চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগে ম্যারাথন গ্রুপিং কোন্দল

0

জুবায়ের সিদ্দিকী,সিটি নিউজ ::  আসছে নির্বাচন! তৃনমুলে অগোছালো অবস্থা। নেতাদের ব্যস্ততা নিজেদের নিয়ে। সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ডের খবর, দেশে-বিদেশে জননেত্রী শেখ হাসিনার অর্জনগুলোর ফিরিস্তি জানেন না অনেক নেতাই। নগর আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যে ক্রমবদ্ধমান দ্বন্দ্ব ও গ্রুপিং যত দিন যাচ্ছে, নতুন মাত্রা লাভ করছে। নগর আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক ও চসিক মেয়র আ.জ.ম নাছির উদ্দিনের সঙ্গে দুরত্ব রয়ে গেছে মহিউদ্দিন চৌধুরী অনুসারীদের। নগরীর ৪১টি ওয়ার্ড ও ১৬ টি থাকা কমিটি মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারী।

বিগত মেয়র নির্বাচনে মহিউদ্দিন চৌধুরী মনোনয়ন না পাওয়ায় হতাশা নেমে আসলেও তার পুত্র মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হবার পর উজ্জীবিত হয়ে উঠেছে। মহিউদ্দিন চৌধুরীর মৃত্যুর পর এ অংশটির হাল ধরেছেন মহিউদ্দিন চৌধুরীর আস্থাভাজন নগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি খোরশেদ আলম সুজন ও নগর যুবলীগের যুগ্ন-আহবায়ক ফরিদ মাহমুদ প্রমুখ নেতারা। অপরদিকে মেয়র আ.জ.ম নাছির উদ্দিনের শক্ত প্রতিপক্ষ হিসেবে মাঠে অবস্থান নিয়েছেন নগরীর আরেক সেবা সংস্থা সিডিএ’র চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম। তিনি নগর আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ। নগরীর উন্নয়ন কর্মকান্ড নিয়ে এ দুই নেতার মধ্যে রয়েছে পরস্পর বিরোধী অবস্থান। এ ক্ষেত্রে সিডিএ চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম কিছুটা ভাল অবস্থানে রয়েছেন।

কারন তাঁকে প্রকাশ্যে সমর্থন দিচ্ছেন গনপুর্তমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন। সম্প্রতি তিনি সিডিএ’ চেয়ারম্যানের বেশ প্রশংসা করেন এবং চসিকের কঠোর সমালোচনা করেন। নগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ডা. আফসারুল আমিন এমপি ও মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি অনেকটা একলা চলো নীতিতে। এসব নেতারা প্রত্যেকে যার যার অনুসারীদের নিয়ে আলাদা বলয়ে রাজনীতি করছেন। সদ্য সমাপ্ত নগর আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভার পর গ্রুপিং রাজনীতি তো ভাটা পড়েনি বরং পেয়েছে নতুন মাত্রা।

নগর আওয়ামী লীগের প্রবীন নেতার মতে,’ ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাহতাব উদ্দিন চৌধুরীর বাসভবনে অনুষ্টিত এ বর্ধিত সভায় মেয়র আ.জ.ম নাছির কার্যত তৃনমুলের নেতাদের বক্তব্য শোনতে চাননি। এমনকি অনেক নেতাকে কথা বলতেই দেননি বলে অভিযোগ রয়েছে। ওই অনুষ্টানে উপস্থিত সিডিএ’র চেয়ারম্যানকে ইঙ্গিত করে ক্ষুদ্ধু বক্তব্য রাখেন যুগ্ন সাধারন সম্পাদক রেজাউল করিম চৌধুরী।

দক্ষিণ জেলার রাজনীতিতে সভাপতি মোসলেম উদ্দিন আহমেদের অবস্থান আরও সুদৃঢ হয়েছে। মিটে গেছে ভুমি প্রতিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝি ও দ্বন্দ্ব। তবে দক্ষিণ জেলায় প্রতিটি উপজেলায় রয়েছে আওয়ামী লীগের একাধিক গ্রুপ। বর্তমান এমপি ও উপজেলা চেয়ারম্যানদের অধিকাংশই মোসলেম উদ্দিনের অনুসারী বলে জানা গেছে। উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরেও একাধিক গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। সভাপতি নুরুল আলম চৌধুরীর নিজের এলাকা ফটিকছড়িতেই অবস্থা খারাপ।

সেখানে উপজেলা আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী পরিবারের বিপরীতমুখী অবস্থানে ফায়দা লুঠছে তরিকত ফেডারেশন। রাউজানে বর্তমান সংসদ সদস্য এবিএম ফজলে করিম চৌধুরীর বিপক্ষে এখাট্টা হচ্ছেন সাবেক ছাত্রনেতা মাহফুজুল হায়দার চৌধুরী রোটন ও দেবাশীষ পালিত প্রমুখ। দলের একটি অংশ আগামীতে নতুন প্রার্থী হিসেবে চান কেন্দ্রীয় যুবলীগ সভাপতি ওমর ফারুক চৌধুরী বা মাহফুজুল হায়দার চৌধুরী রোটনকে। তবে রাউজানে এ সরকারের আমলে বেশ উন্নয়ন কর্মকান্ড হয়েছে।

যার ধারাবাহিকতা চান এমপি ফজলে করিমের অনুসারীরা। উত্তর জেলার প্রতিটি উপজেলায় একই অবস্থা । গ্রুপিং-দ্বন্দ্বের কারনে অনেক নেতার মধ্যে চোখ দেখাদেখিও নেই। প্রকাশ্যে নেতারা বিষোধগার করেন একে অন্যের বিরুদ্ধে। নির্বাচনের দিন যত ঘনিয়ে আসছে নগর, উত্তর ও দক্ষিণে নতুন সম্ভাব্য প্রার্থীরা মাঠে নেমে পড়ায় মেরুকরন ঘটছে মাঠ পর্যায়ের রাজনীতিতে। আজকে এক নেতা তো কাল অন্য নেতার পক্ষে যাচ্ছেন তৃনমুলের নেতাকর্মীরা। এসব কারনে সংঘাত, সহিংসতা ও মামলা-হামলা ও প্রতিপক্ষ দমনের কৌশল আয়ত্ব করছে নেতারা।

নেতায় নেতায় দ্বন্দ্ব-গ্রুপিং ও আধিপত্য বিস্তারের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ এবং বেপরোয়া হয়ে উঠেছে ছাত্রলীগ। ক্ষমতাসীন দলের মুরব্বি ও জুনিয়র সংগঠন দুটিতেই শৃঙ্খলা ভেঙ্গে পড়েছে। আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে যেমন দুরত্ব আছে, একই ভাবে ছাত্রলীগের নেতাদের মধ্যে দাঙ্গা-হাঙ্গামা লেগে আছে। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের এসব অশান্ত ভুমিকার দোসর হিসেবে কাজ করছেন ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। এক্ষেত্রে নানা আলোচিত ঘটনায় যুক্ত থেকে অন্য সংগঠনের চেয়ে যুবলীগের নেতাকর্মীরা এগিয়ে আছে।

বিভিন্ন সময় আলোচিত ও ন্যাক্কারজনক ঘটনার সাথে সরকারী দলের নেতাকর্মীরা যুক্ত থাকলেও বিচার কিংবা শাস্তি না হওয়ায় তারা পুনরায় ঘটনার জন্ম দিতে উৎসাহিত হচ্ছে। বিগত সময়ে ঘটা রাজনৈতিক ঘটনাগুলোর কোনটিরই কামলা সম্পন্ন হয়নি। মাঝেমধ্যে কয়েকটা অভিযুক্ত নেতাকে সংগঠন থেকে বহিস্কার করলেও তারা পুনরায় রাজনীতিতে সক্রিয় হচ্ছেন। একবার ঘটনা করে পার পাওয়া নেতারাই আবারও ঘটনা করতে দ্বিধাবোধ করছেন না। তাদের আশ্রয়দাতা হিসেবে ভুমিকা পালন করছেন আওয়ামী লীগ নেতার্।

অথচ যারাই আশ্রয় পশ্রয় দিচ্ছেন তাদেরও একসময় মানতে চায় না উশ্চৃঙ্খল নেতাকর্মীরা। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন,’ শিক্ষার্থীদের অধিকার কিংবা দেশ ও জাতির বিরুদ্ধে চাপিয়ে দেয়া কোন অন্যায় অবিচারের প্রতিবাদ কর্মসুচী পালনের চেয়ে মারামারি হানাহানিতে আগ্রহ বেশি ছাত্রনেতাদের। এখানে নীতি আদর্শের কোন বিষয় নেই। ব্যক্তি স্বার্থই হল এদের হানাহানির প্রধান কারন। এক শ্রেনীর নেতারাও তাদের ব্যবহার করে ফায়দা লুটছে।

চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোছলেম উদ্দিন আহমদ বলেন,’ ছাত্রলীগের অনাকাঙ্খিত কর্মকান্ডগুলো অত্যন্ত দু:খজনক। আমরা ছাত্রলীগ করেই আজকে এই পর্যায়ে এসেছি। এসব নিয়ন্ত্রন করতে রাজনৈতিক নেতাদেরকেই দায়িত্ব নিতে হবে। অনেক সময় ঘটনার সাথে যুক্ত থাকা ব্যক্তিদের চেনা যায় না। হাইব্রিডরা দলে ঢুকে ঝামেলা করছে।

সংগঠনের দরজা খোলা রাখতে গিয়েই সমস্যা হচ্ছে। যে কেউ দলে ঢুকে যাচ্ছে। তবে জড়িতদের শাস্তি হলেই অনাকাঙ্খিত ঘটনার প্রবনতা কিছু কমবে। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের দায়িত্বশীল সুত্র মতে,’ ছাত্রলীগকে কোন ধরনের প্রশ্্রয় দেয়া হচ্ছে না। যারা সংঘাত-সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে তাদের অধিকাংশ ছাত্রলীগের পদ-পদবীতে থাকেন না। আর যাদের বিরুদ্ধে অপকর্মের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে. তাদের দল থেকে বহিস্কার করা হচ্ছে। ছাত্রলীগে কোন অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীর ঠাঁই নেই।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৬ সালের ২৮ মার্চ প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ কর্মী নাসিম আহমেদ সোহেলকে খুন করে নিজ সংগঠনের কয়েকজন কর্মী। প্রকাশ্যে ছরিকাঘাত করে তাকে হত্যা করলেও এ ঘটনায় এখনো বিচার হয়নি। ২০১৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষের ঘটনায় নিহত হন ছাত্রলীগ কর্মী তাপস সরকার। ২০১৫ সালের ২ সেপ্টেম্বর বায়েজিদ বোস্তামী থানাধীন শেরশাহ এলাকায় খুন হন যুবলীগ নেতা মেহেদি হাসান বাদল। ২০১৩ সালের ২৪ জানুয়ারী সিআরবি এলাকায় যুবলীগ নেতা হেলাল আকবর চৌধুরী বাবর ও সাইফুল আলম লিমনের অনুসারীদের মধ্যে গুলি বিনিময়কালে মারা যায় সাজু পালিত ও শিশু আরমান।

২০১৫ সালের ২ জুন পাঁচলাইশ থানার মোহাম্মদপুরে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের ছোড়া গুলিতে আসাদুল মিয়া নামে ১০ বছরের এক শিশুর মাথার খুঁলি উড়ে যায়। গত বছরের ৬ অক্টোবর সদরঘাট থানার দক্ষিণ নালাপাড়া এলকায় নগর ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক সুদীপ্ত বিশ্বাসকে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে খুন করে সন্ত্রাসীরা। ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের এক নেতার ইন্ধনে তাকে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের এক নেতার ইন্দনে তাকে হত্যা করা হয়েছে বলে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে অভিযোগ তোলা হয়। গত বছরের ২০ নভেম্বর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের বাসা থেকে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ন সম্পাদক দিয়াজ ইরফান চৌধুরীর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।

টেন্ডার বিরোধের জের ধরে নিজ সংগঠনের নেতাকর্মীরাই তাকে খুন করেছে বলে অভিযোগ উঠে। চট্টগ্রাম কলেজ ও মহসীন কলেজ দখলে নেয়ার পর অহরহ ছোটবড় ঘটনার জন্ম দিয়েছে ছাত্রলীগ। গত ১৪ জানুয়ারী নগর আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেতা মহিউদ্দিন চৌধুরীর শোকসভায় আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সামনেই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে ছাত্রলীগ।

সর্বশেষ এক সপ্তাহ আগে কয়েকজন যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীর হামলায় পন্ড হয়ে যায় উত্তর জেলা ছাত্রলীগের সম্মেলন। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও গনপুর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাধারন সম্পাদক এস.এম জাকির হোসেনের সামনে এ ঘটনা ঘটেছে। দুই সংগঠনের দুই সিনিয়র নেতা বারবার চেষ্টা করেও উশৃঙ্খল নেতাকর্মীদের থামাতে পারেননি।

নগর আওয়ামী লীগের একাধিক নেতার মতে, চট্টগ্রামে ছাত্রলীগ এতটাই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে যে এখানে তাদের সামার দেওয়ার মত কেউ নেই। গত এক মাসে নগর ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে একের পর এক ঘটনা ঘটলেও কেউ কিছু বলছে না। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের নেতারাও ব্যবস্থা নিচ্ছেন না। মাঝেমধ্যে কয়েকটি মামলা হলেও সুযোগসন্ধানী নেতাদের কারণে জামিনে এসে আবারও খারাপ ঘন্টার জন্ম দেন এসব ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.