাল ব্যবসায়ীরা জানান।
জাতিসংঘের খাদ্য  ও কৃষি সংস্থার (এফএও) পূর্বাভাস বলছে, বোরো ধানের ফলন এবার সর্বকালের রেকর্ড ছুঁতে যাচ্ছে। দেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির জন্য এটা বড় সুসংবাদ। আবার ভোক্তাদের জন্য সুসংবাদ হচ্ছে, গত এক সপ্তাহে চালের দর কমেছে ৬ শতাংশেরও বেশি।  এ রকম এক পরিস্থিতিতে ঘরে ওঠা নতুন ধানের দর মণপ্রতি ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত উঠেছে। অথচ এক মণ ধান ফলাতে খরচ পড়েছে ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকা। এর ফলে ব্যবসায়ীরা ধান কিনে তা চালকলে পাঠানো প্রায় বন্ধ করে দিয়েছেন। সারা দেশের ১৮ হাজার চালকলের মধ্যে ১৫ হাজারই এখন বন্ধ রয়েছে। অথচ গত আমন ধান বন্যায় মার খাওয়ার পর আলু ও সবজিতেও ভালো দাম পাননি কৃষক। ফলে বোরো ধানের দামই ছিল তাঁদের ভরসা।
এরই মধ্যে আবার সরকার চলতি মাস থেকে প্রতি মণ ধান ৮৮০ টাকায় কেনার ঘোষণা দিয়েছে। একাধিক চাল ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শূন্য শুল্কে চাল আমদানির পাশাপাশি ভারতীয় ব্যবসায়ীরা তাঁদের দেশ থেকে চাল রপ্তানির ওপর প্রণোদনাও পাচ্ছেন। ফলে বাংলাদেশের চালের চেয়ে ভারতীয় চালের দর কম পড়ছে। ভারতীয় চালের প্রতি কেজির আমদানিমূল্য ২৫ থেকে ৩০ টাকা পড়ছে। আর সরকার-নির্ধারিত দরে ধান কিনে চালকলে ভাঙলে প্রতি কেজি চালের দর পড়ছে ৩০ থেকে ৩২ টাকা। ফলে ব্যবসায়ীরা চাল আমদানির দিকেই মনোযোগ বেশি দিচ্ছেন। বাজার ঘুরে নুরজাহান ব্র্যান্ডের বস্তার পর বস্তা  চাল দেখা গেছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এগুলো ভারতীয় চাল।
ব্র্যাকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ মাহবুব হোসেন এ ব্যাপারে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দাম ৩০ শতাংশ কমে গেছে।
অনুকূল আবহাওয়ার কারণে ধানের উৎপাদনও এ বছর বেশি। ফলে চালের আন্তর্জাতিক দর গত ছয় মাসে প্রতি টনে ১৫০ থেকে ২৫০ ডলার পর্যন্ত কমেছে। এ পরিস্থিতিতে থাইল্যান্ড এবং ইন্দোনেশিয়া কৃষককে রক্ষা করতে আমদানির ওপর শুল্ক ও সরকারি সংগ্রহ বাড়িয়ে দেয়। আমাদের সরকারকেও কৃষক বাঁচাতে হলে এই নীতি অনুসরণ করতে হবে।’

দেশের সব ধরনের চালকলের জাতীয় সংগঠন বাংলাদেশ অটো-হাসকিং ও মেজর রাইস মিল মালিক সমিতির সভাপতি লায়েক আলী এ ব্যাপারে প্রথম আলোকে বলেন, ‘কৃষককে ন্যায্যমূল্য দিতে হলে ও  চালকলগুলোকে বাঁচাতে হলে সরকারের উচিত চাল আমদানির ওপর শুল্ক আরোপ করা। আমরা এ বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয় ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে লিখিতভাবে জানিয়েছি। কিন্তু কোনো ফল হয়নি।’ খাদ্য অধিদপ্তর কাগজে-কলমে গত শুক্রবার থেকে ১১ লাখ টন সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রার কাজ শুরু করেছে। সরকারের সংগ্রহমূল্য ঘোষণার পরপরই ধান-চালের দর বাড়ে। প্রতিবছর এমনটাই হয়ে আসছে। তবে এবার ধান-চালের বাজারে উল্টো স্রোত বইছে। গত এক সপ্তাহে খাদ্য অধিদপ্তরের হিসাবে মোটা চালের দর কমেছে ৬ শতাংশেরও বেশি। মাঝারি ও চিকন চালের দরও কমবেশি দেড় থেকে ৩ শতাংশ কমেছে।
খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলামের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা খাদ্য আমদানি নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি চিন্তা করছি। এ বিষয়ে আমরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) লিখিতভাবে জানিয়েছি।’
অন্যদিকে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেশের মোটা চালের প্রতি কেজির পাইকারি মূল্য ২৩ টাকা ও খুচরা ৩২ টাকা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আর আরেক সরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) তাদের ওয়েবসাইটে প্রতি কেজি চাল ৩২ থেকে ৩৭ টাকায় বিক্রি হচ্ছে বলে উল্লেখ করেছে।
এফএওর প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ বছর বোরোতে ২ কোটি ৯০ লাখ টন ধান উৎপাদিত হবে, যা বাংলাদেশে ধানের উৎপাদনের একটি নতুন রেকর্ড।

এ বিভাগের আরও খবর

Comments are closed.