চট্টগ্রামে ইউপি নির্বাচনের পোষ্টমর্টেম

জুবায়ের সিদ্দিকী  – 

চট্টগ্রাম উত্তর জেলা ও দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের ও এমনকি কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের কোন কোন নেতার মনোনয়ন বানিজ্য এখন আলোচিত হচ্ছে ব্যাপকভাবে বৃহত্তর চট্টগ্রামে। জেলার বেশ কয়েকটি উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে তৃনমুলের মতামতকে উপেক্ষা করে মনোনয়ন বানিজ্যের মাধ্যমে দলীয় মনোনয়ন দেওয়ায় চট্টগ্রাম মহানগরীর দক্ষিণ জেলা কার্যালয়ে হামলা ও ভাংচুর হয়েছে। মনোনয়ন প্রক্রিয়ার শুরু করে এই অভিযোগ। তবে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপের নির্বাচনে তৃনমুলের এই মনোনয়ন বানিজ্যের অভিযোগ কর্নপাত না করলেও চতুর্থধাপ থেকে অভিযোগের পাহাড় জমতে থাকায় যাছাই বাছাই শুরু করেছে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড।

ঘটনার সত্যতা মিললে সাংগঠনিক পদ হারাতে পারেন সংশ্লিষ্টরা। এর পাশাপাশি দলের কাঠগড়াও দাঁড়াতে হবে তাকে। তৃনমুল থেকে আসা অসংখ্য অভিযোগ প্রায় প্রতিদিনই জমা পড়ছে ধানমন্ডীর সভাপতির কার্যালয়ে। বিভিন্ন সুত্রে জানা গেছে, নৌকা প্রতীকে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী বাছাইয়ে চলছে টাকার খেলা। সবার ধারনা, ছলে বলে কৌশলে নৌকাতে উঠতে পারলেই দরিয়া পার! নৌকা প্রতীক মানেই যেন বিজয়ের মালা গলা পড়া। এ কারনে নৌকা প্রতীক পেতে প্রার্থীরা যেন মরিয়া হয়ে উঠেছেন।এমন প্রতিযোগিতার সুযোগ নিয়েই চলছে, রমরমা মনোনয়ন বানিজ্য। কোন প্রার্থী কত টাকায় টিকেট পেলেন তা এখন সবার মুখে মুখে সারাদেশের মত চট্টগ্রামেও।

চট্টগ্রামে গ্রামে গঞ্জে তৃনমুলের এখন স্লোগান হচ্ছে ’টাকার দালালী করিস না, যারে তারে নৌকা দিস না, নতুন কোন ব্যবসা ধর, মনোনয়ন বানিজ্য বন্ধ কর। এই প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন,’ এমন অভিযোগ একদম অসত্য নয়। এসব ব্যাপারে যাছাই বাছাই হচ্ছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, চট্টগ্রামে প্রার্থী প্রতি ১০ লাখ থেকে কোটি টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগে বেশ কয়েকজন এমপি, জেলা ও উপজেলা নেতার বিরুদ্ধে। এই চিত্র সারাদেশে। ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে ত্যাগী, দলের প্রতি নিবেদিত নেতাদের বাদ দিয়ে মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে অন্যদের মনোনয়ন দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। এমন অভিযোগ পেয়ে রিতিমত বিস্মিত কেন্দ্রীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। কোন কোন কেন্দ্রীয় নেতাও এই মনোনয়ন বানিজ্যের সঙ্গে সম্প্রতি জড়িয়ে পড়েছেন বলে একাধিক সুত্রে জানা গেছে।

কোথাও কোথাও বিশেষ সিন্ডিকেট তৈরী করে নেতারা মনোনয়ন বানিজ্যের অর্থ ভাগ ভাটোয়ারা করে নিচ্ছেন। আবার কেও কেও একক কর্তৃত্ব বলেই মনোনয়ন বানিজ্য নিয়ন্ত্রন করছেন। মনোনয়ন বানিজ্যের অর্থ পকেট পুরেছেন অনেক প্রভাবশালী মন্ত্রীও। এ কারনে অনেক ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতা মনোনয়ন প্রত্যাশী হলেও অর্থের কাছে তারা হেরে যাচ্ছেন। আবার অনেকেই বিদ্রোহী হয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। বিতর্কিত, সদ্য বিএনপি জামায়াত থেকে যোগ দেওয়া আওয়ামী নামধারীদেরও অর্থের বিনিময়ে নৌকা প্রতীক দেওয়া হচ্ছে। এর ফলে মনোনয়ন বঞ্চিত আওয়ামী লীগের অনেক নেতা মানববন্ধন ও সংবাদ সম্মেলন করে সঠিক চিত্র তুলে ধরেছেন। নির্বাচন কমিশন ও পুলিশ প্রশাসন নির্বাচনি আচরনবিধি অমান্য করার অভিযোগও আমলে নিচ্ছেন না। সংঘর্ষ চলছে নানা স্থানে। গ্রুপিং কোন্দল বাড়ছে।

চট্টগ্রামের অনেক নির্বাচনী এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, নৌকা প্রতীক যিনি পেয়েছেন তিনি ভোটের আগেই চেয়ারম্যান হয়ে গেছেন! এরা এখন ডেমকেয়ার মনোভাব নিয়ে লোক দেখানো গনসংযোগ করছেন। বেশিরভাগ ইউপিতে শক্ত কোন প্রতিদ্বন্ধি না থাকায় ভোটের কোন উৎসব বা আমেজ নেই। সারাদেশের মত চট্টগ্রামের চিত্র ভয়াবহ। নৌকা বরাদ্ধের পর চেয়ারম্যান প্রার্থীরা প্রতিপক্ষ মানুষ বলেই গন্য করছেনা। পেশি শক্তির মহড়ায় উত্তপ্ত পরিবেশে বিরাজ করছে নির্বাচনি এলাকাগুলোতে। চট্টগ্রামে গ্রুপিং, কোন্দল, দলাদলি বাড়ছে ক্ষমতাসীনদলে ইউপি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। এদিকে উপেক্ষার যন্ত্রনায় বিদ্ধ আওয়ামী লীগের অনেক তৃনমুল নেতা। ক্ষমতাসীন দলের তৃনমুলের সুপারিশ করা প্রার্থী কেন্দ্রে এসে বদলে যাচ্ছে। মন্ত্রী এমপি, প্রভাবশালী নেতা ও পাতি নেতাদের হস্তক্ষেপে ত্যাগী ও জনপ্রিয়দের বদলে দলীয় মনোনয়ন বাগিয়ে নিচ্ছেন বিতর্কিত প্রার্থীরা। নামেই তৃনমুল, বলা হলেও চট্টগ্রামে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা গেছে, টাকার খেলা, তদবির ও নেতাদের স্বজনপ্রীতির ঘটনা।

ফটিকছড়িতে জাফতনগর ইউনিয়নে এই ধরনের অনিয়ম হলেও অভিযোগ করা হলেও দলীয় হাইকমান্ড কোন ব্যবস্থা নেয়নি। আগের চেয়ারম্যানকে আবার মনোনয়ন দেওয়া হলেও অসন্তোষ রয়েছে নেতাকর্মীদের মধ্যে। এ ধরনের প্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ বিভক্ত হয়ে পড়েছে চেয়ারম্যান প্রার্থী নির্ধারনকে কেন্দ্র করে। ঢাকায় বসে অনেকে নাটাই ঘুরিয়েছেন টাকার খেলায়। এতে করে বঞ্চিত ও ত্যাগীরা ক্ষোভে ফুঁসছে। এর প্রভাব পড়বে দলীয় কার্যক্রমে। এসব ঘটনায় দল থেকে পদত্যাগ ও নিস্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন অনেকে। নির্বাচনের আগে পকেট কমিটি করে নেতাদের বাগিয়ে ও অর্থের বিনিময়ে দক্ষিন ও উত্তর চট্টগ্রামে অনেকে চেয়ারম্যান হয়েছেন এবং অনেকে প্রার্থী হচ্ছেন।

এদিকে অস্বস্থিতে আছেন আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড। এমপি, মন্ত্রী ও শীর্ষনেতাদের ক্ষমতার অপব্যবহার, পেশিশক্তির মহড়া, টাকার খেলা, স্বজনপ্রীতি সহ নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ায় ক্ষমতাসীন দলের ভাবমুর্তির বারটা বাজছে সাধারন মানুষের কাছে। দলীয় সুনাম নষ্টোর পাশাপাশি সাধারন মানুষের কাছে সরকারের জনপ্রিয়তা ও ভাবমুর্তি ক্ষতি হচ্ছে। হাইব্রীড় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীগন ও জামাত শিবির সহ বিএনপি থেকে আসা দলবদলের সুবিধাবাদী নেতারা ব্যস্ত আখেরগুছাতে এবং এদের বলয় থেকে প্রার্থী হচ্ছে সুবিধাবাদী সুযোগসন্ধানী নেতারা। মদদ জোগাচ্ছে কতিপয় হালুয়া রুটির ভক্ষনকারী শীর্ষ নেতারা। ফটিকছড়ির এক আওয়ামী লীগ নেতা জানান, ’টাকার কাছে ত্যাগ, শ্রম, মেধা ও দলীয় ভাবমুর্তি হেরে গেছে। সত্যিকার অর্থে যাদের ত্যাগ তীতিক্ষা ও অদান রয়েছে দলের জন্য তাদের বেশিরভাগ নেতা যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও সুযোগ পাননি প্রার্থী হতে। হাইব্রীড়দের ভীড়ে ও অর্থের ঠেলায় ছিটকে পড়েছেন প্রার্থীর তালিকা হতে। রাঙ্গুনিয়ার একজন আওয়ামী লীগ নেতা বললেন, ত্যাগীদের নয়, জামাত বিএনপির ও সুবিধাবাধী চামচাদের মুল্যায়ন হয়েছে চট্টগ্রামে।

এতে করে ছড়িয়ে পড়েছে ক্ষোভ, হতাশা। তৃনমুলের নেতাদের বারবার বঞ্চিত হওয়াতে দলীয় কর্মকান্ড থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে নেতাকর্মীরা। যারা এমপি মন্ত্রীর চামচামি ও চাটুকারের রাজনীতি করে অবৈধ অর্থের পাহাড় গড়েছেন তাদেরই হয়েছে জয়জয়কার। এখন যদি আওয়ামী লীগ হাইকমান্ড এ ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ না নেয় তবে আশাহত ও বেদনাহত হবে তৃনমুলের ত্যাগী নেতাকর্মীগন। তাদের মুল্যায়ন দলের জন্য অত্যন্ত জরুরী। যাদের শরীরের রক্ত ঝরেছে দলের জন্য, ভিটেমাটি ছাড়া হয়ে ফেরারী হয়েছেন, দেশান্তরী হয়েছেন দলের জন্য। তাদের মুল্যায়ন কি এই সরকারের শেষ বছরগুলোতে? গেল সপ্তাহে ২৩ শে এপ্রিল হয়ে গেল চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে ভোটযুদ্ধ! ১৪টি ইউনিয়নের প্রায় সব কটিতেই হয়েছে অনিয়ম। সকাল এগারটায় ১৭নং জাফতনগর ইউপির স্বতন্ত্র প্রার্থী সোলায়মান জানান, ’নৌকা প্রতীকের লোকজন রাতেই অনেক কেন্দ্রে সিলমেরে বাক্সভর্তি করেছে।

তিনি বলেন,আমার স্ত্রীর হাত থেকে ব্যালট পেপার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ক্যাডার বাহিনী নিয়ন্ত্রন করেছে ভোটকেন্দ্র। কর্তব্যরত কর্মকর্তাদের কাছে বার বার অনিয়মের অভিযোগ করা হলেও কোন ফলোদয় হয়নি। তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সামনেই প্রকাশ্যে নৌকায় সিল মেরে বাক্সে ফেলতে বাধ্য করা হয়েছে ভোটারদের। এভাবেই হযবরল অবস্থায় ভোটযুদ্ধ হয়েছে ফটিকছড়িতে। পেশিশক্তির মহড়ায় তারা লোহালক্কর নিয়ে ছুটোছুটি করে আতংকসৃষ্টিতে ছিল ক্ষমতাসীন দলের সীমাহীন তাফালিং।

জোর যার মুল্লুক তার-এ ভাবেই ভোটযুদ্ধ প্রহসনে পরিনত হয়েছে ভোটারদের কাছে। জাহানপুরের একজন ভোটার বলেন,’ এটা কি ভোট? না প্রহসন। ভোট কেন্দ্রে প্রবেশ করার পর নৌকায় সিল মারা ব্যালটপেপার আমার হাতে দেওয়া হল বাক্সে ফেলার জন্য। ইউপি নির্বাচনের শুরু থেকে মনোনয়ন বানিজ্য ও ভোটের দিন মঘের মুল্লুক গড়ে তুলে অস্বস্থিকর এক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এ চিত্র সাধারন মানুষের কাছে গ্রহনযোগ্য নয়। মানুষ এই দৃশ্য দেখতে চায় না।

এ বিভাগের আরও খবর

Comments are closed.