বরিশালে নির্বাচনী সহিংসতায় ঝরছে প্রাণ

বরিশাল: বরিশাল তথা গোটা দক্ষিণাঞ্চলে নির্বাচনী সহিংসতা চরম আকার ধারণ করেছে। গত ৩ মার্চ প্রতীক বরাদ্দের পরে এ অঞ্চলে সহিংসতায় ঝরে গেছে ৩টি তাজা প্রাণ। নির্বাচন পূর্ব এ সহিংসতায় আহত হয়েছেন অন্তত ১ হাজারেরও বেশি মানুষ। এছাড়া পক্ষ-প্রতিপক্ষ প্রার্থীর নির্বাচনী কার্যালয় এবং বাসা বাড়িতে হামালা-ভাঙচুর-আগুন সন্ত্রাসের মতো ভয়ানক ঘটনাও অব্যাহত রয়েছে।

বিশেষ করে সংঘাতের মাত্রা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা ক্ষণে ক্ষণে বাড়িতে তুলছেন। নিজ দলের বিদ্রোহী প্রার্থীদের দাবিয়ে রাখা এবং বিএনপি প্রার্থীদের মাঠ ছাড়া করতেই তারা এই সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।

যদিও এসব ঘটনায় বিদ্রোহীরাও সহিংস হয়ে ওঠায় নৌকার প্রার্থীরা তেমন একটা সুবিধা করতে পারছে না। যে কারণে সংঘাতময় পরিস্থিতির শেষান্তে ঘটছে প্রাণবিয়োগের মতো ঘটনা।

আবার ঘটনাচক্রে ক্ষমতাসীন দলের বিদ্রোহী প্রার্থীরাও নৌকা প্রার্থীর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনুষ্ঠানিকভাবে মিডিয়ার দরবারে তুলে ধরছেন। এক্ষেত্রে তারা প্রশাসনের বিরুদ্ধেও আইনপরিপন্থী আচারণ এবং পক্ষপাতের অভিযোগ আনতে দ্বিধাবোধ করছেন না। সময় বিশেষ এ অঞ্চলের কোনো কোনো থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের (ওসি) অপসারণের দাবি আলোচনায় আসছে।

যার দরুণ প্রশাসনের কর্মকর্তারা নির্বাচনী পরিবেশ-পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ রাখা নিয়ে যতটা না ভাবছেন, তার চেয়ে বেশিমাত্রায় চেয়ার রক্ষায় দৌঁড়ঝাপ শুরু করেছেন। সেই সুযোগে সংঘাতের মাত্রা ক্রমশই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলশ্রুতিতে আসন্ন এই ইউনিয়ন নির্বাচন নিয়ে সাধারণ মানুষ অর্থাৎ ভোটারদের মধ্যে বিরাজ করছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা।

উল্লেখ্য, সর্বশেষ গত শুক্রবার রাতে ভোলায় প্রতিপক্ষের হামলায় এক মেম্বার প্রার্থীর কর্মী মো. সিরাজ নামে এক ব্যক্তি নিহত হন। সেই হামলায় আহত হন আরো অন্তত ৫জন। তিনি চরসামাইয়া ইউনিয়নের বজলু মেম্বারের কর্মী ছিলেন। অভিযোগ উঠেছে শাসকদলীয় প্রার্থী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর সনির ছেলে শামিমের নেতৃত্বে সিরাজের ওপর হামলা চালানো হয়। সেই হামলায় সিরাজ নিহত হন।

এর আগে গত ৭মার্চ পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলায় ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনী সহিংসতায় আদাবাড়িয়া ইউনিয়নের স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি আশরাফ ফকির (৩৫) নিহত হন। সেই হামলার ঘটনায়ও আহত হয়েছেন পাঁচজন। এ ঘটনায় অভিযোগ পাওয়া গেছে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী শামসুর রহমান ফকির এবং বিদ্রোহী প্রার্থী মো. জাহাঙ্গীর হোসেনের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে এ প্রাণবিয়োগ হয়।

ওই ঘটনার এক দিনের মাথায় পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থী এসএম কাইউম উজ জামানের কর্মীদের হামলায় শামসুল হক ছোট্ট (২৭) নামে এক ছাত্রদল কর্মী নিহত হন। তিনি নাজিরপুর উপজেলা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক ও শেখমাটিয়া ইউনিয়ন ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। শেখমাটিয়া ইউনিয়নের বিএনপি তথা ধানের শীষ প্রতীকের চেয়ারম্যান প্রার্থী তৌহিদুল ইসলামের কর্মী ছিলেন।

তবে বরিশালে এই তিন প্রাণহানীর ঘটনা ছাড়াও নির্বাচনী সহিংসতা অব্যাহত রয়েছে। ইতোমধ্যে জেলার মেহেন্দিগঞ্জ, বাকেরগঞ্জ, উজিরপুর এবং গৌরনদীতে ঘটেছে একাধিক সংঘাতের ঘটনা। বিশেষ করে এতে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর বিরুদ্ধেই হামলা এবং নির্বাচনী আচারণবিধি লঙ্ঘণের অভিযোগ ঢের।

এছাড়া এ অঞ্চলের ঝালকাঠি, পিরোজপুর এবং বরগুনায়ও এবারের ইউপি নির্বাচনে প্রতিনিয়ত একই ধরণের সহিংসতার খবর পাওয়া যাচ্ছে। এসব হামলা, সংঘর্ষ, ভাঙচুরের ঘটনায় সবমিলিয়ে অন্তত হাজারেরও বেশি মানুষ আহত হয়েছেন।

এক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত হচ্ছে- এবারের ইউনিয়ন নির্বাচনে যে সহিংসতা হচ্ছে তা গত পৌর নির্বাচনকেও হার মানিয়েছে। এর মূল কারণ হচ্ছে দলীয় প্রতীকে তৃণমূল পর্যায়ের এ নির্বাচন। ফলে শুরুতেই প্রতিনিয়ত দক্ষিণের জনপদে ঘটছে সংঘাত-রক্তপাত।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। যদিও এসব ঘটনাকে প্রশাসন বা নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে বিচ্ছিন্ন দাবি করে তা উড়িয়ে দেয়া হচ্ছে।

বরিশাল বিভাগীয় কমিশনার মো. গাউস জানান, নির্বাচনী সহিংসতা রোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সর্বাত্মক ভূমিকা পালন করতে বলা হয়েছে। বিশেষ করে নির্বাচন কমিশনারের যে নির্দেশনা রয়েছে তা বাস্তবায়ন করতে পুলিশ প্রশাসন মাঠে কাজও করছে। যদি এর ভেতরে ২/১ টি ঘটনা ঘটে যায় তা হচ্ছে অনাকাঙ্ক্ষিত।

একই প্রসঙ্গে বরিশাল আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা মীর মো. শাজাহান জানান, নির্বাচনটা যেহেতু তৃণমূল পর্যায়ের এবং ব্যাপক আকারে হচ্ছে সেক্ষেত্রে সংঘাত বা সহিংসতা হতেই পারে। কারণ, এই নির্বাচনে দেখা যাচ্ছে প্রতিটি এলাকাতেই একজন করে প্রার্থী রয়েছে। ফলে তাদের স্বজন বা কর্মীরা প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণায় মাঠে নামছেন। যে কারণে সহিংসতা বাড়ছে। তবে এটাকে বড় করে না দেখে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলতে হবে বলে মনে করছেন এই কর্মকর্তা।

এ বিভাগের আরও খবর

Comments are closed.