ষোড়শ সংশোধনী: সুপ্রিম কোর্টের রায় নিয়ে চট্টগ্রাম আইনজীবীদের অভিমত

0

মোঃ দেলোয়ার হোসেন::সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অপসারণ ক্ষমতা সংসদের হাতে ন্যাস্ত করে আনা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা রায় বহাল রেখেছেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট। গতকাল ৩ জুলাই ২০১৭ সকাল সাড়ে ১০টায় প্রধান বিচার প্রতি সুরেন্দ্র কুমার সিংহা এ রায় ঘোষণা করেন।

বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে নিতে ২০১৪ সালে ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী পাশ হয়। ২২ সেপ্টেম্বর তা গ্রেজেট আকারে প্রকাশ হয়। ঐ সংশোধনী বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে একই বছর ৫ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের ৯ আইনজীবী হাই কোর্টে রীট করেন। রীটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে গত বছর ৫ মে হাইকোর্টের ৩ বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত বিশেষ বেঞ্জ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন। এ রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের পক্ষে করা আপীলের উপর চলতি বছর ৮ মে শুনানি শুরু হয়। যা ১ জুন শেষ হয়।

এর আগে গত ৭ মার্চ আপীল বিভাগ শুনানিতে জ্যেষ্ঠ ১২ আইনজীবীকে অ্যামিকাস কিউরি (আইনী সহায়তাকারী) হিসেবে নিয়োগ দেন। যাঁদের মধ্যে ১০জন মতামত উপস্থাপন করেন। এঁদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী টি.এইচ.খান, ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার এম. আমীর-উল-ইসলাম, আবদুল ওয়াদুদ ভূঁইয়া, ফিদা এম কামাল, ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ, এ.এফ হাসান আরিফ, এ.জে মোহাম্মদ আলী, এম. আই ফারুকী ষোড়শী সংশোধনীর বিপক্ষে মত দেন। অপর অ্যামিকাস কিউরী আজমামুল হোসেন কিউরি সংশোধীর পক্ষে মত দেন। অপর দু’জন মত উপস্থাপন করেননি।

ফলে উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের হাতে ন্যস্ত রইল। উচ্চ আদালতের বিচারপতি অপসারণে ক্ষমতা সংসদের হাতে ন্যস্ত করে সংবিধানের আনীত ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে হাইকোর্ট যে রায় দিয়েছিল, তা বহাল রেখেছে সুপ্রিম কোর্টের আপীল বিভাগ। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিংহার নেতৃত্বাধীন আপীল বিভাগের ৭ বিচারপতির পুর্ণাঙ্গ বেঞ্জ ঐক্যমতের ভিত্তিতে সরকারের আপীল খারিজ করে দেয়।

রায়ে আপীল বিভাগ বলেছেন, হাইকোটের রায়ে যে পর্যবেক্ষণ দিয়েছিল, সে পর্যবেক্ষণ প্রত্যাহার সাপেক্ষে এ আপীল খারিজ করা হলো। রায়ের ফলে উচ্চ আদালতের বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের হাতে ন্যস্ত রইল বলে আইনজীবীরা মত প্রকাশ করেন।

প্রসঙ্গত ১৯৭২ সালে প্রণীত মূল সংবিধানে উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের কাছে ছিল। ১৯৭৫ সালের ২৪ জানুয়ারী সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে এ ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে অর্পণ করা হয়। পরে জিয়াউর রহমানের শাসন আমলে সংবিধানের ৫ম সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা দেওয়া হয় সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের কাছে। ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা পুন:রায় সংসদের হাতে ফিরিয়ে নিতে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আনা হয়। বিলটি পাশের পর একই বছর ২২ সেপ্টেম্বর তা গেজেট আকারে প্রকাশ পায়। দেশের শীর্ষ আইনজীবীরা, সংসদের বাইরে বিরোধী দলগুলো এ সংশোধনী প্রত্যাখান করে। সংবিধানে এ বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে একই বছর ৫ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের ৯ আইনজীবী রীট আবেদন দায়ের করেন। হাইকোর্ট এ সংশোধনী কেন অবৈধ, বাতিল ও সংবিধান পরিপন্থি ঘোষণা করা হবে না এ মর্মে রুল জারী করে। ২০১৫ সালের ২১ মে রুলের উপর চূড়ান্ত শুনানি শুরু হয়। শুনানির শেষে ২০১৬ সালের ৫ মে বিচারপতি মঈনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন হাইকোর্টের বৃহত্তর বেঞ্জ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে এ সংশোধনীকে অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে রায় দেয়।

হাইকোর্টের মূল রায়ে বলা হয়, আমাদের দেশের প্রচলিত রাজনীতির বৈশিষ্ট হলো বড় দলগুলোর মধ্যে বিভেদ এবং সমাজ মারাত্মকভাবে বিভাক্ত। এছাড়া সংসদের সবসময় দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নাও থাকতে পারে। ফলে একজন বিচারক অদক্ষ হলেও অপসারণ করা যাবে না। তাহলে তা দেশের জন্য লজ্জাজনক হবে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে আদালত চোখ বন্ধ করে রাখতে পারে না। বাংলাদেশে বিচারক নিয়োগের কোন নীতিমালা নেই। কিন্তু অপসারণের নীতিমালা করা হয়েছে। যা কোনভাবে সঠিক নয়। আগে নিয়োগের নীতিমালা ঠিক করা উচিত। রায়ে আরো বলা হয়, বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সংসদ সদস্যদের হাতে দেয়ার ফলে বিচার বিভাগের ওপর খড়গ ঝুলিয়ে দেয়া হয়। যদি বিচারকদের ওপর এ খড়গ ঝুলিয়ে দেয়া হয়, তা হলে জনগণের মনে বিরূপ ধারণা সৃষ্টি হবে। ন্যায় বিচার নিয়ে তখন জনগণের মনে সংশয় সৃষ্টি হবে। জনগণ যদি মনে করেন বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নেই, তাহলে বিচার বিভাগের অস্তিত্বই থাকে না।ষোড়শ সংশোধনী আইন ২০১৪ কালারেবল রেজিসলেশন (কোন কাজ সংবিধানের মধ্য থেকে করার সুযোগ না থাকলে আইন সভা যখন ছদ্ম আবরণে ভিন্ন প্রয়োজনের যুক্তি দেখিয়ে একটি আইন তৈরী করে)।

এটি বাতিল এবং সংবিধানের সংগে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করা হলো। এটা সংবিধানের দু’টি মুলকাঠামো ৯৪(৪) ও ১৪৭(২) অনুচ্ছেদেরও লংঘন। এ সংশোধনী সংবিধানের মৌলিক কাঠামো, ক্ষমতার পথকীকরণ নীতির পরিপন্থি। সংবিধানে ৭০ অনুচ্ছেদের কথা উল্লেখ করে রায়ে আরো বলা হয়, এ অনুচ্ছেদের কারণে দলের সংসদ সদস্যরা হাই কমান্ডের কাছে জিম্মি। নিজস্ব কোন সিদ্ধান্ত দেয়ার ক্ষমতা তাদের নেই। দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সংসদ সদস্যরা ভোট দিতে পারেন না। বিভিন্ন উন্নত দেশে সংসদ সদস্যরা স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত দেয়ার ক্ষমতা রাখে। কিন্তু আমাদের দেশে ৭০ অনুচ্ছেদের কারণে সংসদ সদস্যদের দলের অনুগত্য থাকতে হয়। বিচারপতি অপসারণের মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও দলের বাইরে যেতে পারেন না। এ সংশোধনী থাকলে বিচারপতিদের সংসদ সদস্যদের করুণাপ্রার্থী হয়ে থাকতে হবে। যা বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে খর্ব করে।

এ রায় ঘোষণায় চট্টগ্রাম সিনিয়র আইনজীবীরা ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করেন-  বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সাবেক সদস্য, চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এড. কবির চৌধুরী বলেছেন, এ রায় যথার্থ হয়েছে। আমাদের দেশের পার্লামেন্টের মেম্বার যে ক্যাটাগিরি, দলীয়ভাবে কাজ করে, দলীয় মনোভাব নিয়ে সবকিছু দেখায়,  দলীয়ভাবে ব্যবহারের চেষ্টা করেন। আদালতকে সেভাবে নিজেদের স্বার্থে দলীয়ভাবে ব্যবহার করার চেষ্টা করবে। সে জন্য বিচার বিভাগকে নিরপেক্ষ করতে না পারলে ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত হবে অনেক ক্ষেত্রে। তাই উচ্চ আদালতের এ রায় যথার্থ ও যুগপোযুগি হয়েছে বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন।

চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি এড. রতন কুমার রায় বলেছেন, যদি সংসদের হাতে এপেক্স কোর্টের বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা চলে যায়, তা হলে বিচারপতিদের তথা সর্বোচ্চ আদালতের স্বাধীনতা খর্ব হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়ে যাবে। বিচারকেরা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে না। তাঁদের উপর রাজনৈতিক প্রভাব পড়তে পারে। বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে তথা মুক্ত বিহঙ্গের মত তাঁর বিজয় নিকেতন উড়াতে পারবে না। যার ফলে ক্ষতিগ্রস্থ হবে বিচার প্রার্থী জনগণ। বিধায় উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত সময়োপযোগি বলে তিনি মনে করেন।

চট্টগ্রাম আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এড. কফিল উদ্দিন চৌধুরী বলেছেন, জনগণ ও জনগণের প্রতিনিধিদের ইচ্ছায় দেশ চলবে। নির্বাচিত প্রতিনিধি জনগণের প্রতিনিধিত্ব করবেন, এটাই সাংবিধানিক অঙ্গীকার। কিন্তু জনপ্রতিনিধিদেরকে বাস্তব এবং কার্যকর প্রতিনিধি হতে হবে। বর্তমান বাংলাদেশে যে পরিস্থিতি বা জনপ্রতিনিধির যে অবস্থা, এদের হাতে বিচারপতিদের অপসারণ ক্ষমতা অর্পণ করলে বিচার বিভাগ তাঁদের ধারা কুলশিত হবে। বিচার বিভাগের প্রতি সমাজের আস্থা নষ্ট হবে, অরাজগতা সৃষ্টি হবে। তাই উচ্চ আদালতে এ রায় সময়োপযোগি বলে মত প্রকাশ করেছেন তিনি।

চট্টগ্রাম জেলার সাবেক পি.পি এড. আবুল হাসেম বলেছেন, সংসদ সার্বভৌম নির্বাচিত সংসদ। এ সংসদ দেশের আইন তৈরী, সৃষ্টি ও প্রণয়ন করে। এ সংসদই সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। জনগণ তাঁদের প্রত্যক্ষ ভোটে প্রতিনিধি নির্বাচন করে থাকে। সংসদ জনগণের আস্থা এবং বিশ্বাসের ঠিকানা। তবে তৎকালীন বঙ্গবন্ধু প্রণীত সংবিধান, সাংসদ, সংসদের পরিবেশ, পরিস্থিতি, অবস্থান, জনপ্রতিনিধিদের চিন্তা-চেতনা, মন-মানসিকতা, দেশপ্রেম আর বর্তমান জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকারের জনপ্রতিনিধি, সাংসদ, সংসদের পরিবেশ, পরিস্থিতি, অবস্থান, সংসদ সদস্যদের আচার-আচরণ, ব্যবহার, দেশপ্রেম বঙ্গবন্ধু শাসন আমল থেকে সর্বক্ষেত্রে ভিন্নরূপ পরিলক্ষিত হয়। বর্তমান সংসদ সদস্যরা ক্ষেত্র বিশেষে ইগু প্রভলেম, দক্ষতা, আন্তরিকতা, আইন-কানুন সম্পর্কে অভিজ্ঞতা আগের তুলনায় তেমন প্রবল নয়। বাংলাদেশ সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের ৩ উপধারায় সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের কথা উল্লেখ আছে। তাছাড়া ৯৬ এর ৬ উপধারায় মহামান্য রাষ্ট্রপতির আদেশ দ্বারা যে কোন বিচারককে তাঁর পদ থেকে অপসারণ করিতে পারিবেন বলে উল্লেখ রয়েছে।

বর্তমানে সুপ্রিম কোর্ট আপীল বিভাগে ষোড়শ সংশোধনির যে রায় সংবিধান মতে হলেও এ সংবিধান তৈরি করে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ। দেশের জনগণ এবং প্রজাতন্ত্রের সকল কর্মচারী বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে প্রণিত আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। যারা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবেন তাঁরা যেন দেশের আইন জ্ঞান সম্পন্ন, দক্ষ, অভিজ্ঞ, শিক্ষিত হয়। তখন সংবিধান উপেক্ষিত হবে না, সাংঘষিক হবে না, সমন্বয় সাধন হবে।

চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এড. সালাউদ্দিন হায়দার ছিদ্দিকী বলেছেন, মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট, দেশের সর্বোচ্চ আদালত সর্বশেষ ঐক্যমতের ভিত্তিতে যে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে তা নিশ্চিয় সংবিধান ঘোষিত অনুশাসনের আলোকে নেয়া হয়েছে।  চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক এড. আবদুর রশিদ বলেছেন, জনগণের ভোটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সে সংসদ সদস্যরা সংসদে আইন প্রণোয়ন করে থাকেন। কিন্তু বিচারপতিদেরকে রাজনৈতিক প্রভাব মুক্ত রাখতে এ রায় যথাযথ বলে মত প্রকাশ করেন তিনি। তবে বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে দেশের সংবিধানকে সমুন্নত রেখে যোগ্য, মেধাবী, সৎ ব্যক্তিদের নিয়োগের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন।

লেখক ও আইনজীবী আনোয়ার আলী বলেছেন, বিচারকদের জন্যে সুনির্দিষ্ট কোন আচরণ বিধি নেই। সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে বিচারকদের কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। তেমন কোন প্রমাণও নাই। ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণায় বিচার বিভাগ স্বৈরাচারী হয়ে উঠার সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেয়া যায় না। রাষ্ট্রের কোন বিভাগেরই নিরংকুশ ক্ষমতা প্রাপ্তি ভাল লক্ষণ নয়। সংসদ জনগণের প্লাটফরম, জাতির বিবেক। আইন তৈরী হয় সেখানে। বিচারক অপসারণ ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের পাশাপাশি সংসদেরও থাকা উচিত বলে মনে করেন তিনি।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.