চট্টগ্রাম টেলিভিশন কেন্দ্রে বিএনপি-জামায়াত সিন্ডিকেট

জুবায়ের সিদ্দিকী – 

সিটিভি নামে পরিচিত বাংলাদেশ টেলিভিশনের চট্টগ্রাম কেন্দ্রকে ছয় ঘন্টার স¤প্রচার নিয়ে যাওয়ার ঘোষনা দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অগ্রাধিকার প্রকল্প হিসেবে সেই প্রতিশ্র“তি বাস্তবায়নের কর্মকান্ডের যখন সকল প্রস্তুতি চলছে তা ঠেকাতে একটি মহল উঠেপড়ে নেমেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। বর্তমান জিএমকে সরিয়ে নতুন একজনকে চলতি দায়িত্ব দেওয়া হলেও কেন্দ্রের রেকডিং বন্ধ। কেন্টিন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বিএনপি-জামাত জোট সরকারের আমলের বহুল আলোচিত হাওয়া ভবন ঘনিষ্ট কিছু কর্মকর্তা সিটিভিতে বসে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষনা যাতে বাস্তবায়ন না হয় সেই চেষ্টা করছেন। এক সময়ে হাওয়া ভবনের নাম ভাঙ্গিয়ে দোর্দন্ড প্রতাপে চলা এসব কর্মকর্তা সিটিভিকে নিজেদের নিয়ন্ত্রনে নিতে চায়। এ জন্য নিউ ইনচার্জ নুরুল আজম পবন, উর্দ্ধতন শিল্প নির্দেশক মাসুদুর রহমান কাজল এবং উর্দ্ধতন চিত্রগ্রাহক এম. আসাদুজ্জামান মিঠুর নেতৃত্বে ওই সিন্ডিকেট বর্তমানে প্রধান গেইটে তালা মেরে তাদের কর্তৃত্ব বজায় রেখেছে। বিএনপি জামায়াত ঘনিষ্ট এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে তালিকাভুক্ত সাধারন শিল্পী এবং পরিচালকদেরও।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, এসব কর্মকর্তা তিনবছর থাকার কথা থাকলেও এরা বহাল তবিয়তে আছে ৫-৭ বছর যাবত। জিএম বদল হওয়ার সাথে সাথে মোস্তাফিজ নামের একজনকে বদলী করা হয় টিএন্ডটিতে। যিনি এই বদলী করেছেন তিনি এভাবে বদলী করতে না পারলেও করেছেন। প্রকৌশলী জামিল এই কাজটি করলেও স্বাভাবিক ভাবে বদলীর প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় ঢাকায়। ছয় ঘন্টার স¤প্রসারনে ৮৩ জন লোক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এদেরকে এখন হুমকি দেওয়া হচ্ছে। জিএম জা. নেসার ওসমানকে মাত্র ৬ মাসের মাথায় সুপরিকল্পিতভাবে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রোগাম ম্যানেজার (পিএম) মনোজ সেনগুপ্তকে জিএম’এর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। মনোজ সেনগুপ্তকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে তিনি জানান, আমি দায়িত্ব নিয়েছি। বিএনপি জামায়াত চক্র সিটিভিতে তৎপর বিষয়টি তার জানা নেই। অভিযোগ রয়েছে, শাস্তিমুলক বদলী হয়ে আসা এই চক্রটি দীর্ঘদিন যাবত জিএম ওসমানকে সরিয়ে দেওয়ার চক্রান্ত করলে সফল হয়েছে। এখন দাপটের সাথে জাতীয়তাবাদী চক্রটি সরকারের ভাবমুর্তি বিনষ্ট করতে সকল অপকর্ম করে যাচ্ছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শিল্পী জানান, একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট আছে যারা চায়না সিটিভি ছয় ঘন্টার স¤প্রচারে যাক। শিল্পীদেরও একটা অংশ আছে যারা একসময় সিটিভিকে কুক্ষিগত করে রেখেছিল। ৫-৬ জন শিল্পী পুরো মাসের অনুষ্টান নিয়ন্ত্রন করত। জিএম ওসমান এসে দেড়শ শিল্পীকে সুযোগ করে দিয়েছেন। এ জন্য আগের শিল্পীরা এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন। একজন পরিচালক জানান, সিটিভির ভিতরে কিছু কর্মকর্তা ও বাহিরের কিছু শিল্পী আছেন তারা চান না ছয় ঘন্টার স¤প্রচার হোক। কারন এতে তাদের প্রভাব কমে যেতে পারে। আগে সিটিভিতে অনুষ্টান করতে গেলে ঘাটে ঘাটে টাকা দিতে হত। এখন টাকা দিতে হয় না। এই উপরী আয় কমে যাওয়াতে অনেকে জোট বেঁধেছেন সিন্ডিকেটের সঙ্গে। এর নেপথ্যে কারা আছে তার তদন্ত প্রয়োজন।

একজন স্ঙ্গীত শিল্পী বলেন, সিটিভি একসময় একটা নষ্ট চ্যানেল ছিল। আমরা গান করলেও নিজেরাই সিটিভিতে দেখতাম না। এটার মান খুব খারাপ ছিল। আগে মান বিচার করে শিল্পী নেওয়া হয়নি। একই শিল্পীকে প্রতিদিন প্রোগ্রাম দেওয়া হত। জিএম ওসমান সাহেব এসে সেই সুযোগ দেননি। প্রোগ্রামের মান বেড়েছিল। আগের শিল্পীরা যখন আর প্রতিদিন প্রোগ্রাম পাচ্ছেন না তখন বিভিন্ন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। দালালচক্র ও মুখোশধারী লোকজন অবশ্য এখনও সিটিভিতে কর্মরত আছে। অভিযোগ রয়েছে, বিএনপি জামায়াত জোট সরকারের আমলে হাওয়া ভবনে তারেক রহমানের নাম ভাঙ্গিয়ে সাংবাদিক হিসেবে পরিচিত নুরুল আজম পবনকে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সিটিভিতে বদলী করা হয়। উর্দ্ধতন শিল্প নির্দেশক মাসুদুর রহমান কাজল জোট সরকার আমলে তারেকের বন্ধু গিয়াস আল মামুনের সুপারিশে বিটিভিতে নিয়োগ পেয়েছিলেন বলে জানা যায়।

মির্জা আব্বাসের ঘনিষ্টজন এম. আসাদুজ্জামান মিঠু সাবেক মন্ত্রী আমানুল্লাহ আমানের সুপারিশে বিটিভিতে নিয়োগ পেয়েছিলেন। সরকার পরিবর্তনের পর তাদেরকে বিটিভি থেকে বদলী করে সিটিভিতে পাঠানো হয়। দীর্ঘদিন ধরে সিটিভিতে অবস্থান করে পবন, কাজল, মিঠু ভোল পাল্টে নিজেদের বলয় তৈরী করেন। কৌশলে এক সময়ের রাজনৈতিক পরিচয় মুছে তারা সিটিভিতে দাপটই সৃষ্টি করেছেন। পবন অবশ্য সাংবাদিকদের বলেছেন, আমি ২৩ বছর ধরে সরকারী কর্মকর্তা। আমার কোন রাজনৈতিক পরিচয় নেই। তারপরও আমাকে বিএনপি জামায়াত বানানো হাস্যকর। এই পবন কিছুদিন সিটিভিতে প্রোগ্রাম ম্যানেজারের দায়িত্বও পালন করেন। পরবর্তীতে শিল্পীদের সাথে দুর্ব্যবহারের অভিযোগ উঠলে তাকে সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। শিল্পী ও প্রযোজকদের মধ্যে আলোচনা আছে, পবন এখন জিএম হতে মন্ত্রনালয়ে তদবির করছেন। পবন অবশ্য বলেছেন, এসব ফালতু অভিযোগ। চিত্রগ্রাহক মিঠুর বিরুদ্ধে অভিযোগ যান্ত্রিক ত্র“টির অভিযোগে ক্যামেরা আটকে রেখে শিল্পীদের হয়রানী করেন। অনুষ্টানে আসা শিল্পীদের তিনি ঘন্টার পর ঘন্টা বসিয়ে রাখেন। স¤প্রতি ২১টি গান রেকডিং এর জন্য তারকা শিল্পী সন্দিপনকে সিটিভিতে নেওয়া হয়। চার ঘণ্টা বসে থাকার পর বিরক্ত হয়ে সন্দিপন চলে যান। মিঠুর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি সিটিভির ভিতরে পিস্তল নিয়ে ঘুরেন এবং লোকজনকে হুমকি দেন। এই ঘটনার পর তার বিরুদ্ধে থানায় ডায়রীও হয়েছিল। তবে মিঠু বলেছেন, আমার পিস্তল ছিল লাইসেন্স করা এবং সেটা থানায় জমা দিয়েছি। মিঠু সাংবাদিকদের জানান, তাকে পলিটিক্যাল ক্লেইম দিয়ে এখানে পাঠানো হয়েছে। যদিও আমাকে ফাঁসানো হয়েছে, তবে আমি বিএনপি করিনা। এখন আমি এখানে পিএইডি করার সুযোগ পেয়েছি।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, সিটিভিতে ১২ জনকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়। এরাও এখন আসে যায় কোন বাধা ছাড়াই। কয়েক সপ্তাহ আগে জিএম ওসমান নতুন জিএমকে দায়িত্ব নেওয়ার আনুষ্টানিকতা করার সময় বহিরাগত লোকজন এসে হৈ চৈ শুরু করে দেয়। এ সময় জিএম ওসমানকে নানাভাবে হেয় করার চেষ্টা করা হয়। সিটিভির সবকিছুতে চলছে অনিয়ম ও ক্ষমতার অপব্যবহারের দাপট। সাধারন শিল্পীদের অভিযোগ, বহুদিনের খায়েস ওদের পুর্ন হয়েছে। লুটেপুটে খাওয়া কর্মকর্তারা এখন আবার ফিরে আসছে। এদের মদদ যোগায় যারা তারাই সরকারের বারোটা বাজাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সরকার ক্ষমতায় অথচ বিএনপি-জামায়াত জোটের দাপট ও ক্ষমতার অপব্যবহার করছে সিটিভির মত একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্টানে। অবাক হতে হয়, এদের এত সাহস এলো কোথায় থেকে। ক্ষমতার দ্বিতীয় মেয়াদে এসে সরকার কি ঝিমিয়ে পড়েছে? হাওয়া ভবনের রাজত্ব কিভাবে চলে সিটিভিতে। এসব দেখার কেউ নেউ? এভাবেই কি চলতে থাকবে বিএনপি-জামাত জোট আদর্শের কমকর্তাদের রাজত্ব!

সিটিভি একটি শাস্তিমুলক কেন্দ্র হিসেবে কর্মকর্তা কর্মচারীদের কাছে পরিচিত। বিটিভিতে কোন কর্মকর্তা-কর্মচারী দুর্নীতি, কর্তব্যে অবহেলা, অসদাচরনের দায়ে অভিযুক্ত হলে তাদের শাস্তিমুলক হিসেবে বদলী করা হয় সিটিভিতে। বিটিভি থেকে আসা এসব বিএনপি-জামাত সমর্থিত কর্মকর্তারা এখন সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে সিটিভিতে। দেশের বেসরকারী চ্যানেলগুলো যেখানে ২০ থেকে ৫০ জন জনবল নিয়ে ছোট ছোট ষ্টুডিং দর্শকদের প্রশংসা কুড়াচ্ছে সেখানে ১০৯জন ’অকর্মন্য’ কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়ে এই কেন্দ্রটি বার বার মুখ থুবড়ে পড়ছে। মানহীন অনুষ্টান নির্মান, চিত্রধারন, সংবাদ পরিবেশন বিভাগের চরম অবহেলা এবং প্রশাসনিক আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় বিগত ১৯ বছর যাবত এই কেন্দ্রটি শত কোটি টাকার মত অপচয় ও লুটপাট করা হয়েছে। সিটিভিতে যারা কর্মরত আছে, ডিজাইনার। কিন্তু গ্রাফিকসের কাজ জানেন না। যারা প্রকৌশলী বিভাগের কর্মচারী তারা যান্ত্রিক কাজ জানেন না। যারা চিত্রগ্রাহক বিভাগের কর্মচারী তারা ক্যামেরা ও আলোকসজ্জার কাজ জানেন না। অনুষ্টান ধারনের জন্য ৬টি প্যানেল থাকলেও প্যানেলের দায়িত্বে যারা তাদের অনেকেই এডিটিংএর কাজ জানেন না। সিটিভিতে সারাবছর একটি প্যানেল অব্যবহুত থেকে যায়। অনুষ্টান স¤প্রচারের জন্য যারা দায়িত্বে থাকেন তারা অনভিজ্ঞ। তাদের সময়জ্ঞান পর্যন্ত নেই। দেখা যায় যে, শীতকালে ধারনকৃত অনুষ্টান গৃষ্মকালে এবং গৃষ্মকালে ধারনকৃত অনুষ্টান প্রচার হয় শিতের সময়। শব্দ নিয়ন্ত্রনের কোন যথাযথ ব্যবহার নেই। স¤প্রচারের সময় সাউন্ডের ক্রুটি প্রতিনিয়ত লক্ষ্য করা যায়। জামায়াত বিএনপির সিন্ডিকেট অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে এই অনিয়মগুলো করে আসছে।

সিটিভিতে বর্তমানে ৩টি ষ্টুডিও, ২টি প্যানেল বোর্ড, একটি আর্থ ষ্টেশন, অনুষ্টান, সংবাদ ও দৃশ্য ধারনের জন্য অত্যাধুনিক ১৩টি ক্যামেরা রয়েছে। এতসব সুবিধা থাকার পরও জামায়াত বিএনপির কর্মচারীদের চক্রান্তের কারনে এই কেন্দ্রটি এ অঞ্চলের শিল্পী, কলাকৌশলী, বুদ্ধিজীবি, সুশীল সমাজ ও জনগনের প্রানের বিনোদন কেন্দ্র হিসাবে গড়ে উঠতে পারেনি। কিছু স্বার্থান্বেষী মহল প্রতিবারই নিজেদের ভাগ ভাটোয়ারা লুটপাঠের মাধ্যমের কুক্ষিগত করে রাখার জন্য এটিকে ব্যবহার করছে। সিটিভির সংরক্ষিত এলাকার ভেতর ষ্টাফ কোয়ার্টার বরাদ্দ করা ব্যাচেলর কোয়ার্টারে বছরের পর বছর ধরে তারা পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন। জিএম বদল সহ নানা প্রক্রিয়াতে থমকে আছে সিটিভির সকল কর্মকান্ড। মাত্র ৬ মাসের মাথায় জিএমকে চক্রান্ত করে সরিয়ে দেওয়ার ঘটনাও ক্ষোভের সঞ্চার করেছে সাধারন কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের মধ্যে। জামায়াত-বিএনপি চক্র এখন ভোল পাল্টে আওয়ামী লীগের কিছু সুবিধাবাদী নেতাকর্মীর মদদে অপকর্ম চলছে। এসব মুখোশধারীদের ইশারায় ক্ষত বিক্ষত হচ্ছে রাষ্ট্রিয় সম্পদ।

এ বিভাগের আরও খবর

Comments are closed.