সিডিএ ব্যস্ত ফ্লাইওভার নির্মানে আবাসিক প্লট বরাদ্ধ থমকে আছে

0

জুবায়ের সিদ্দিকী-

বার আউলিয়ার স্মৃতি বিজড়িত পুন্যভুমি চট্টগ্রাম বাংলাদেশের দ্বিতীয় প্রধান নগরী। প্রায় ৬০ লাখ মানুষের এই নগরে প্রতি বছর কাজের সন্ধানে অভিগমন করছেন ৭৫ হাজার মানুষ। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার। নগরীতে সব মিলিয়ে বাড়ছে বছরে এক লাখ মানুষ। বাড়তি এই জনসংখ্যার আবাসন চাহিদা মেটাতে সরকারী আবাসন প্রতিষ্টানসমুহ (চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ, গনপুর্ত অধিদপ্তর, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন) বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যামে সুদুর অতীতে আবাসন সমস্যা নিরসনে কাজ করলেও গত কয়েক বছর যাবত উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি নেই সংস্থাগুলোর।

সমাজের মধ্যবিত্ত শ্রেনীর লোকজন এ কারনে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ কিংবা জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে একটি প্লট পাওয়ার আশায় দিন গুনতে থাকে। সর্বশেষ ২০০৮ সালে সিডিএ’র অনন্যা আবাসন প্রকল্পের প্লট বরাদ্দের পর আর কোন প্রকল্প গড়ে তোলেনি সিডিএ। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম দায়িত্ব গ্রহনের পর অধ্যাবদি নগরীর আবাসন সমস্যা নিরসনে বৃহত্তর কোন প্রকল্প গ্রহন করেননি। তাঁর আমলেই নগরীতে ফ্লাইওভার নির্মানের হিড়িক পড়ে যায়। যদিও এসব ফ্লাইওভারের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সরকারের অনেক মন্ত্রী ও সিনিয়র নেতারা। এ ছাড়া কয়েকটি সড়ক সম্প্রসারন ছাড়া তাঁর আমলে উল্লেখযোগ্য কোন অগ্রগতি নেই। একই ভাবে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ শহরের বাইরে রাউজানে দুটি আবাসন প্রকল্পে প্লট বরাদ্দ দিলেও নগরীতে কোন প্রকল্প গড়ে তুলেনি।

গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি মিরশ্বরাইতে আবাসিক প্রকল্প ও হালিশহরে ফ্ল্যাট বরাদ্দের উদ্যোগ নিলেও তার দাম এত বেশি যে সমাজের উচ্চবিত্ত ছাড়া কেউ এসব প্লট ও ফ্ল্যাট ক্রয় করতে পারবে না। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ৬৩ বছরে চট্টগ্রামে চার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও একটি বেসরকারী সংস্থা নগরীতে ২৮টি আবাসিন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। ১ হাজার ৪৩৪ দশমিক ৯০৭ একর জায়গায় ১৭ হাজার ৯টি প্লট তৈরী হয়েছে এসব আবাসন প্রকল্পে। নগরীতে পরিকল্পিত আবাসনের লক্ষ্যে ১৯৯৫ সালে ২০ বছর মেয়াদী একটি মাষ্টারপ্ল্যান চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) ইউএনডিপির অর্থায়নে প্রনয়ন করলেও সেই অনুযায়ী গড়ে উঠেনি নগরীর আবাসন প্রকল্পগুলো।

এদিকে থমকে যেতে পারে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) নতুন আবাসন প্রকল্পের স্বপ্ন। অক্সিজেন ও কুয়াইশের মধ্যবর্তী এলাকায় ২০০৮ সালে প্রায় ১৭০০ প্লট নিয়ে অনন্যা আবাসিক এলাকা গড়ে তোলা হলেও বর্তমানে একই এলাকার পাশের কৃষিজমি অধিগ্রহন করে প্রবাসীদের জন্য ৯০০ প্লটের পাশাপাশি সর্বমোট তিন হাজার প্লট তৈরির প্রকল্প নেয়া হচ্ছে। কিন্তু বিপত্তি দেখা দিতে পারে মন্ত্রী পরিষদের সর্বশেষ সভার বৈঠকের সিদ্ধান্তের কারনে। ভুমি অধিগ্রহণে ভুমির মালিককে মৌজামুল্যের তিনগুন অর্থ ক্ষতিপুরন দিতে মন্ত্রী পরিষদ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

আর এই অনুযায়ী অনন্যায় নতুন করে প্লট বরাদ্দ দিতে গেলে কাঠা প্রতি মুল্য ২৬-৩০ লাখে গিয়ে ঠেকতে পারে। এতো দাম দিয়ে বাস্তবায়ন করতে যাওয়া প্রকল্প ফলপ্রসু হওয়া নিয়েও সংশয় রয়েছে। সিডিএর চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম এ ব্যাপারে বলেছে,’ মৌজামুল্যের তিনগুন ক্ষতিপুরন পরিশোধ করতে হলে শুধু আবাসন খাত নয়, সরকারের সকল প্রকল্পই বাধাগ্রস্ত হবে। রাস্তাঘাটসহ যেসব প্রকল্পে জমি অধিগ্রহনের প্রয়োজন হয় সব প্রকল্পই বাধাগ্রস্ত হতে পারে।

চট্টগ্রাম উন্নয় কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) এর আগে ২০১২ সালের দিকে কল্পলোক তৃতীয় পর্যায় নামে একটি আবাসন প্রকল্প শুরু করতে চেয়েছিল বাকলিয়ায়। প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ে কাঠাপ্রতি চারলাখ ও সাড়ে চার লাখ টাকার প্লট বরাদ্দ দেয়া হলেও তৃতীয় পর্যায়ে মৌজা মুল্য বেড়ে যাওয়ায় তখনকার সময়ে তা ২৪ লাখে গিয়ে ঠেকেছিল। এত বেশি দাম দিয়ে ক্রেতারা প্লট কেনার সম্ভাবনা কম থাকতে পারে বলে সিডিএ কোন ঝুঁকি নেয়নি এবং আবাসন প্রকল্পও বাস্তবায়ন হয়নি।

পরবর্তীতে হাটহাজারীর ফতেয়াবাদে প্রায় আড়াই হাজার প্লট নিয়ে একটি টাউন শিপ গড়ে তোলার লক্ষ্যে ডিপিপি তৈরী করা হলেও মৌজা মুল্য বেশি হয়ে যাওয়ায় কাঠা প্রতি বরাদ্দ মুল্য বেশি হবে বলে এটিরও আলোর মুখ দেখছে না। সর্বশেষ অক্সিজেন কুয়াইশ সংযোগ রোড়ের (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ সড়ক) উভয়পাশে বাস্তবায়ন হওয়া অনন্যা আবাসিক এলাকার উত্তর, পুর্ব ও পশ্চিম পাশের কৃষিজমিতে প্রবাসীদের জন্য ৯০০ প্লটসহ মোট তিন হাজার প্লট তৈরীর জন্য ৪০০ একর ভুমি অধিগ্রহনের পরিকল্পনা করেছে সিডিএ।

ইতিমধ্যে এই প্রকল্পের ডিপিপি (বিস্তারিত প্রকল্প প্রস্তাবনা) অনুমোদনের পর প্রি-একনেক সভায় তা উপস্থাপনের কথা রয়েছে। এদিকে সিডিএ কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, অনন্যা আবাসিক এলাকায় ২০০৮ সালে কাঠা প্রতি ছয় লাখ টাকা করে প্লট বরাদ্দ দিতে কাঠা প্রতি ১৫ লাখ টাকা বিক্রয়মুল্য ধরা হয়েছে। সেই হিসেবে ডিপিপিও তৈরী হয়েছে। কিন্তু ভুমির অধিগ্রহন মুল্য তিনগুন হলে তা কাঠা প্রতি প্রায় ৩০ লাখের কাছাকাছি যেতে পারে। কিভাবে হতে পারে জানতে চাইলে সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী জানান, বর্তমানে কুলগাঁও মৌজা, কুয়াইশ মৌজা, বাথুয়া মৌজা ও চান্দগাঁও মৌজার গড় মুল্য প্রতি কাঠায় ৭ লাখ থেকে ৮ লাখ টাকা।

তাহলে এত তিনগুন ক্ষতিপুরন দিলে তা অধিগ্রহন মুল্য ২৪ লাখ দিয়ে পৌছাতে পারে। এতো টাকা কাঠা প্রতি দিয়ে কেউ প্লট নেবে কিনা আর সিডিএ এই ঝুঁকি নেবে কিনা তাই এখন দেখার বিষয়। সম্প্রতি সম্পত্তি অধিগ্রহন ও হুকুম দখল আইন-২০১৬ এর খসড়া নীতিগত অনুমোদন হয়েছে গত ৫ ডিসেম্বর মন্ত্রী পরিষদের সভায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্টিত সেই সভায় ভুমি অধিগ্রহনের ক্ষতিপুরন মুল্য দেড়গুন থেকে বাড়িয়ে তিনগুন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। জানা যায়, চলমান ভুমিগ্রহন আইন ১৯৮২ সালের মার্শাল ল’ আমলে করা। তাই আইনটি যুগোপযোগী করা ও ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপুরন বাড়ানোর জন্য এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। অভিজ্ঞ মহলের মতে, সরকারের এ সিন্ধান্তের কারনে ভবিষ্যতে স্বল্পমুল্যে সমাজের ভুমিহীনদের ভুমি বরাদ্দের সরকারী উদ্যোগ থমকে যেতে পারে।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.