চট্টগ্রামে সরকারী দলের নিয়ন্ত্রনে চাঁদাবাজি থেকে টেন্ডারবাজি

0

জুবায়ের সিদ্দিকী :  সারাদেশে টেন্ডারবাজি বন্ধ করতে সরকার ই-টেন্ডারের ঘোষনা দিলেও আজ পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন হয়নি। দেশের অভ্যন্তরে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া মানচিত্রের সর্বত্র টেন্ডার এখন নিয়ন্ত্রন করছে প্রকাশ্যে সরকারী দলের সিন্ডিকেটের মাধ্যমে। এই সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রন নিয়ে চলছে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হানাহানি ও খুনোখুনি। এই টেন্ডারবানিজ্য ঘিরে সরকারী দলের সঙ্গে সহযোগী সংগঠনের অভ্যন্তরীন বিরোধ রাজধানী সহ সারাদেশে ব্যাপকভাবে রুপ নিয়েছে।

বেশিরভাগ জেলায় সরকারী দলের সংসদ সদস্যগন মুল সিন্ডিকেটের গড়ফাদারের ভুমিকা পালন করছেন। এর ফলে সিন্ডিকেটের লোকজনও ঠিকভাবে কাজ করতে পারছেন না। ব্যহত হচ্ছে  উন্নয়ন কর্মকান্ড। এরপরও সরকারী এসব সংস্হার অসহায় প্রকৌশলীরা চাপের মুখে সব মুখ বুঝে মেনে নিচ্ছে ন। আবার অনেকে সিন্ডিকেটে জড়িয়ে পড়ছেন। চট্টগ্রামে বড় বড় শিল্প কারখানা ছাড়াও পিডিবি, পানি উন্নয়ন বোর্ড, জেনারেল পোষ্ট অফিস, গনপুর্ত বিভাগ, সড়ক ও জনপথ বিভাগ, চট্টগ্রাম বন্দর, সিটি কর্পোরেশন, রেলওয়ে, আর এন্ড এইচ, এলজিআরডি সহ সরকারী এসব সংস্হাতে কাজ করছে সিন্ডিকেট। শক্তিশালী এই সব সিন্ডিকেট সরকারী দলের লোকজনের দ্বারা গঠিত। এদের হাতে নিয়ন্ত্রিত হয় টেন্ডার।

এই ব্যাপারে টিআইবি বলছে, টেন্ডারবাজী এখন রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যক্তিগত স্বার্থ সুবিধা এবং ক্ষমতার যোগসাজসে অর্থ, গাড়ি, বাড়ির মালিক হতে হবে-এই প্রবনতা থেকেই রাজনীতিতে আসছেন সবাই। এমনকি এই নিয়মনীতিকে নেতারা প্রাতিষ্টানিক রুপ দিতেও কুন্ঠিত হচ্ছেন  না।
কিছুদিন আগেই একজন এমপি বলেছেন,’ক্ষমতায় থাকলে তো সম্পদ বাড়বেই’-বাহ কি চমৎকার বানীভ যেন অমৃত সুধা পান করেছে জনগন। চট্টগ্রাম মহানগরীতে রেলওয়েতে বছরখানেক আগে টেন্ডারবাজীতে হয়েছে সরকারী দলের দুটি গ্রুপের প্রচন্ড গোলাগুলি। এতে প্রাণ হারিয়েছে পথচারী কিশোর। এমন হযবরল অবস্হা , বন্দর, কাষ্টমস, বিপিসি, পদ্মা. মেঘনা, যমুনা, পিডিবি সহ অনেক সরকারী দপ্তরে। এমনকি ভার্সিটিতেও। আমার এক বন্ধু জানালেন, কুমিল্লার লাঙ্গলকোটে হেসাখাল বাজার কলেজে শিক্ষা মন্ত্রনালয় ভবন তৈরীর জন্য ৪৭ লাখ টাকা বরাদ্দ দেন। সেখানে কুমিল্লার টেন্ডার সিন্ডিকেট অন্য কাউকে টেন্ডারে অংশ নিতে দেয়নি। অতিরিক্ত ১০ লাখ টাকা বাড়িয়ে এই টেন্ডারবাজরা টেন্ডারে অংশ নেয়। কুমিল্লা থেকে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরে অতিরিক্ত এই প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে কয়েকবার। কিন্তু  শিক্ষা প্রকৌশল দফতর কোন সিদ্ধান্ত গ্রহন করেননি। এ কারনে চলতি অর্থবছরে এই বরাদ্দ দিয়ে আদৌ কোন কাজ হবে কিনা কেউ জানে না। কুমিল্লাতেও চট্টগ্রামের মত প্রতিটি কাজ টেন্ডার সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রন করে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট দপ্তরও নিজেদের অসহায়ত্বের কথা বলছেন। তবে কেউ নাম প্রকাশ করতেও আমাকে নিষেধ করেছেন। উনারা বললেন,’ কিতা কইছি বুঝছইন। আমার নাম যেন ছাপা না হয়। তাইলে আর চাকরী করতে হইব না।
চট্টগ্রামে একাধিক গোয়েন্দা সংস্হার নিকট তালিকাভুক্ত পেশাদার টেন্ডারবাজ হিসাবে আছে প্রায় অর্ধশতাধিক ব্যক্তির নাম। কেউ যুবলীগ, কেউবা ছাত্রলীগ নেতা। শীর্ষ নেতাদের ছত্রছায়াতে এসব নেতারা সরকারী দপ্তর সমুহে চালাচ্ছে টেন্ডারবাজি। এদের অস্ত্র ও দাপটের কাছে অসহায় প্রকৃত ঠিকাদাররা। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, টেন্ডারবাজিতে ওয়ার্ড ও নগর আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতা ও পাতি নেতারা জড়িত। মজার বিষয় হচ্ছে , পেশা ঠিকাদারী না হলেও সরকারী দপ্তরগুলোতে তাদের পরিচয় টেন্ডারবাজ হিসেবে। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনেও একই চিত্র। কিছুদিন আগেও নগরীর রেয়াজুদ্দিন বাজারে শুটকি বিক্রেতা, সুপারি বিক্রেতা, ছাত্রনেতা, ওয়ার্ডের নিত নম্বর কর্মী, মহল্লার মাস্তানও অনেকে এখন কর্পোরেশনের ঠিকাদার।

ছাত্রদল, যুবদল, ছাত্রলীগ, যুবলীগের নেতাকর্মী সিন্ডিকেট করে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে কর্পোরেশনে ঠিকাদারী করে অনেকে এখন কোটিপতি। টেম্পুর ভাড়া দিতে হিমশিম খেতেন যে সব নেতা তারাই এখন দামি গাড়ি হাঁকিয়ে সভা সমাবেশ করে রাজনীতি করছেন। ঠিকাদারী ও রাজনীতি যেন মাসতুতো ভাই। অবস্হাদৃষ্টে তাই মনে হয় আমার কাছে। নগরী ও নগরীর বাহিরের অনেক এমপির পৃষ্টপোষকতায় এই নেতা এখন টেন্ডারবাজ। এরা ভয়ংকর টেন্ডারবাজ। এদের দাপটে তৃনমুলের কর্মীরা রাজনীতি থেকে যেন ছিটকে পড়ছে, না হয় নিস্ক্রিয় হয়ে পড়ছেন রাজনীতিতে। এই টেন্ডারবাজদের অনেকের ঠিকাদারী লাইসেন্স নেই। তবুও তারাই নিয়ন্ত্রন করেন সরকারের উন্নয়ন জাজের দরপত্র। আবার অনেকের একটি নয়। কয়েকটি লাইসেন্স আছে। এদের দাপট আরও বেশি।

এসব ঠিকাদারগন দরপত্র জমা দিয়েই হাতিয়ে নেন কাজের ১০ শতাংশ অর্থ। নিয়মিত তাদের দেখা মেলে বন্দর, কাষ্টমস, রেলওয়ে, গনপুর্ত, সড়ক ও জনপথে, পিডিবি ও শিক্ষা বিভাগ সহ এলডিপিতে। কর্পোরেশনেও এরা ছুটে যান। যেন তারা বড় নেতা, বড় ঠিকাদার। আসলে এরা টেন্ডারবাজ। এসব টেন্ডারবাজদের অনেকে নিজেদের ছবির সাথে নবনির্বাচিত মেয়রের ছবি লাগিয়ে নগরীতে বিশাল বিশাল বিলবোর্ডও টাঙ্গিয়েছে। এদের মধ্যে যাদের ঠিকাদারী লাইসেন্স আছে, তাদের অনেককেই দেখা যায়নি কাজ করতে। দরপত্র কিনে ’নিকো’ (কাজ পাইয়ে দেওয়ার জন্য সমঝোতা) করাই তাদের মুল পেশা। সিডিএ, কর্পোরেশন, এলজিইডি, সড়ক ও জনপথ, বন্দর, রেলওয়ে, পোষ্ট অফিস, পিডিবি, স্বাস্হ্য প্রকৌশল, বিপিসি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের টেন্ডার নিয়ন্ত্রনে আছেন আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও ছাত্রলীগের সাবেক ও বর্তমান কমিটির কিছু নেতা। একাধিক গোয়েন্দা সংস্হার তালিকায় তাদের পরিচিতি টেন্ডারবাজ হিসেবে।

এসব চিহ্নিত টেন্ডারবাজদের সঙ্গে দেনদরবারে মিল না হলে এক কাজের দরপত্র একাধিকবার আহবান করতে হয়। টেন্ডারবাজদের কারনে রীতিমত টেনশনে আছেন নবনির্বাচিত জনপ্রতিনিধিগন। গোয়েন্দা সংস্হার রিপোর্টে জানা গেছে, টেন্ডারবাজরা নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখতে নির্দিষ্ট ভবনে শোডাউন ও তাফালিং এর মহড়া দেয় সময়মত দফায় দফায়।
টিআইবি বলছে, রাজনৈতিক দলগুলোতে সংখ্যায় কম হলেও এখনো সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব আছে। দলে শৃঙ্খলা, গনতন্ত্র ও রাজনৈতিক মুল্যবোধের আস্হা ফিরিয়ে আনতে এসব নেতাদের উদোগী হওয়া সময়ের প্রয়োজন’। দেশের এমন কোন শহর বা জেলা শহর ও উপজেলা নেই যেখানে টেন্ডারবাজরা তৎপর নয়। টেন্ডারবাজদের সিন্ডিকেটে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতাকর্মীরা মিলেমিশে কাজ করেন। রাজনীতির মাঠে দুই মেরুতে অবস্হান করেও অনেককে যৌথভাবে ঠিকাদারী ব্যবসা চালাতে প্রত্যক্ষ করা গেছে। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে আলোচিত সমালোচিত বিলবোর্ড মনছুরের সাথেও যুবলীগের কয়েকজন নেতার যৌথ ব্যবসা আছে বলে জানা গেছে।

এই বিলবোর্ড মনছুর বিএনপির সমর্থক ও সক্রিয় নেতা। এই মনছুর নগরীর বাড়ি মালিকদের হোল্ডিং টেক্স নির্ধারন নিয়েও কয়েকটি ওয়ার্ডে মানুষকে জিম্মি করে মোটা অংকের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। যারা টাকা দিয়ে দফারফা করেছে তাদের হোল্ডিং টেক্স কিছুটা কমিয়ে সহনীয় পর্যায়ে আনা হয়েছে। অপরদিকে যারা যোগাযোগ করেননি তাদের হোল্ডিং ট্যাক্স ৩ থেকে ৪ গুন পর্যন্ত বৃদ্ধি করেছে। বিগত মেয়রের সময়কালে মনছুরের ক্ষমতা ছিল দেখার মতো।
চট্টগ্রাম মহানগরীতে শুধু টেন্ডারবাজী করেই অনেক সরকারী দলের নেতা ও পাতি নেতা কোটিপতি। রাজনীতির মাঠে এরা বড় নেতা। রাজনীতির সকল অনুষ্টানে এদের দাপটও চোখে পড়ার মত। চাঁদাবাজ থেকে টেন্ডারবাজ হিসেবে নগরীতে সরকারী দলের ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের দৌরাত্ব্য দলের ও সরকারের ভাবমুর্তি বিনষ্ট করছে। অন্যদিকে প্রকৃত ঠিকাদাররা তাদের ব্যবসা আস্তে আস্তে গুটিয়ে ফেলছেন। কারন টেন্ডারবাজদের ফ্রাংকেনষ্টানি দাপট ও অবৈধ অস্ত্রের কাছে এরা অসহায়।

আমি নিজেও স্বাধীনতা উত্তরকালে নগর ছাত্রলীগের নেতৃত্ব দিয়েছি। কিন্তু রাজনীতিকে পেশায় বা কোন টেন্ডারবাজকে ছাত্রলীগ বা যুবলীগ জন্ম দেয়নি। তখন চট্টগ্রাম মহানগরীতে বা জেলায় ছাত্রলীগের বা যুবলীগের যে চেহারা তাতে দু:খ হয়। এই সংগঠনগুলোর অনেক সুনাম ছিল। ৬৮ ও ৬৯ সালে ছাত্রলীগ করা যেত না। অভিযাত্রীক নাম দিয়ে রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালিত হয়েছে। ঘরের খেয়ে বাপের টাকায় রাজনীতি করেছি। এখন দিন পাল্টেছে। এখন রাজনীতি পেশায় পরিনত হয়েছে। রাজনীতি অর্থ ও সম্পদ গড়ার হাতিয়ার হয়েছে।

৭২ ও ৭৩ সালে ছাত্রলীগের একজন সক্রিয় ও রাজপথের নগন্য কর্মী হিসেবে এই নগরীতে রাজনীতিতে আমাদের পদচারনা ছিল নান্দনিক ও সততার পথে অহিংস আন্দোলন সংগ্রামে। সেদিন আজ ইতিহাস। তবে সেই ইতিহাসের জন্য আমি গর্ববোধ করি। কারন আমাদের হাতে রক্তের দাগ নেই। কোমরে পিস্তল ছিল না। রাজপথে দাপট দেখাইনি। সাধারন মানুষ ও শান্তিপ্রিয় নাগরিক হিসেবে দিন কাটিয়েছি। জনগনের জন্য রাজনীতি ছিল। এখন রাজনীতি টাকা কামানোর মাধ্যম। পেশিশক্তির মহড়ায় সন্ত্রাসের বরপুত্ররা ছাত্রনেতা নামে এখন ফ্রাঙ্কেনষ্টাইনি দানব। এরা কখন যে তার গডফাদারদের লাশ ফেলে দেয় বলা যায় না। এদের কারনে একদিন দলকে ও দেশকে চরম মুল্য দিতে হতে পারে।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.