জলজট-যানজটে পর্যুদস্ত নগরবাসী

0

ঢাকা অফিস  : মাত্র ৪২ মিলিমিটার বৃষ্টিতে নাভিশ্বাস নগর ঢাকা। অধিকাংশ এলাকার রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে জলজট-যানজটে পর্যুদস্ত এক কোটির বেশি নাগরিক। প্রতিনিয়ত শব্দ ও বায়ুদূষণে ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত মহানগরে গতকাল ছিল অন্যতম স্তব্ধতা। গাড়ির বেপরোয়া হর্ন, ধুলো ও ধোঁয়া ছিল না। পরিবর্তে বাড়তি ভোগান্তি, নাগরিক অসহায়ত্ব ও নীতিগত অদূরদর্শিতার প্রদর্শনী ছিল।

কলাবাগানের অধিবাসী আরমান আলী জরুরি কাজে মগবাজার গিয়েছিলেন। বৃষ্টির পর গাড়ি ছিল না। তাই হেঁটেই রওনা হন। কিন্তু বিজিএমইএ ভবনের সামনে আর পথচলা সম্ভব ছিল না। পরে তিনি ১০ টাকার বিনিময়ে ভ্যানে রাস্তা পার হন।

আবহাওয়া অধিদফতরের আবহবিত আবদুল মান্নান জানান, গতকাল দুপুর ১২টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত রাজধানীতে ৪২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। দুপুর ১২টার পর বৃষ্টি হলেও তা পরিমাণে কম ছিল। গতকাল দেশের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত হয়েছে টেকনাফে ১১২ মিলিমিটার (টেকনাফ কোনো নগর নয়, তাই সেখানে জলাবদ্ধতা ছিল না)।
কয়েক ঘণ্টার মুষল ধারাপাত শেষে রাজধানীর পাঁচ তারকা হোটেল সোনারগাঁওয়ের সামনে কোমরসমান পানি জমে যায়। কারওয়ান বাজারের বিজিএমইএ ভবনের সামনে থেকে সোনারগাঁও মোড় পর্যন্ত রিকশা-ভ্যানে জনপ্রতি ১০ টাকার বিনিময়ে পারাপার হয়েছেন অফিসপাড়ার ব্যস্ত মানুষ।
গতকালের নাগরিক ভোগান্তি সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক বলেন, গত ১৫-২০ বছরে রাজধানীর ওপর যে জুলুম-অত্যাচার হয়েছে, তার ফল এখন ভোগ করতে হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে সময়ের প্রয়োজন। জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পেতে আগামী বছর স্বল্পমেয়াদি কয়েকটি কর্মসূচি নেয়া হবে।
কথা প্রসঙ্গে মেয়র জানান, গতকাল নগরীর যানজট নিয়ে একটি সভা হয়। তীব্র যানজটে আটকা পড়ে একজন সচিব সভায় যোগ দিতে পারেননি। ওই সভায়ও জলাবদ্ধতা নিয়ে আলোচনা হয়েছে জানিয়ে মেয়র বলেন, ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নতি ছাড়া এ অবস্থা থেকে বের হওয়ার কোনো পথ নেই।
ঢাকার ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নতির আবশ্যকতার কথা বলা হচ্ছে বহু বছর ধরে। প্রায় তিন দশক ধরে এ শহরের অভিভাবকত্বের দায়িত্ব পেতে মেয়ররা অন্য অনেক প্রতিশ্রুতির পাশাপাশি ড্রেনেজ ব্যবস্থা উন্নয়নের কথা বলছেন।
কিন্তু ঢাকার জলনিষ্কাশন সক্ষমতা দিন দিন কমছে। স্থপতি ইকবাল হাবিব জানান, ২০০৪ সালে রাজধানীতে একদিনে ৩০০ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছিল। তখন পানি কয়েক ঘণ্টায় সরে গিয়েছিল। আর এখন ৮০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হলে নগরবাসীকে পানিতে তলিয়ে থাকতে হচ্ছে।
গতকাল বেলা ১১টার দিকে রাজধানীতে বৃষ্টি শুরু হয়। প্রবল বর্ষণে পুরান ঢাকার হোসেনী দালান, নাজিমউদ্দিন রোড, জেলখানার মোড়, আগাসাদেক রোড, আগামাসি লেন, সিক্কাটুলি, বংশাল, কাজী আলাউদ্দিন রোড থেকে শান্তিনগর, রাজারবাগ, মতিঝিল, আরামবাগ, মৌচাক, বাংলামোটর, কারওয়ান বাজার, হোটেল সোনারগাঁও মোড়, মোহাম্মদপুর হয়ে নবীন ঢাকার সংসদ ভবন এলাকা, মিরপুর রোড, তেজতুরি বাজার, নাখালপাড়া, কাজীপাড়া, বিজয় সরণি, বিমানবন্দর সড়ক, গ্রিন রোডসহ বিভিন্ন এলাকার সড়ক পানিতে তলিয়ে যায়। অনেক এলাকায় চলতি যানবাহনে পানি ঢুকে পড়ায় তা বিকল হয়ে পড়ে।
গতকাল বেলা ৩টার পর রাজধানীতে শুরু হয় তীব্র যানজট। নগরীর অনেক সড়কে পানি জমে যাওয়ায় যানবাহনগুলো উঁচু সড়কে চলাচলের চেষ্টা করে। গতকাল রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাব, হাইকোর্ট, মত্স্য ভবন, কাকরাইল, মিন্টো রোড, শাহবাগ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম সরণি, মগবাজার, মালিবাগ, মৌচাক, কারওয়ান বাজার এফডিসি মোড়, সাতরাস্তা, মহাখালী, বনানী, মিরপুর কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, আগারগাঁও, তালতলাসসহ বিভিন্ন সড়কে তীব্র যানজট ছিল। যানজটে আটকে নগরবাসীকে কোথাও কোথাও ১০ মিনিটের পথ অতিক্রম করতে হয়েছে দেড়-দুই ঘণ্টায়।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার (ডিসি মিডিয়া) মুনতাসিরুল ইসলাম বলেন, গতকাল যানজটের অন্যতম কারণ ছিল অতিবৃষ্টি। বৃষ্টিতে সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও পুরনো যানবাহন বিকল হয়ে পড়ে। এগুলো সরাতে রেকার ব্যবহার করায় সড়কগুলোয় যানজট দেখা দেয়। ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে অনেক এলাকায় ফুটপাত তলিয়ে যায়। ফলে মানুষ রাস্তার ওপর উঁচু জায়গায় চলে এলে যানবাহনের গতি কমে যায়। ডিএমপির এ ডিসি নগরের ড্রেনেজ ব্যবস্থা দ্রুত উন্নত করতে কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি কামনা করেছেন।
সকালে রাজধানীতে কোনো বৃষ্টি ছিল না। এ কারণে অনেকে বৃষ্টির প্রস্তুতি ছাড়াই পথে নামে। কিন্তু হঠাত্ ভারি বৃষ্টিতে রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয় তাদের। বিকাল পর্যন্ত রাস্তাঘাটে পানি জমেছিল। এতে ঘরমুখো মানুষের দুর্ভোগ বেড়ে যায়। বৃষ্টির পর রাজধানীর অধিকাংশ সড়ক যানজটে আটকা ছিল।
স্থপতি ইকবাল হাবীব এ প্রসঙ্গে বলেন, দিনের অধিকাংশ সময় বৃষ্টিপাত হওয়ায় যে দুর্ভোগ হয়, তা লোকজনের মেনে নেয়ার মানসিকতা তৈরি হয়েছে। কিন্তু হঠাত্ স্বল্প সময়ের বৃষ্টিতে পুরো নগর ও নগরবাসী পানিতে তলিয়ে যাবে, এমন দুর্ভোগ সহজে মেনে নেয়া যায় না।
নগর বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, রাজধানী ও সংলগ্ন এলাকায় আশঙ্কাজনক হারে জলাশয়, নিচু ভূমি, খাল ও ড্রেনেজ ভরাট হচ্ছে। পাশাপাশি একদিকে নির্মাণ হচ্ছে অপরিকল্পিত ইমারত, অন্যদিকে কমছে খালি জমির পরিমাণ। এতে সামান্য বৃষ্টিতেই নগরী পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। রাজধানীবাসীকে দুর্ভোগের হাত থেকে বাঁচাতে খালগুলো পুনরুদ্ধার ও নগরীর ড্রেনগুলোর প্রবাহ নদীমুখী করতে হবে। ড্রেনেজ ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে রাজধানীতে একক সংস্থাকে দায়িত্ব দিতে হবে।
নগর বিশেষজ্ঞরা আরো বলেন, বছরের মে থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বেশি বৃষ্টিপাত হয়। এ সময় বৃষ্টিতে অনেক এলাকায় পানি জমে যায়। ড্রেনেজ অব্যবস্থাপনার কারণে রাজধানীতে জলজট হচ্ছে। রাজধানীর খালগুলোকে বক্স কালভার্টে পরিণত করা হয়েছে। ড্রেন পরিষ্কার করে ময়লা-আবর্জনা পাশেই ফেলা রাখা হচ্ছে। এতে আবর্জনা আবারো ড্রেনে গিয়ে পড়ছে। একইভাবে বাড়িঘর নির্মাণের মালাপত্রও যেখানে সেখানে ফেলা রাখা হচ্ছে।
প্রসঙ্গত, গত শনিবার ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন আয়োজিত এক সেমিনারেও বিশেষজ্ঞরা নগরকে বাঁচাতে হলে জলাভূমি ভরাট করা চলবে না বলে মতপ্রকাশ করেন। জলজটের সমস্যা নিরসনে জরুরি ভিত্তিতে টাস্কফোর্স গঠনের পরামর্শ দেয়া হয় ওই সেমিনারে।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.