সন্তান যখন জঙ্গি: পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের করণীয়

0

আহমেদ হোসেন – 

পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কঠোর নজরদারি ও নিবিড় তদারকিতে সন্তানদের জঙ্গি হয়ে ওঠা বন্ধ করা সম্ভব। সন্তানের মনো-জাগতিক বিকাশে সামাজিকীকরণের এ প্রধান দুই ইউনিটের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পরিবার যখন সন্তানের আশ্রয়ের জায়গা হয়ে উঠতে বর্থ হয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যখন শিক্ষার্থীদের মনোযোগ হারায় তখন শূন্যতার সুযোগ নেয় রাজনীতির আবরণে লুকিয়ে থাকা সুযোগ সন্ধানীরা। নিষ্ঠুরতার অচিন্তনীয় ফাঁদে এভাবে আটকা পড়ে প্রাণপ্রিয় সন্তানটি। ‘সন্তান যখন জঙ্গি: পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের করণীয়’ বিষয়টি এখন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত গুরুত্ববহন করে। পরিবারকে নজর রাখতে হবে সন্তান কোথায় যায়, কি করে সেদিকে। আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মনিটরিং করবে শিক্ষার্থীর আসা-যাওয়া, পাঠগ্রহন প্রবণতাসহ প্রাসঙ্গিক সকল বিষয়ে।

সন্তান প্রকৃত শিক্ষা পাচ্ছে কিনা জ্ঞানার্জন সঠিকভাবে হচ্ছে কিনা পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি একটা আদর্শিক ও সংস্কৃতি আবহের মধ্যে তাদের গড়ে তুলতে হবে। আমাদের সব তরুণ নষ্ট নয়, সবাই বিপথে যায়নি। যারা যাচ্ছে তাদের পথরোধ করতে হবে, ফেরাতে হবে এবং বোঝাতে হবে। ঐ নৃশংসতার পথ ধর্ম ও মানবিকতার নয়। এ জন্য সবাইকে উদ্যোগ নিতে হবে। সচেতন ও দায়িত্বশীল হতে হবে। সন্তান শিক্ষা ও মানবিকতা ও ধার্মিকতার গুণ অর্জন করবে প্রথমে পরিবার থেকে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিসর আরো বড়। এখানে তার বোধশক্তি জাগ্রত হবে, যুক্তির উন্মেষ ঘটবে। শিক্ষা ও জ্ঞানের সমন্বয়ে সে পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে উঠবে- জঙ্গি হয়ে নয়। তাই এক্ষেত্রে পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব অনেক বেশি। সন্তান কিংবা শিক্ষার্থী নৃশংস হয়ে যাওয়ার পর তা-হুতাশ করে কোন লাভ হবে না।

পরিবারের বন্ধনে শৈথিল্য, রাজনীতিতে অসুস্থতা সর্বোপরি দেশী-বিদেশী চক্রান্তে জঙ্গিবাদের উত্থান হচ্ছে। বিশ্বে কারা আইএস সৃষ্টি করেছে দেশে জঙ্গিবাদে ইন্ধন দিচ্ছে সে কথা সচেতন সকল মহলই জানে। রাজনীতিতে সহিঞ্চুতা থাকলে, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ করতে পারলে চরম পন্থা কোন সুযোগ নিতে পারবে না। এক্ষেত্রে ঐক্যবদ্ধ পতিরোধ খুব বেশি প্রয়োজন। সন্তান বিচ্ছিন্নবোধ করে কেন, কোন হাতছানিতে সে নিজেকে হারায় তা গভীরভাবে ভাবতে হবে পরিবারকে। সন্তানের সামনে অনুসরণীয় আদর্শ তৈরি করে দিতে হবে। অতিমাত্রায় প্রযুক্তি আসক্তিতে তারা কি মানবিকতা হারাচ্ছে- দেখতে হবে। শিক্ষার সাথে নৈতিকতা মানবিকতা গুরুত্বের সাথে যুক্ত করতে হবে। সন্তানদেরকে আদর্শ, নৈতিকতা ও মানবিক গুণাবলীর প্রতি আকৃষ্ট করা না গেলে তা আত্মপরিচয়ের সংকটে ভুগবে।

এ কারণে তাদের বিপথগামি হওয়ার সমস্যা তৈরি হয়। জঙ্গিবাদ বিশ্বজুড়ে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার খেলায় একটি সাম্রাজ্যবাদী কৌশল। সারা বিশ্বে এটি কেটি আরোপিত সমস্যা। সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের এ কৌশল চাপিয়ে দেয় স্থানীয় সংকট ও বিরোধকে কাজে লাগিয়ে। আমাদের যে তারুণ্য ’৫২ এবং ’৭১ এর অহংকার সেই তারুণ্যের আদর্শ ও শক্তি আজ নষ্ট হয়ে গেছে। সোশ্যাল মিডিয়ামুখী তারুণ্য আজ আনসোশ্যাল, প্রযুক্তিময় তারা আজ দিশেহারা। এ অবস্থা থেকে তাদের আলোর পথ দেখাতে হবে, উদ্ধার করতে হবে- ঐক্যবদ্ধভাবে। এক্ষেত্রে পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা অনেক বেশি। একটি পরিবারে সন্তান যখন নিজের অজান্তে জঙ্গি ও সন্ত্রাসী পথে পা বাড়ায় তখন পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের জন্য এটি সামাজিক ভাবে একটি লজ্জার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।

মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ধর্ম কোনো বিবেচ্য বিষয় নয়, বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে মানুষের বিবেক ও মনুষত্ব। অস¤প্রদায়িক চিন্তা, চেতনা, মননে সন্তানকে গড়ে তুলতে হবে। পরিবারে মা-বাবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব সন্তানদের সুন্দর মানসিকতা শিক্ষা দেয়া। কোনো ছাত্র-ছাত্রী এক মাস কিংবা পনের দিন স্কুল কলেজে না এলে সেই স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের ঐ ছাত্র-ছাত্রীদের ব্যক্তিগত প্রোফাইল সংগ্রহ করতে হবে। অন্যদিকে বাসা থেকে স্কুল-কলেজের উদ্দেশ্যে বের হয়ে আপনার সন্তানকে অন্য কোথাও ঘুরে বেড়াচ্ছে সেটি তদারকি করার দায়িত্ব একমাত্র অভিভাবকের। কারণ সুষ্ঠ তদারকির অভাবে সন্তান বিপথগামী হয়ে উঠে, মাদকাশক্ত হয়ে উঠে। জঙ্গি ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে লিপ্ত হয়। এক্ষেত্রে স্কুল-কলেজে শিক্ষক নিয়োগেও সতর্ক থাকতে হবে।

কেননা নানা কারণে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে আমাদের আদর্শ। মৌলবাদী, রাজনীতির চর্চা হচ্ছে। নানা কারণে সংকট তৈরি হয়েছে। ইসলাম শান্তির ধর্ম, মানবতার ধর্ম, ইসলামের নামে মানুষ হত্যা জঘন্যতম অপরাধ। এটিকে কোনো ভাবেই প্রশ্রয় দেয়া যাবেনা। যারা কিনা মুরগি জবাই করতে ভয় পেতো, তারা এখন মানুষ জবাই করে। তাদের এই নৈতিক অবক্ষয় উত্তোরণে সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। তরুণ প্রজন্মের সামনে আদের্শর অনুপস্থিতি রয়েছে। শিক্ষকদের সেক্ষেত্রে ভূমিকা রয়েছে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের নির্বাচন হয় না। এক্ষেত্রে গণতন্ত্র চর্চা ও সংস্কৃতি চর্চার বিকাশ হচ্ছে না। আর এতে করে সামাজিক অবক্ষয় ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। এখনকার ছেলে মেয়েকে মা-বাবা’রা সময় দেন না। তাদের সাথে ভালমন্দ শেয়ার করতে পারে না।

যে যার যার কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকার কারণে ছেলে-মেয়েদের সাথে মা-বাবার যে আদর্শিক সম্পর্ক তা গড়ে উঠেনা। মন খুলে বলতে পারেনা, তাদের না বলা অনেক অজানা কথা। পিতার আয়ের সাথে ব্যয়ের বৈষম্যের কারণে সন্তানরা অনেক সময় নৈতিকতা হারিয়ে ফেলে। পরিবারে যখন প্রায়শ সন্তানরা মা-বাবার মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ দেখতে পায় তখন সে মানসিক ভাবে আঘাত প্রাপ্ত হয় এবং তার মনের মধ্যে ক্রোধ জন্ম নেয়। কোনো মা-বাবা চায়না যে, তার সন্তান জঙ্গি হোক। সবাই চায় তার ছেলেটি যাতে ভালো হয়। তাদের সুনাম ফুটিয়ে তুলুক। আমাদের পারিপার্শ্বিকতা, অর্থনৈতিক সংকট ধর্মীয় উন্মাদনা, অর্থের প্রতি লোভ, একাডেমিক শিক্ষার প্রতি দুর্বলতা, চাকুরীর জন্য টার্গেট নিয়ে পড়া-শুনা করা, এ সমস্ত মনোভাব কখনও দেশ, রাষ্ট্র, জাতি, সমাজ, পরিবার ও প্রতিষ্ঠানে কল্যাণ বয়ে আনবেনা। পরিস্থিতি এখন ভয়াবহ, তবে ভয় পেলে চলবেনা। সবাইকে মানসিক ভাবে শক্তিশালী হতে হবে। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে দেশ যেভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে তাতে করে এদেশের মাটিতে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ চিরতরে নির্মূল হবে।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.