চট্টগ্রামের মানুষ জোয়ারের পানিতে ভাসছে !

জুবায়ের সিদ্দিকী – 

চট্টগ্রাম মহানগরীর অর্ধেক এলাকার মানুষ গত বছরের মত এবারও ঈদের তিনদিন আগে থেকে জলাবদ্ধতায় ভেসেছেন।  ৪ জুলাই থেকে প্রবল বর্ষনের সঙ্গে ক্রমান্বয়ে বেড়ে যাওয়া জলাবদ্ধতা ছিল ঈদের আগের দিনও। খবর নিয়ে জানা গেছে, নগরীর মহেষখালের মুখে বন্দর কর্তৃপক্ষের স্থাপিত অস্থায়ী স্যুইচ গেইটটি জোয়ারের সময় অযৌক্তিকভাবে খুঁলে দেয়ায় বৃষ্টির পানির সঙ্গে যোগ হয়ে বিশাল এলাকা দীর্ঘ বন্যায় রুপ নিয়েছে। আগ্রাবাদ বানিজ্যিক এলাকা, বেপারী পাড়া, সিডিএ আবাসিক এলাকা, আবিদর পাড়া, আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতাল, ছোটপুল জেলা পুলিশ লাইন, শান্তিবাগ, মুহুরী পাড়া, হালিশহর হাউজিং এষ্টেট ও এক্সেস রোড়ের উভয় পাশের ঘনবসতিপুর্ন এলাকা হাটু থেকে কোমর পানিতে ডুবে ছিল তিন দিন। স্থানীয় অধিবাসীদের অভিযোগ, গত বছরও ঈদের কয়েকদিন আগে থেকে প্রবল বর্ষনে পানিবন্ধী ছিল পাঁচ লক্ষাধিক মানুষ। এবারের ঈদের আগেও একই অবস্থা।এসব এলাকার মানুষের মাঝে ঈদের আনন্দ তো ছিলই না বরং দুর্ভোগ দুর্দশায় অনেকে বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়েছে। কারন এবারের জলাবদ্ধতার স্থায়ীত্ব অতীতের যে কোন সময়কে হার মানিয়েছে।

বুঝতেই পারছেন সিটি কর্পোরেশন ও স্থানীয় কাউন্সিলররা জনগনের দুর্ভোগ দুর করতে কোন আন্তরিক উদ্যোগ গ্রহন করেননি। সরেজমিন দেখা যায়, বেপারী পাড়া, সিডিএ আবাসিক এলাকার নিচতলার সব বাড়িঘর কোমর পর্যন্ত পানিতে ডুবে ছিল। এসব বাড়িঘরের লোকজন বাড়ির দামী জিনিসপত্রের মায়া ছেড়ে অনেকেই অন্যত্র চলে গেছেন। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকা, শান্তিবাগ আবাসিক এলাকা ও হালিশহর হাউজিং এষ্টেটের নিচতলার অধিকাংশ বাড়িঘরই খালি পড়ে আছে। স্থায়ী বাসিন্দাদের অনেকে নিরুপায় হয়ে, জলাবদ্ধতার মধ্যে কাটাচ্ছে অমানবিক জীবন। বেপারী পাড়া, মহুরী পাড়া ও হাজিপাড়ার স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকে বলেন, ’কাউকে অভিযোগ দেওয়ার কিছু নেই। আমাদের দুর্ভোগ-দুর্দশা, জলাবদ্ধতা দেখার কেউ নেই। জনপ্রতিনিধিরা হয়তো ওমরা হজ্বে অথবা বিদেশ ভ্রমনে! স্থানীয় এমপি সাহেব তো কোনদিন খবরই রাখেন না! ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে অনেকে বলেন, ভোটের আগে সবাই ভিক্ষুকের মত ঘরের দুয়ারে আসে। ভোটের পর তারা সেবক থাকেন না, রাজা হয়ে যান।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, চট্টগ্রাম বন্দর সংলগ্ন এ বিশাল এলাকার মানুষের প্রাণের দাবী ছিল মহেশখালের মুখে স্থায়ীয় স্যুইচ গেইট নির্মান। যাতে জোয়ারের পানি এসে এলাকা প্লাবিত না হয়। গনমানুষের দাবীর মুখে অনেকটা ঢাকঢ়োল পিটিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর একটি অস্থায়ী স্যুইচ গেইট নির্মান করলেও এটি নিয়ে শুরু থেকে রয়ে গেছে বিতর্ক। কর্নফুলী নদীর সংযোগস্থলে এটি নির্মান না করে শহরের মাঝখানে এ বাঁধ তৈরী করার কারনে এর সুফল পাচ্ছে না নির্মাঞ্চলের মানুষ। অপরদিকে, ৩৭ নং ওয়ার্ডের লোকজন দাবী করছে এ বাঁধের কারনে তারাও বন্যার পানিতে ভাসছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের উর্দ্ধতন এক প্রকৌশলী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন,’বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজের খেয়াল খুশিমত এটি করেছে। ফলে যার সুফল পাচ্ছেন না নাগরিকরা।

জলাবদ্ধতা বন্দরনগরী চট্টগ্রামের একটি দুর্বিষহ সমস্যা। বিপুল সংখ্যক জনগোষ্টির অবর্ননীয় ভোগান্তির কারনে জলাবদ্ধতাই নগরীর একমাত্র বড় সমস্যা। বৃষ্টি ও জোয়ারের পানির কারনে প্রতি বছর এ সময় বিস্তির্ন অঞ্চল প্লাবিত হয়। অনেক এলাকায় যানবাহনের পরিবর্তে নৌকা চলাচল করে। অসংখ্য ঘরবাড়ি, দোকানপাটে পাটি ঢুকে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও দুর্ভোগের কারন হয়। ব্যবসা বানিজ্য, শিক্ষা প্রতিষ্টান, স্থবির হয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের, শিক্ষার্থীদের জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত করে তুলে। চট্টগ্রামের দীর্ঘদিনের এই অচলায়তনের কথা সরকারের উর্দ্ধতন মহলের না জানার কথা নয়। বরাবরই চট্টগ্রাম বিদ্বেষী আমলারা চট্টগ্রামকে উন্নরয়ন বঞ্চিত করার চেষ্টায় থাকে এমন অভিযোগ চট্টগ্রামের উন্নয়নকামী মানুষের দীর্ঘদিনের। অভিযোগ রয়েছে, ইতোপুর্বে প্রত্যেকটি সরকারের মত এ সরকারও চট্টগ্রামের উন্নয়নে প্রতিশ্রুতি দিয়েও কথা রাখেনি।

উন্নয়নের নাম শুধু উড়াল সেতু নয়! অভ্যন্তরীন সংযোগ সড়কগুলো সুপশস্ত না করে, নালা নর্দমা পরিস্কার পরিচ্ছন্নের ব্যবস্থা না করে, জলাবদ্ধতা দুর করতে খালের মাটি উত্তোলন না করে, নতুন খাল খননের ব্যবস্থা না করে, নাগরিক সুযোগ সুবিধা সৃষ্টি না করে নগরবাসীকে ট্যাক্সের বোঁঝা চাপিয়ে দেওয়ার নাম কি উন্নয়ন! এ সরকারের প্রথম পাঁচ বছরে জলবায়ু তহবিলের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা আসলেও চট্টগ্রাম নগরীর উন্নয়নে কোন ব্যয় করা হয়নি। অরক্ষিতই রয়ে গেছে শহর রক্ষাবাঁধ। স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৭-৮ ফুট পানি হলে গোট চট্টগ্রাম চলে যাবে পানির নিচ্ছে। নগরজুড়ে অপরিকল্পিত ড্রেনেজ ব্যবস্থা ও ভবন নির্মানের কারনে জলাবদ্ধতার অভিশাপ মুক্ত হচ্ছে না। নগরবাসীর মনে একই প্রশ্ন-সরকার কি এসব সমস্যা দুর করার ক্ষমতা রাখেন না? নাকে ভুল বুঝিয়ে শুধু উড়াল সেতুর পেছনে টাকা খরচের পরামর্শই দেয়া হচ্ছে।

চট্টগ্রামের মানুষ দীর্ঘদিন যাবত জলাবদ্ধতা ও পাহাড় ধ্বসের নির্মম পরিনতি অবলোকন করে আনলেও চট্টগ্রাম নগর প্রশাসন, উন্নয়ন ও সেবামুলক প্রতিষ্টানগুলো এ দুর্ভোগ থেকে মুক্তি দেয়ার কোন বাস্তবসম্মত উদ্যোগ গ্রহন করেনি। নগরবাসী মনে করে, সিটি কর্পোরেশন, ওয়াসা, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, পানি উন্নয়ন বোর্ড, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃকপক্ষ ও বন্দর সহ সব দপ্তরের অভ্যন্তরীন সমন্বয়ের মাধ্যমে সুচিন্তিত প্রকল্প গৃহীত হলে নগরবাসী জলাবদ্ধতা মুক্ত হতে পারে। বর্তমান মেয়রের প্রতি সর্বস্তরের মানুষ যে সমর্থন দিয়েছিলেন তারও নেপথ্যে কারন জলাবদ্ধতা। এখন শুধু নির্মাঞ্চল নয়। নগরীর হামজারবাগ, বহদ্দারহাট, নাসিরাবাদ, ষোলশহর, চকবাজার, পাঁচলাইশ, ডিসি রোড,ম চান্দগাঁও ও দেওয়ানবাজার থাকে কোমর পানির নিচে। ব্যবসা বানিজ্যের প্রসিদ্ধ চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ, আসদগঞ্জ ও বক্সিরহাটের আরও করুন দশা। প্রতি বছর বর্ষায় হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতি গুনতে হয় এসব এলাকার ব্যবসায়ীদের।

জানা গেছে, নগরীর বৃষ্টির পানি ও নালানর্দমার পানি নিস্কাশনের জন্য মুল খাল রয়েছে ১৬টি। এসব খালের অধিকাংশই বেদখল হয়ে গেছে। এর দখলদারের তালিকায় সরকারী ও বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা। এ ছাড়া এসব খাল সময়মত সংস্কার ও খনন করা হয়নি। কিছু কিছু খালের মাটি উত্তোলন করে তা রাখা হয়েছির, খালের পাড়ে। বৃষ্টি হওয়ার পর এসব মাটি আবার খালে গিয়ে পড়েছে। সিটি কর্পোরেশনের পরিবেশ উন্নয়নের দায়িত্বে যারা নিয়োজিত তাদের খামখেয়ালীপনার কারনেও জলাবদ্ধতা দুর হচ্ছে না। চট্টগ্রাম সড়ক ও অবকাঠামোর দিক দিয়ে উন্নয়নে বেশ এগিয়ে গেলেও জলাবদ্ধতা ও পাহাড়ধ্বসের কারনে এসব অর্জন ম্লান হয়ে যাচ্ছে। দশ মাস পুর্বে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) পরিচ্ছন্ন বিভাগ ময়লা আবর্জনা অপসারনের নতুন যে সময়সুচী নির্ধারন করেছিল সেটির আলোকে নগরীর কোথাও দিনের বেলা ময়লা আবর্জনা থাকার কথা ছিল না।

কিন্তু সবসময় ময়লা আবর্জনা দেখা যাচ্ছে শহরের গুরুত্বপুর্ন স্পটগুলোতে। সকাল, দুপুর, বিকাল সবসময় দেখা যায় ময়লার স্তুপ। স্থাপিত ডাষ্টবিন উপছে পড়লেও অপসারন করা হয়না ময়লা আবর্জনা। ময়লা আবর্জনা থেকে নির্গত উৎকট গন্ধ গোটা শহরের পরিবেশ ভারি হয়ে উঠেছে। স্থানীয় অধিবাসীরা যেমন স্বাস্থ্যঝুকিতে থাকছেন আবার সড়কে ময়লা আবর্জনা পড়ে থাকায় বাড়ছে যানজট। ক্লিন সিটি গড়ার প্রকিশ্রুতি দিয়ে দায়িত্ব্ নেয়া চসিক মেয়র আ.জ.ম নাছির উদ্দিন তাঁর নির্বাচনপুর্ব পরিচ্ছন্ন শহর গড়তে দেয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষায় কতটুকু মনোযোগী সেই প্রশ্নও তুলছেন নগরবাসী। তারা বলছেন, নামে ক্লিন সিটি কিন্তু যত্র তত্র আবর্জনা।

তবে বেশিরভাগ নগরবাসী বলছেন, ক্লিন সিটি গড়ার প্রতিশ্রুতি ভুলে গেলেও ’চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এ্যাক্ট ২০০৯’ অনুযায়ী শহরকে পরিচ্ছন্ন রাখতে আইনগতভাবে বাধ্য মেয়র। শহর পরিচ্ছন্ন না থাকলে তাই এর দায়িত্ব সচিকের প্রধান হিসেবে তিনি এড়াতে পারেন না।

উন্নয়নকামী চট্টগ্রামের মানুষের মত আমরা কামনা করি, মেয়র আ.জ.ম নাছির উদ্দিন নগরীকে জলাবদ্ধতার অভিশাপ থেকে মুক্তি দিতে জরুরী মহেষখালের মুখে স্থায়ী স্যুইচ গেইট স্থাপন, নগরীর ১৬টি খালের বেদখলমুক্ত ও মাটি অপসারন, নতুন খাল খনন, প্রধান সড়কের পাশে নালা নর্দমা প্রশস্ত করা, অভ্যন্তরীন সংযোগ সড়কের উন্নয়ন ও চসিকের পরিবেশ উন্নয়ন বিভাগের উপর নজরদারী বৃদ্ধি করবেন। আমরা বিশ্বাস করতে চাই, মেয়রের মধ্যে যে কর্মস্পৃহা, যোগ্যতা, মেধা ও বিভিন্ন সেক্টরে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। তিনি নিশ্চয় ভাল কাজ দেখাতে পারেন। আমরা উৎসাহিত করতে চাই। অনেক ভাল কাজ করেছেন, আমাদের প্রত্যাশা আরও বেশি !

এ বিভাগের আরও খবর

Comments are closed.