চাঁদ কি সত্যিই পৃথিবীর উপগ্রহ?

0

এই পৃথিবীটা খুব, খুব অদ্ভুত। ফেসবুকে প্রচলিত একটা উপমা দিই, “অমানুষ চিনতে না পারলে লজ্জার কিছু নেই, কারণ তারা দেখতে মানুষের মতই!” তবে কিনা, শুধু মানুষ না, আমরা যা দেখছি, আসলেই তা সত্য কিনা বোঝা সহজ নয়। এই, চাঁদের কথাই ধরুন না!

জন্ম থেকেই চাঁদকে দেখছি, ওই দূর আকাশে চাঁদের বুড়ি চরকা কেটে চলে, আর চাঁদ ঘুরতে থাকে পৃথিবীর চারপাশে, রাত কেটে যায় দিন হয়, চাঁদ হারিয়ে যায় সীমান্তের ওপাড়ে! আবার রাত আসে। রাতের নিস্তদ্ধতায়, যখন পৃথিবী ঘুমিয়ে পড়ে, আর এক নিঃসঙ্গতা নিজেকে গ্রাস করে নেয়, তখন জানালা দিয়ে চাঁদকে দেখি আর মনে হয়, চাঁদটা বুঝি আমার মতই একা! কিন্তু সত্যিই কি সে একা একা ঘুরে চলে পৃথিবীর চারপাশে? নাকি পৃথিবীও বুঝি তাকে সঙ্গ দেয়?

কেন আমাদের পৃথিবী একটা গ্রহ? আর কেন চাঁদ গ্রহ না? পৃথিবী কেন চাঁদের উপগ্রহ হলো না? জানি কি এই প্রশ্নগুলোর উত্তর? আসলেই কি চাঁদ পৃথিবীর উপগ্রহ? হয়ত, কিংবা হয়ত না! সেই কোনকাল থেকে তাকে দেখছি, তবু, এত চেনা চাঁদ যেন বড় অচেনা!

আমরা জানি, চাঁদ পৃথিবীর উপগ্রহ। কিন্তু কেউ বলে, চাঁদ আসলে গ্রহ! পৃথিবীর অধিনস্ত কেউ না, বরং তার ভাই, বড় আদরের ভাই। অবাক লাগছে? আসলে একটা উপগ্রহ হওয়ার জন্য পৃথিবীর অনুপাতে চাঁদ অনেক বড়। চাঁদের ব্যাস পৃথিবীর প্রায় এক-চতুর্থাংশ। ফলে চাঁদ পৃথিবীর ব্যাসের অনুপাত সৌরজগতের যেকোন গ্রহ উপগ্রহের ব্যাসের অনুপাতের চেয়ে অনেক বেশি। তাই, পৃথিবী যেমন চাঁদকে টানে, চাঁদও টানে পৃথিবীকে। আরেকটা কথা, প্লুটোর উপগ্রহ শ্যারনের ব্যাস কিন্তু প্লুটোর ব্যাসের অর্ধেকের বেশি। শ্যারনের দুর্ভাগ্য! প্লুটো নিজেই তো গ্রহের মর্যাদা হারিয়ে ফেলেছে!

গ্রহ কি?

আমাদের প্রশ্নের উত্তর পেতে আগে গ্রহের সংজ্ঞা জানতে হবে। ২০০৬ সালে যখন প্লুটোর মত আরো জগৎ আবিষ্কার হলো, তখন গ্রহের সংজ্ঞাও বদলে গেলো। আন্তর্জাতিক মহাকাশীয় সমিতি (IAU) প্রাগে ভোটের মাধ্যমে গ্রহের নতুন সংজ্ঞা দিলো-

“A PLANET IS A CELESTIAL BODY THAT (A) IS IN ORBIT AROUND THE SUN, (B) HAS SUFFICIENT MASS FOR ITS SELF-GRAVITY TO OVERCOME RIGID BODY FORCES SO THAT IT ASSUMES A HYDROSTATIC EQUILIBRIUM (NEARLY ROUND) SHAPE, AND (C) HAS CLEARED THE NEIGHBORHOOD AROUND ITS ORBIT.”

অর্থাৎ, আমরা তখনই কোন মহাকাশীয় বস্তুকে গ্রহ বলব যখন এতে তিনটা বৈশিষ্ট্য থাকবে-

  • নক্ষত্রের চারপাশে কক্ষপথে ঘূর্ণায়মান থাকবে।
  • নিজের মধ্যাকর্ষণ প্রভাব এড়িয়ে দৃঢ় মোটামুটি গোলাকার আকার হতে হবে।
  • এর কক্ষপথের চারপাশের ধুলো ও ধ্বংসাবশেষ পরিষ্কার করে ফেলবে।

এই সংজ্ঞা কিন্তু মোটেও বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। প্লুটোর গ্রহ হওয়ার পেছনে অনেক শক্ত দাবি ও যুক্তি রয়েছে। নিউ হরিজনস মহাকাশযান নির্মাতা এলান স্টার্নও তা-ই মনে করেন। ২০০৬ সালে তিনি বিবিসিকে বলেন, “It’s an awful definition; it’s sloppy science and it would never pass peer review” অর্থাৎ, সিদ্ধান্তটা ভয়াবহ, এটা আবেগী বিজ্ঞান আর এটা ধোপে টিকবে না। তার মতে, গ্রহাণু আর গ্রহের পার্থক্য খুবই কৃত্তিম। আর “cleared neighborhood” কথাটাও ভ্রান্ত। পৃথিবীকেও অনেক গ্রহাণু অনুসরণ করছে অথবা এর কক্ষপথে প্রবেশ বা অতিক্রমের চেষ্টা করছে। আর বৃহৎ গ্রহ বৃহস্পতির কথা না বললেও চলবে (অর্থাৎ, সে-ও তৃতীয় শর্ত পূরণ করেনি)।

এখানে, আরেকটু পরিষ্কার করি, তৃতীয় শর্তটি প্লুটো, পৃথিবী আর বৃহস্পতি-ই কেবল নয়, মঙ্গল ও নেপচুনও পূরণ করেনি। ফলে, স্বাভাবিকভাবেই বিতর্ক স্থান করে নিয়েছে।

উপগ্রহ না গ্রহ?

চাঁদের মতই, অন্য গ্রহগুলোর চারপাশেও বিভিন্ন উপগ্রহ ঘুরছে। শনি আর বৃহস্পতির তো ডজন ডজন আছে। IAU এর কাছে ফিরে যাই, ২০০৬ সালে IAU আরো বলেছে, প্লুটোর তুলনায় শ্যারনের আকৃতি অর্ধেক হলেও তারা একে গ্রহাণু মানতে রাজি নয়। তবে IAU স্বীকার করে শ্যারনকে এখন প্লু্টোর উপগ্রহ বলা হলেও ভবিষ্যতে তা পরিবর্তিত হতে পারে। কারণ এদের অভিকর্ষ কেন্দ্র প্লুটোর অভ্যন্তরে নয়, বরং প্লুটো আর শ্যারনের মধ্যবর্তী ফাঁকা স্থানে। এই কেন্দ্রকে বলা হয় সাধারণ কেন্দ্র বা Barycenter। এই বিষয়ে IAU বলে-

Q: IS PLUTO’S SATELLITE CHARON A DWARF PLANET?
A: FOR NOW, CHARON IS CONSIDERED JUST TO BE PLUTO’S SATELLITE. THE IDEA THAT CHARON MIGHT QUALIFY TO BE CALLED A DWARF PLANET IN ITS OWN RIGHT MAY BE CONSIDERED LATER. CHARON MAY RECEIVE CONSIDERATION BECAUSE PLUTO AND CHARON ARE COMPARABLE IN SIZE AND ORBIT EACH OTHER, RATHER THAN JUST BEING A SATELLITE ORBITING A PLANET. MOST IMPORTANT FOR CHARON’S CASE AS A DWARF PLANET IS THAT THE CENTRE OF GRAVITY ABOUT WHICH CHARON ORBITS IS NOT INSIDE OF THE SYSTEM PRIMARY, PLUTO. INSTEAD THIS CENTRE OF GRAVITY, CALLED THE BARYCENTRE, RESIDES IN FREE SPACE BETWEEN PLUTO AND CHARON.

(এখন পর্যন্ত শ্যারন শুধুই প্লুটোর উপগ্রহ। শ্যারনের গ্রহাণু হওয়ার ধারনা পরে বিবেচনা করা যেতে পারে। শ্যারন স্বীকৃতি পেতে পারে কারণ প্লুটো ও শ্যারনের আকার তুলনীয় এবং এরা একে অন্যের অক্ষে ঘোরে, শুধু গ্রহের চারপাশে ঘোরা কোন উপগ্রহ না।  সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রহাণু হিসেবে শ্যারনের মধ্যকর্ষ কেন্দ্র প্লুটোর অভ্যন্তরে না। এখানে মধ্যকর্ষ কেন্দ্রের পরিবর্তে সাধারণ কেন্দ্র, প্লুটো ও শ্যারনের মধ্যবর্তী ফাঁকা স্থানে।)

Charon Barycenter চাঁদ কি সত্যিই পৃথিবীর উপগ্রহ? বহুদিন চিনি তারে তবু চিনি না!

ছবি: প্লুটো ও শ্যারনের ঘূর্ণন। সূত্র

এছাড়াও IAU এখন আরো বলছে উপগ্রহ হতে হলে আপাতত সাধারণ কেন্দ্র গুরুত্বপূর্ণ নয়-

“THERE HAS BEEN NO OFFICIAL RECOGNITION THAT THE LOCATION OF THE BARYCENTER IS INVOLVED WITH THE DEFINITION OF A SATELLITE.”

অর্থাৎ, এখন পর্যন্ত এতে কিছু যায় আসে না। তবে, এটাই চূড়ান্ত না। তারা বলে, বিবেচনার বিষয়, চাঁদ আর পৃথিবীর সাধারণ কেন্দ্র কি পৃথিবীর অভ্যন্তরে না বাহিরে? হ্যাঁ, এখনো এটা অভ্যন্তরে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এটা পৃথিবী থেকে সরে যাচ্ছে। প্রতি বছর এটা ৩.৮ সে.মি করে চাঁদ পৃথিবীর দূরত্ব বাড়ছে। হয়ত অনেক সময় লাগবে, কিন্তু একদিন সাধারণ কেন্দ্র পৃথিবীর বাইরে চলে যাবে।

তবে IAU এর ২০০৬ সালে নেওয়া এক সাক্ষাতকারে প্লুটো ও শ্যারনকে গ্রহের বিশেষ শ্রেণিবিন্যাস ‘Pluton’ এ রাখা হয়েছে, তখন ৪টি  Pluton সহ ১২ টি গ্রহ ছিলো, এখন এই চারটিকে গ্রহের আওতায় রাখা হয় না। যাইহোক, সেখানে প্লুটো এবং শ্যারনকে যুগ্ম গ্রহ বলা হয়েছে এবং যুগ্ম গ্রহের (Double Planet) বিষয়ে বলা হয়েছে, যে সিস্টেমে দুটো বস্তুই গ্রহের সংজ্ঞায় পড়ে এবং সাধারণ কেন্দ্র কোনটিরই ভেতরে নয়। অবশ্য এই সংজ্ঞাতেও এখনো চাঁদ উপগ্রহ হতে পারছে না।

অতএব, গ্রহের সংজ্ঞাকে কবুল করলেও চাঁদকে আপাতত পৃথিবীর উপগ্রহ মানতেই হবে, অন্তত IAU এর নিয়মে! কিন্তু হয়ত একদিন প্রিয় চাঁদ হতে পারে পৃথিবীরই আপন ভাই, সৌরজগতের নতুন এক গ্রহ!

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.