চট্টগ্রামে নওফেলের বাজিমাত

0

জুবায়ের সিদ্দিকীঃ  চট্টলবীর আলহাজ্ব এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ১৭ বছরের সফল মেয়র ছিলেন। চট্টগ্রামকে আধুনিক নগরীতে পরিনত করার পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান রয়েছে তাঁর। ’৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে সাহসী ভুমিকা রেখেছিলেন। স্বৈরশাসকদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে রাজপথ দখলে রেখেছিলেন তিনি। কোন ভয়-ভীতি তাকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতি থেকে দুরে সরাতে পারেনি। জেল জুলুম ও অত্যাচার সহ্য করেছেন প্রতিনিয়ত। কিন্তু শক্তির অন্যতম উৎস ছিল জনগন। আওয়ামী লীগের রাজনীতির প্লাটফরম ছাড়াও সব শ্রেনী পেশার মানুষের সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল মহিউদ্দিন চৌধুরীর।

তাঁর সন্তান হিসেবে রাজনৈতিক পরিবার মন্ম নিলেও নওফেল পুরোপুরি রাজনীতির সাথে যুক্ত হন ২০১৩ সালের ১৪ নভেম্বর। সে সময় চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের কমিটিতে সদস্য হয়েছিলেন। প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর জ্যোষ্টপুত্র ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের রাজনৈতিক পদ পাওয়াটা এভাবে শুরু। মাঝখানে পেরিয়ে গেছে আরো পাঁচ বছর।

২০১৩ থেকে ২০১৯ এ পাঁচ বছরে রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে নওফেল যেমন চমক দেখিয়েছেন। তেমনি সাফল্য ধরা দিয়েছে তাঁর হাতে। সর্বশেষ উপমন্ত্রী হয়ে সেই সফলতার ধারাবাহিকতায় সুচনা হল নতুন এক অধ্যায়ের। রাজনীতিতে তাঁর নিষ্ঠা ও শ্রম যেন পুর্ণতা পেয়েছে। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিপুল ভোটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে যে চমকটি দিলেন তার রেশ না কাটতেই নওফেল হয়েছেন বাংলাদেশ সরকারের উপমন্ত্রী।

এর আগে ২০১৬ সালের ২৫ অক্টোবর অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ২০ তম জাতীয় সম্মেলনে নওফেল কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক হলে চট্টগ্রামের ঝিমিয়ে পড়া রাজনীতিতে আসে কর্মচঞ্চলতা। জীবদ্দশায় বড় ছেলে নওফেলের রাজনৈতিক পদে আসীন হওয়ার সাক্ষী হলেও সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী হওয়ার সৌভাগ্য দেখে যেতে পারেননি চট্টলবীর মহিউদ্দিন। অনেকের মতে, বারবার পিতা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর ত্যাগ ও বর্নাঢ্য রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের পুরস্কার জুটছে নওফেলের ভাগ্যে। তবে নওফেলও কেন্দ্রীয় দায়িত্বে দক্ষতা, বিচক্ষনতা ও নিষ্টার পরিচয় দিয়েছেন।

মন্ত্রী হওয়ার পর নিজের প্রতিক্রিয়ায় ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলেন, প্রধানমন্ত্রী আস্থা রেখেছেন। আমি অর্পিত দায়িত্ব পালন করবো। নেত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী যাবতীয় কর্মকান্ড চালিয়ে যাব। আমার পিতা জীবিত থাকলে আজকে খুব খুশী হতেন। আমি মনে করি আমার বাবার প্রতি সবসময় যে আস্থা রাখতেন আজকে আমাকে মুল্যায়নের মাধ্যমে তা আবারও প্রতিষ্ঠিত করলেন।

জানা যায়, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কমিটি থেকে শুরু করে মন্ত্রী পর্যন্ত সবখানেই নওফেলের স্থান ছিল বড় চমক। জাতীয় নেতাদের কাতারে থাকলেও আঞ্চলিকতার বাইরে যেতে চাননি টানা ১৭ বছর চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের দায়িত্ব পালন করা মহিউদ্দিন চৌধুরী। চট্টগ্রামপ্রেমী এই মানুষটি সরকারের মন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাবও ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। যে কারনে আক্ষেপ না থাকলেও মন্ত্রী হওয়ার অপুর্নতা ছিল রাজনৈতিক এ পরিবারে। এবার নওফেল মন্ত্রী হওয়ায় সেটিও পুরন হলো। মহিউদ্দিন পুত্র নওফেল উপমন্ত্রী হওয়ায় খুশি চট্টগ্রামের রাজনৈতিক নেতারাও।

নগর আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক ও সিটি মেয়র আ.জ.ম নাছির উদ্দিন বলেন, নওফেলকে মন্ত্রী করায় আমরা খুশি। এটা চট্টগ্রামবাসীর জন্য আনন্দের খবর। বাকি যারাই মন্ত্রী হয়েছেন তাদেরকে আমি আমি অভিনন্দন জানাচ্ছি। এটা চট্টগ্রামের জন্য অত্যন্ত গৌরবের। আশাকরি সরকারের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তারা চট্টগ্রামের উন্নয়নেও ভুমিকা রাখবেন। নগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি খোরশেদ আলম সুজন বলেন, আমরা খুবই খুশি। মহিউদ্দিন চৌধুরীর ছেলে হিসেবে তো বটেই আমরাও চট্টগ্রামবাসী হিসেবে একজন মন্ত্রী পেয়েছি। প্রধানমন্ত্রী উচ্চশিক্ষিত, রুচিবান, সংস্কৃতিবান, অসাম্প্রদায়িক একজন ব্যক্তিকে মন্ত্রী করেছেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস নওফেল শিক্ষাক্ষেত্রে অবদান রাখবেন। প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষাবান্ধব কর্মসুচী বাস্তবায়ন করবেন। দেশের অশিক্ষা দূর করতে ভুমিকা রাখবেন’।

বিগত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রামের ১৬টি আসনের মধ্যে একমাত্র কোতোয়ালী আসনেই প্রার্থী পরিবর্তন করা হয়। এ আসনে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুর পরিবর্তে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দেয়া হয় ব্যারিস্টার নওফেলকে। নৌকা প্রতীকের প্রার্থী হিসেবে প্রচারনার শুরতেই সাধারন মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নেন মহিউদ্দিন পুত্র নওফেল। নগরীতে মহিউদ্দিন ভক্তরা সবাই মাঠে নেমে আসেন নওফেলের পক্ষে। তার পক্ষে প্রচার প্রচারনায় নামেন সমাজের বিভিন্ন শ্রেনী পেশার মানুষ ও সংগঠন। গত ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিপুল ভোটে বিএনপি প্রার্থী নগর বিএনপির সভাপতি ডা. শাহাদাত হোসেনকে পরাজিত করে সংসদ সদস্য হন নওফেল।

প্রসঙ্গত, ১৯৮৩ সালের ২৬ জুন চট্টগ্রামে জন্মগ্রহন করেন ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। ২০১০ সালে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বাবা মহিউদ্দিনের পক্ষে নির্বাচনি প্রচারনায় অংশ নিয়েই রাজনীতিতে নামার ইংগিত দিয়েছিলেন তিনি। অত্যন্ত মেধাবী নওফেল লন্ডন স্কুল অব ইকনোমিক্স থেকে স্নাতক পাস ও বার এট ল ডিগ্রি অর্জন করেন। বর্তমানে তিনি ঢাকা বারের একজন সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

এদিকে এবারও কোতোয়ালী আসনের ঐতিহ্যের ধারা রক্ষা হল। ১৯৯১ সাল থেকে এ আসনে যেসব প্রার্থী জয়লাভ করেছেন, সেই দলই সরকার গঠন করেছে এবং সেই এমপি মন্ত্রীত্ব পেয়েছেন। এবারও এর ব্যতিক্রম হল না। এবার আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বিএনপি প্রার্থীকে পরাজিত করে পেয়েছেন মন্ত্রীত্ব।

২০০৮ সালে এ আসনে নির্বাচিত হয়ে প্রবাসী কল্যান মন্ত্রী হন নুরুল ইসলাম বিএসসি। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে এ আসনে জয়লাভ করেন বিএনপি নেতা আবদুল্লাহ আল নোমান। তখন বিএনপি সরকার গঠন করলে তিনি মন্ত্রী হন। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে এ আসনে আওয়ামী লীগের এম.এ মান্নান জয়লাভ করেন। তখন আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে তিনি মন্ত্রী হন। ২০০১ সালের নির্বাচনে এ আসনে আবারও জয়লাভ করেন আবদল্লাহ আল নোমান । তখন বিএনপি সরকার গঠন করলে তিনি মন্ত্রী হন। ২০০৮ সালে জয়লাভ করেন আওয়ামী লীগের নুরুল ইসলাম বিএসসি। আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলেও তাকে মন্ত্রীত্ব দেওয়া হয়নি। ২০১৪ সালে আসনটি জাতিয় পার্টির জিয়াউদ্দিন বাবলুকে ছেড়ে দেওয়া হলে তিনি জয়লাভ করে মন্ত্রী হন। মহাজোট ক্ষমতায় যায়। তখন টেকনোক্রেট কোটায় নুরুল ইসলাম বিএসসিকে প্রবাসী কল্যান মন্ত্রী করা হয়।

এদিকে মহিউদ্দিন পুত্র নওফেলের মন্ত্রীত্ব পাওয়ায় চট্টগ্রামের ৪১টি ওয়ার্ড ও ১৬টি থানা এলাকায় ভক্তদের মধ্যে আনন্দ ছড়িয়ে পড়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও উল্লাস প্রকাশ করছে তারা। চট্টগ্রামের রাজনীতি নিয়ে অভিজ্ঞ মহলের মতে, মহিউদ্দিন চৌধুরীর শুন্যতা পূরনে নওফেলের উপর প্রত্যাশা থেকে জাগরন ঘটেছে। বলা যায় চট্টগ্রামের নগর রাজনীতিতে এটি সঞ্জিবনী সুধার মত কাজ করেছে। নি:সন্দেহে এটি আওয়ামী লীগের ভীত মজবুত করার ক্ষেত্রে দারুন ভুমিকা রাখবে।

চট্টগ্রামের গনমানুষের নেতা প্রয়াত মেয়র আলহাজ্ব এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী আজকের সুর্যোদয়ের প্রতি অনুরাগ ছিল খুব বেশি। তাঁর অসংখ্য সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছে আজকের সুর্যোদয়ে। এ পত্রিকার প্রধান সম্পাদক গেদুচাচা খ্যাত কলামিষ্ট বীর মুক্তিযোদ্ধা খোন্দকার মোজাম্মেল হকের সঙ্গে ছিল দারুন সুসম্পর্ক। প্রায় প্রতি বছর বিজয় মেলায় তাকে আমন্ত্রিত অতিথি করে আনতেন। দু:সময়ে আজকের সুর্যোদয়ের প্রতি তাঁর সহযোগিতার কথা আমরা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করি। একই সঙ্গে বীর মুক্তিযোদ্ধা মহিউদ্দিন পুত্র ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল শিক্ষা উপ-মন্ত্রী হওয়ায় আমাদের অভিনন্দন জানাই। আশা করি, তিনি যোগ্য পিতার মত যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হবেন। আল্লাহ সহায়।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.