চালের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়াচ্ছে ব্যবসায়ীরা

0

সিটি নিউজ ডেস্ক :: প্রস্তাবিত বাজেটে ২৮ শতাংশ শুল্ক পুনর্বহালের ঘোষণার পরপরই চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন বড় ব্যবসায়ীরা।

পরিকল্পিতভাবে সরবরাহ চেইনে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে আগের চেয়ে প্রতি কেজি চালে ৩-৪ টাকা বেশি দাম নিচ্ছেন। তাই বাজারে চালও ছাড়ছেন কম। অথচ এ চাল আমদানিকারকরা আগেই কিনেছেন। এ ক্ষেত্রে তাদের কোনো শুল্ক দিতে হয়নি। এ অবস্থায় দাম বাড়ার কোনো যৌক্তিকতা না থাকলেও শুধু অধিক মুনাফার লোভে কারসাজি করে দাম বাড়াচ্ছে।

এদিকে শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানি করা চালের দাম বৃদ্ধির হুজুগে দেশে উৎপাদিত চালের দামও বাড়ছে প্রায় একই হারে। এর প্রভাব পড়েছে সারা দেশে চালের পাইকারি বাজারে।

চট্টগ্রামের পাইকারি বাজারে শুল্ক বাড়ানোর অজুহাত তুলে শনিবার কেজিপ্রতি চালে ২-৩ টাকা দাম বাড়ানো হয়। রোববার তা কেজিপ্রতি আরও এক টাকা বেড়ে যায়। বর্তমানে পাইকারি বাজারে সব ধরনের চালের দাম বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) ১০০-১৫০ টাকা বেড়েছে। গত সপ্তাহে প্রতি বস্তা বেতি-২৮ ও বেতি-২৯ আতপ চাল বিক্রি হয়েছে যথাক্রমে ১৮৫০ ও ১৭০০ টাকায়।

বাজেট ঘোষণার পর তা বিক্রি হচ্ছে যথাক্রমে ১৯৫০ ও ১৮২০ টাকায়। মোটা চালের দাম ছিল বস্তাপ্রতি ১৫০০ টাকা, এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৭০০ টাকায়। চট্টগ্রামের পাহাড়তলী পাইকারি বাজারে বৃহস্পতিবার বাজেট ঘোষণার দিন ভারত থেকে আমদানি করা স্বর্ণা সেদ্ধ চালের ৫০ কেজির বস্তা বিক্রি হয়েছিল ১ হাজার ৯৫০ টাকায়। এখন তা বস্তাপ্রতি ১৫০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ১০০ টাকা।

বাজেট ঘোষণার পর এভাবেই ব্যবসায়ীরা সারা দেশে প্রতিদিন ৯০ হাজার টন মোটা, মাঝারি ও সরু চাল বিক্রি করে ২৭ কোটি থেকে ৪৫ কোটি টাকা পর্যন্ত অতিরিক্ত মুনাফা লুটে নিচ্ছেন। বাজেট ঘোষণার পর গত তিন দিনে ৮১ কোটি থেকে ১৩৫ কোটি টাকা পর্যন্ত বাড়তি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা।

যে টাকার পুরোটাই যাচ্ছে ভোক্তাদের পকেট থেকে। পাইকারি ও খুচরা বাজারে চালের দামের সর্বশেষ পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে অতিরিক্ত মুনাফার এ হিসাব পাওয়া গেছে। প্রসঙ্গত দেশে প্রতিদিন ৯০ হাজার টন চালের চাহিদা রয়েছে।

দেশে এ মুহূর্তে চালের কোনো ঘাটতি নেই। সরবরাহ পর্যায়েও সংকট হওয়ার কথা নয়। গত বছর দেশে চাল নিয়ে যে সংকট তৈরি হয়েছিল, সেই পরিস্থিতির অনেক আগেই উন্নতি ঘটেছে। ঘাটতি পূরণে সরকার চাল আমদানি উন্মুক্ত করে দিয়েছে। আমদানি উৎসাহিত করতে পণ্যটির ওপর আরোপিত ২৮ শতাংশ শুল্ক তুলে নেয়া হয়। এর ফলে দেশে চাল আমদানি বেড়েছে।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে এ বছর সব কটি ধানের মৌসুমে দেশে প্রায় সাড়ে তিন কোটি লাখ টন ধান উৎপাদিত হবে। এরই মধ্যে ৬৫ শতাংশ ধান কাটা হয়ে গেছে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের প্রদত্ত তথ্যমতে, সরকারের খাদ্যগুদামে এখন ১০ লাখ টনের বেশি চাল মজুদ আছে। স্থানীয় বাজার থেকে আরও কেনা হচ্ছে ৯ লাখ টন চাল ও ১ লাখ টন ধান। অন্যদিকে গত এক বছরে সব মিলিয়ে ৮০ লাখ টন চাল আমদানি হয়েছে।

এর মধ্যে ৩৯ লাখ টন দেশে বাজারজাত পর্যায়ে রয়েছে। এ ছাড়া চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের ২৬ মে পর্যন্ত সময়ে আমদানির জন্য এলসি খোলা হয়েছে ৪৬.৪৩ লাখ টনের। এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে ৪০.৬৮ লাখ টন। এসব চাল শুল্কমুক্ত সুবিধা এবং ব্যাংকঋণের সুবিধা নিয়ে আমদানি করা হয়েছে। এ অবস্থায় চালের কোনো সংকট নেই বা অদূর ভবিষ্যতেও হওয়ার আশঙ্কা নেই।

এরপরও চালের দাম বাড়ছে। ব্যবসায়ীদের একটি অংশের দাবি- চালের মতো স্পর্শকাতর পণ্যে অযৌক্তিক দাম বাড়িয়ে নির্বাচনী বছরে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে চাইছে কারসাজিতে জড়িত অধিক মুনাফালোভী চক্রটি। যা সরকারের ভোটবাক্সে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।

বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, সরকার কৃষকের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য চালের আমদানি শুল্ক পুনর্বহাল করেছে। বাজেটে শুল্ক পুনর্বহালের অজুহাতে কেউ যদি আমদানি চালে অযৌক্তিক দাম বাড়ানোর চেষ্টা করে, তাহলে দায়ী সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখছি। সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করে বাজারে এমন অপতৎপরতা কাউকেই করতে দেয়া হবে না বলে জানান তিনি।

তবে খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম বলেন, কৃষকের স্বার্থরক্ষার জন্য শুল্কারোপ হওয়ায় বাজারে চালের দাম এক-দুই টাকা বাড়লে কোনো ক্ষতি নেই। কারণ যে কৃষক আগে প্রতি মণ ধানে ৬০০-৬৫০ টাকা পেত, শুল্ক পুনর্বহালের কারণে তারা সেই পরিমাণ ধানে ৭০০-৭৫০ টাকা পাচ্ছে।

এতে তাদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত হচ্ছে তিনি দাবি করেন। এর কারণে বাজারে কোনো নেতিবাচক প্রভাব নেই। দাম নিয়ে ক্রেতার কোনো হাহাকার নেই। দাম স্বাভাবিক ও স্থিতিশীল আছে। এ নিয়ে দুশ্চিন্তার কোনো কারণ আছে বলে আমি মনে করি না।

 

চট্টগ্রাম চাল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি এনামুল হক বলেন, পাইকারি বাজারে চালের দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি ৩-৪ টাকা। আমদানিকারক ও মিলার যাদের হাতে চালের স্টক রয়েছে, তারা চাল না ছাড়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। চালের দাম আরও বাড়তে পারে। কারণ ২৮ শতাংশ শুল্ক যোগ হলে প্রতি কেজি চালের দাম বাড়বে ৮-১০ টাকা পর্যন্ত। আমদানিকারকরা আগের বিনা শুল্কে আনা চাল এখনও বিক্রি করছেন। শুল্কমুক্ত সুবিধার চাল অধিক মুনাফা রেখে বিক্রি কোনোভাবেই কাম্য নয়।

বাজারে চালের দাম বাড়ার নেপথ্য কারণ উল্লেখ করে কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিলে এ পরিস্থিতির মুখে পড়তে হতো না। আবার শুল্ক পুনর্বহালের ঘোষণাটিও এত হাঁকডাক দিয়ে বলার কিছু ছিল না। সরকার চালে আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার এবং পুনর্বহাল দুটির একটি সিদ্ধান্তও সঠিক সময়ে নিতে পারেনি।

এখন অসাধু ব্যবসায়ীরা সরকারের সেই একটা ঘোষণারই সুযোগ নিচ্ছে। দাম বাড়ার কারণ দেখিয়ে কাউকে বেঁধে নিয়ে আসাও কোনো যৌক্তিক সমাধান নয়। তাহলে বাজার আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে মজুদ এবং সরবরাহ ভালো হলে দাম বাড়ার কোনো সুযোগ নেই। বাড়লেও সেটা সাময়িক। এটা আবার কমতে বাধ্য।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম লস্কর বলেন, শূন্য শুল্কের সুবিধায় আমদানি করা চাল বেশি দামে বিক্রি করা অন্যায়। নৈতিকতাবোধের অভাব এমন ব্যবসায়ীরা ভোক্তার জন্য সব সময়ই ক্ষতিকর। তবে আমরা ভোক্তার স্বার্থরক্ষায় বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখব। শিগগিরই চালের বাজারে অভিযানে নামব। সেখানে তাদের এলসি রেট, খালাসের সময়, মজুদ ও ক্যাশমেমো পর্যালোচনা করলেই কতটা অযৌক্তিক মুনাফা করছে সব বেরিয়ে আসবে।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.