জুবায়ের সিদ্দিকী –
ঘুর্নিঝড় রোয়ানুর তান্ডবে ক্ষতিগ্রস্ত বাঁশখালী আনোয়ারা চকরিয়া সীতাকুন্ড ও সন্দ্বীপ উপকুলীয় এলাকায় মানবিক বিপর্যয় নেমে এসেছে। ভিটে আছে বাড়ি নেই। খোলা আকাশের নিচে শত শত পরিবার। ঘুর্নিঝড়ের পর থেকে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোতে তিন দিনেও ত্রান পৌছেনি। নেই খাবার, নেই থাকার ব্যবস্থা, নেই নিরাপত্তা। কেউ কেউ আত্বীয় স্বজনের বাড়িতে আবার অনেকেই নিরুপায় হয়ে মশা মাছির উৎপাত আর জোয়ারের আতঙ্কে নির্ঘূম রাত কাটাচ্ছেন। সরকারীভাবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমান এখনও নির্ধারন করা না হলেও স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সংশ্লিষ্ট সুত্রে পাওয়া গেছে বিভিন্ন তথ্য। সুত্রমতে ঘুর্নিঝড় রোয়ানু দিনের বেলায় আঘাত হানায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমান কম হয়েছে। আর নতুন করে বেড়িবাঁধ নির্মান ও ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধ সংস্কার না হওয়ায় অরক্ষিত থাকার কারনে সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি ও প্রানহানী ঘটেছে। ঘুর্নিঝড়ে বসতবাড়ি, লবন চাষ ও চিংড়ি ঘের সফল ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাঁশখালীতে উপকুলীয় খানখানাবাদ ইউনিয়ন, ছনুয়া ইউনিয়ন, গন্ডামারা ইউনিয়ন, সাধনপুর ইউনিয়নের পশ্চিম বৈলগাঁও গ্রাম ও পুকুরিয়া ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বিলিন হয়ে গেছে এসব এলাকার অর্ধ লক্ষাধিক বাড়িঘর। ঘুর্নিঝড়ে বাঁশখালীর খানখানাবাদে ৬ জন, ছনুয়ায় ১জন এবং গন্ডামারায় ২জন নিহত হন।
বিশেষ করে বাঁশখালীর খানখানাবাদ, ছনুয়া ও গন্ডামারা এলাকায় ব্যাপক বাড়িঘর বিধ্বস্ত হওয়ার পাশাপাশি গরু ছাগল হাস মুরগি ব্যাপকভাবে মারা পড়ে। বাঁশখালীতে লবন মাঠ, চিংড়ি ঘের, ফসলী জমিসহ ক্ষতির পরিমান শত কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে জানা গেছে। অপরদিকে বাঁশখালীর খানখানাবাদ এলাকায় রোহানু আক্রান্ত পরিবারগুলোতে মানবিক বিপর্যয় সবচেয়ে চোখে পড়ার মত। ওই এলাকার প্রেমাশিয়া, রাইছটা, রোসাঙ্গিরী পাড়া সহ খানখানাবাদের কয়েকশ বাড়িঘর বিলিন হয়ে গেছে। ঘুনিঝড়ের পরদিন দুর্যোগ ব্যবস্থা ও ত্রান মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, গৃহায়ন ও গনপুর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশারফ হোসেন, অর্থ ও পানি সম্পদ মন্ত্রনালয়ের স্থায়ী কমিটির সদস্য সাংসদ মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ব্যুরোর মহাপরিচালক রিয়াজ আহমদ, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মেজবাহ উদ্দিন সহ প্রশাসনের উর্দ্ধতন কর্মকর্তারা উপকুলীয় খানখানাবাদ এলাকা পরিদর্শন করেন। এ সময় নিহত পরিবারদের মাঝে নগদ টাকা এবং চাউল প্রদান করেন। অপরদিকে আনোয়ারা উপজেলার রায়পুর ইউনিয়নের মালিপাড়া, বার আউলিয়া, তেলিপাড়া, গোলামরসুল এলাকাজুড়ে চলছে পানির জন্য হাহাকার। এই ইউনিয়নের ৪৫ হাজার মানুষ মানবিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। সব হারিয়ে তারা যেমন আশ্রয়হীন তেমনি পড়েছে খাবার ও পানি সংকটে। চারপাশে পানিতে ডুবে থাকলেও খাবার পানি নেই। প্রচন্ড লবনপানি মুখে দেয়া যাচ্ছে না।
এদিকে বেড়িবাঁধের আশায় দিন যায় উপকুলবাসীর, কিন্তু তাদের সে আশা পুরন হয় না। ১৯৯১ সালের প্রলয়ংকরী ঘুর্নিঝড়ের পর থেকে স্থায়ী বেড়িবাঁধ দাবী করে আসছে উপকুলবাসী। দুর্যোগ আসলে এ দাবী জোরালো হয়। তারপর ঝিমিয়ে পড়ে। ১৯৯১ থেকে ২০১৬সাল। দীর্ঘ ২৫ বছরেও স্থায়ী বেড়িবাঁধ না হওয়ায় দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতি বাড়ছে। জানা গেছে, উপকুলবর্তী এলাকার জনগনকে বাঁচাতে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর বাঁশখালীর সাংসদ অর্থ ও পানি সম্পদ মন্ত্রনালয়ের স্থায়ী কমিটির সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরীর প্রচেষ্টায় স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মানের জন্য ২১০ কোটি টাকা বরাদ্দ পাওয়ায় উপকুলীয়বাসী আশায় বুক বাঁধে। কিন্তু দ্রব্যমুল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় পুর্বের ঠিকাদাররা কাজ না করায় ২১০ কোটি বাজেটকে পুন: রিভাইজ করে ২৫০ কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়। তবে সেই কাজ শুরু করা হয়নি। বেশ কিছু স্থানে মাটির কাজ করা হলেও সেগুলো ঘুর্নিঝড়ে বিলীন হয়ে গেছে।
পাউবি সুত্রে জানা গেছে, বর্তমানে ছনুয়া, গন্ডামারা, খানখানাবাদ ছাড়াও শেখেরখীল, সরল, কাথারিয়া, বাহারছড়া, সাধনপুর, পুকুরিয়া, পুইছড়ি সব মিলিয়ে প্রায় ৪৪.৪৩ কিলেমিটার বেড়িবাধ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। স্থানীয় সাংসদ মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী বলেন, বাঁশখালীতে স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মানের জন্য বরাদ্দ ২১০ কোটি টাকা থেকে ২৫০ কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়েছে। প্রশাসনিক কিছু কার্যক্রম শেষে অচিরেই এর কাজ শুরু হবে। অপরদিকে আনোয়ারা উপজেলার অন্তত ১০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ বিলীন হয়ে গেছে। সিউএফএল ঘাট থেকে বারো আউলিয়া সাগর পর্যন্ত ১৫ কিলোমিটার পর্যন্ত ১৫ কিরোমিটার, বারো আউলিয়া থেকে বরুমচড়া শঙ্খের মুখ পর্যন্ত ৩৩ কিলোমিটার, বরুমচড়া থেকে কৈনপুরা মহতরপাড়া পর্যন্ত ২৭ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। স্থায়ী সংস্কারের অভাবে বিভিন্ন এলাকায় বাঁধে দেখা দিয়েছে বিপজ্জনক ফাঁটল। জানা গেছে, ২০১৪-১৫ অর্থ বছরে শুধুমাত্র রায়পুরে স্থায়ী বেড়িবাঁধে ১ কোটি ৬৫ লাখ টাকার সংস্কার কাজ করা হয়েছে। বাঁশখালী ও আনোয়ারা উপজেলার বিভিন্ন উপকুলীয় এলাকার ভুক্তভোগীদের সাথে আলাপ করে জানা গেছে, ’এবারে ঘুর্নিঝড় নিয়ে তেমন প্রচারনা ছিল না। বিদ্যুৎ না থাকায় ঘুর্নিঝড়ের সংবাদ জানতো না অনেকেই। অপরদিকে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি (চেয়ারম্যান -মেম্বার) সবাই নিজ নিজ নির্বাচনি প্রচারনা নিয়ে ব্যস্ত থাকায় ঘুনিঝড়ের শতর্কিকরন করা হয়নি। এ দুই উপজেলায় ইউপি নির্বাচন অনুষ্টিত হতে যাচ্ছে আগামী ৪ জুন। সচেতন মহলের অভিযোগ, প্রতিবছর বর্ষাকালে উপকুলবর্তী মানুষের মাঝে নেমে আছে দুর্ভোগ-দুর্দশা। আর কোন বিবেচনায় নির্বাচন কমিশন বর্ষাকালে উপকুলীয় এলাকায় ইউপি নির্বাচন ঘোষনা করেন তা কারো বোধগম্য নয় ।
এদিকে জলোচ্ছ্বাস থেকে চট্টগ্রাম শহরকে রক্ষায় নির্মিত বাঁধটি এখন নিজের অস্তীত্ব নিয়ে শঙ্কায়। সংস্কারের অভাবে দীর্ঘদিন ধরে ২১ কিলোমিটার দীর্ঘ বাঁধটির বিভিন্ন অংশ ঝুঁকিপুর্ন হয়ে উঠে। সর্বশেষ গত ২১ মে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘুনিঝড় রোয়ানুর প্রভাবে বাঁধের প্রায় এক কিলোমিটার অংশ নতুন করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এমন পরিস্থিেিত জরুরী ভিত্ত্বিতে বাঁধটি চট্টগ্রাম শহরের বড় ধরনের বিপর্যয়ের কারন হতে পারে। এদিকে শহর রক্ষায় ২০১৩ সালে পানি উন্নয়ন বোর্ড ২৩৪ কোটি টাকার একটি প্রকল্প গ্রহন করলেও তা এখনো ফাইলবন্ধী বলে জানা গেছে। একই সঙ্গে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বাঁধকে ঘিরে ’আউটার রিং রোড’নামে একটি প্রকল্প হাতে নিলেও নির্দিষ্ট সময়ে এর কাজ শেষ হওয়া নিয়ে রয়েছে সংশয়। পাউবি সুত্র মতে, চট্টগ্রাম শহর রক্ষায় পতেঙ্গা থেকে ফৌজদারহাট পর্যন্ত ২১ কিলোমিটার দীর্ঘ বেড়িবাঁধটি প্রথম নির্মিত হয় ১৯৬৫ সালে। ১৯৯১ সালের প্রলয়ংকরী ঘুনিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বাঁধটি। এর পর পাউবি ৯০ কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন করে বাঁধটি নির্মান করে। ওই সময়ে প্রকল্পের আওতায় পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত থেকে নেভাল একাডেমি পর্যন্ত এক কিলোমিটার আরসিসি দেয়াল নির্মান, সৈকত থেকে আহমদের পাড়া পর্যন্ত সিসি ব্লক নির্মান করা হয়।
সিসি ব্লকের পরের অংশ থেকে সীতাকুন্ডের ফৌজদারহাট পর্যন্ত মাটির বেড়িবাঁধ নির্মান করা হয়। তবে. দীর্ঘদিন ধরে শহররক্ষা বাঁধটি ক্ষতিগ্রস্থ হলেও যথাযথভাবে সংস্কার করা হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। এদিকে স¤প্রতি রোয়ানু আঘাত হানলে বাঁধটির বিভিন্ন অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর মধ্যে সী বীচের পরে পতেঙ্গা ষ্টিল মিলের খেজুরতলা এলাকায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পতেঙ্গা সি বিচ থেকে বন্দরটিলার দিকে যাওয়ার পরে কাঠগড় মুসলিমাবাদ বেড়িবাঁধের পরেই এ্ খেজুরতলা। গত বছর এই বাঁধটির অংশটি ভেঙ্গে গিয়েছিল। তখন পাথর বা ব্লক না দিয়ে মাটির বস্তা দিয়ে সংস্কার করা হয়েছিল। রোয়ানুর প্রভাবে বাঁধের নেভাল একাডেমি অংশে নির্মিত ফ্ল্যাড ওয়াল ফেটে গেছে। এ ছাড়া ১৯৯১ সালে বেড়িবাঁধটি সংস্কারের সময় পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত থেকে নেভাল একাড়েমি পর্যন্ত এক কিলোমিটার দীর্ঘ আরসিসি দেয়াল নির্মান করা হয়েছিল সেগুলোর বেশিরভাগ বেঙ্গে গেছে।
স্থানীয় লোকজন জানিয়েছে, বাঁধের উত্তর পতেঙ্গা, মধ্যম হালিশহর, দক্ষিন মধ্যম হালিশহর, উত্তর পাহাড়তলী, গোসাইলডাঙ্গা, দক্ষিণ কাট্টলী, পতেঙ্গা ষ্টিল মিল, হোসেন আহমদ পাড়া, আনন্দবাজার, লতিফপুর, সলিমপুর সহ বিভিন্ন এলাকা মারাত্বক ঝুকিতে রয়েছে। এ ছাড়া বাঁধ সংলগ্ন এলাকায় রয়েছে, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের স্থাপনা, শাহ আমানত আন্তজাতিক বিমানবন্দর, ইষ্টার্ন রিফাইনারী, রাষ্ট্রায়ত্ত্ব তেল কোম্পানী পদ্মা, মেঘনা, যমুনার ডিপো, চট্টগ্রাম ইপিজেড, বেসরকারি আইসিটি, ইস্টার্ন ক্যাবল সহ স্থাপনা। এসব স্থাপনার কারনে ২০১৩ সালে ’রিহ্যাবিলিটেশন ও কোস্টাল ফোল্ডার্স নামে’ ২৩৪ কোটি টাকার একটি প্রজেক্ট পানি উন্নয়ন বোর্ড় নিয়েছিল। তবে দীর্ঘদিনেও এটির কোন অগ্রগতি নেই।
Comments are closed.