জনতা ব্যাংকের ১১ হাজার কোটি টাকা ৪ গ্রুপের পকেটে

0

অর্থ ও বাণিজ্য, সিটি নিউজ :: দেশের ব্যাংক খাতে বারবার আলোচনায় উঠে আসে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের নাম। বিতর্কিত ও জালিয়াত চক্রই এই ব্যাংকের বড় বড় গ্রাহক। জনতা ব্যাংকের অন্যতম গ্রাহকদের মধ্যে রয়েছে— হলমার্ক, বিসমিল্লাহ, ক্রিসেন্ট ও অ্যানন টেক্স গ্রুপ। এই চারটি গ্রুপ কখনও আমদানির নামে টাকা নিয়েছে, কখনও টাকা নিয়েছে ভুয়া রপ্তানির নথিপত্র তৈরি করে। আর জনতা ব্যাংকও এসব গ্রাহকের হাতে তুলে দিয়েছে হাজার কোটি টাকা।

জনতা ব্যাংক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, আমদানি ও রপ্তানির নামে জনতা ব্যাংক থেকে লোপাট করা হয়েছে প্রায় ১১ হাজার ২৯০ কোটি টাকা। এসব অর্থ ফেরত আসার সম্ভাবনা খুবই কম। ব্যাংকটির কিছু অসাধু কর্মকর্তার সঙ্গে যোগসাজশে কিছু চিহ্নিত ব্যবসায়ী এই বিপুল পরিমাণ টাকা আত্মসাৎ করেছে।

হলমার্ক গ্রুপঃ

জনতা ব্যাংকের কর্পোরেট শাখায় আনোয়ারা স্পিনিং মিলস ও ম্যাক্স স্পিনিং মিলের নামে দুটি হিসাব খোলা হয় ২০১১ সালের ৮ জুন। নথি অনুযায়ী, আনোয়ারা স্পিনিং মিলের মালিক জাহাঙ্গীর আলম এবং ম্যাক্সের মালিক মীর জাকারিয়া। এই দুই হিসাবের পরিচয়দানকারী হলেন ববি স্পিনিং মিলের মালিক তানভীর মাহমুদ। তিনি হলমার্ক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি)।

জনতা ব্যাংকের কর্পোরেট শাখা ওই দুই প্রতিষ্ঠানের নামে হিসাব খোলার পরপরই তাদের সব বিল কেনা শুরু করে। বিলে দেখানো হয়েছে— হলমার্ক ফ্যাশনসহ এই গ্রুপের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কয়েকটি প্রতিষ্ঠান স্থানীয়ভাবে সুতা আমদানির জন্য আনোয়ারা ও ম্যাক্স স্পিনিংয়ের অনুকূলে সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা শাখায় স্থানীয় ঋণপত্র স্থাপন করে। জনতা ব্যাংকের কর্পোরেট শাখা এই বিল কিনে নেয় এবং সেই পরিমাণ অর্থ আনোয়ারা ও ম্যাক্স স্পিনিং মিলের হিসাবে জমা দিয়ে দেয়।

এভাবে ওই দুই প্রতিষ্ঠান জনতা ব্যাংক থেকে তুলে নেয় ৮৩ কোটি ৬৭ লাখ ৫৯ হাজার টাকা। তখন এই অর্থ আত্মসাতের জন্য জনতা ব্যাংকের কর্পোরেট শাখার ব্যবস্থাপক আবদুস সালাম আজাদসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। অভিযোগ আছে, একইভাবে জনতা ব্যাংকের স্থানীয় কার্যালয় প্রায় ২৬ কোটি ৫৯ লাখ টাকা আত্মসাতের সুযোগ করে দেয় সোহেল স্পিনিং মিল নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠানকে।

উল্লেখ্য, জনতা ব্যাংকের করপোরেট শাখার ব্যবস্থাপক আবদুস সালাম আজাদকে শাস্তির বদলে সরকার ব্যাংকটির এমডি পদে নিয়োগ দিয়েছে।

বিসমিল্লাহ গ্রুপঃ

২০১১ সালে ভুয়া রপ্তানি দেখানো, বিদেশে প্রতিষ্ঠান খুলে তার মাধ্যমে অতিমূল্যায়ন করে বাংলাদেশ থেকে আমদানি এবং এর মাধ্যমে রপ্তানিকে উৎসাহিত করতে সরকারের দেওয়া নগদ সহায়তা হাতিয়ে নেওয়া শুরু করে বিসমিল্লাহ গ্রুপ। ওই সময় জনতা ব্যাংক থেকে ৩৯২ কোটি ৫৭ লাখ টাকা তুলে নিয়েছে এই প্রতিষ্ঠানটি। বিসমিল্লাহ গ্রুপের কাছে বর্তমানে জনতা ব্যাংকের পাওনা রয়েছে ৫৫০ কোটি টাকা।

বিসমিল্লাহ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) খাজা সোলেমান আনোয়ার চৌধুরী। আর প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান হলেন তার স্ত্রী নওরীন হাসিব। তারা দুজনই এখন দেশের বাইরে অবস্থান করছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিসমিল্লাহ গ্রুপ ভুয়া রপ্তানি দেখিয়ে, বিদেশে প্রতিষ্ঠান খুলে তার মাধ্যমে অতিমূল্যায়ন করে বাংলাদেশ থেকে আমদানি এবং এর মাধ্যমে রপ্তানিকে উৎসাহিত করতে সরকারের দেওয়া নগদ সহায়তার অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে। এর বাইরে তারা নিজস্ব প্রতিষ্ঠানের খোলা স্থানীয় এলসি (ঋণপত্র) দিয়ে এবং আরেক (এটাও নিজস্ব) প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি নিয়ে বিল তৈরি করে (অ্যাকোমুডেশন বিল)তা ব্যাংকে জমার মাধ্যমে প্রায় ১১০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।

অ্যানন টেক্স গ্রুপঃ

অ্যানন টেক্স গ্রুপের মো. ইউনুস বাদলকে দেওয়া হয়েছে তিন হাজার ২০০ কোটি টাকার ঋণ ও ঋণ সুবিধা। ইউনুস বাদলের কোম্পানিগুলোর নামে বিভিন্ন সময়ে কাঁচামাল আমদানির জন্য ঋণপত্র খোলা হলেও তিনি ব্যাংকটিকে কোনও টাকা পরিশোধ করেননি। ইউনুস বাদলের প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষে জনতা ব্যাংক বিদেশি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানকে আমদানির টাকা শোধ করে দিয়েছে।

কিন্তু পরেও গ্রাহক ওই টাকা পরিশোধ করেনি। এভাবে নেওয়া ঋণসুবিধার (নন-ফান্ডেড) সব অর্থই সরাসরি ঋণে (ফান্ডেড) পরিণত হয়েছে। আবার দৈনন্দিন ব্যবসা পরিচালনার জন্য নেওয়া চলতি মূলধনও (সিসি ঋণ) ফেরত দেয়নি এই প্রতিষ্ঠানটি। অ্যানন টেক্স গ্রুপের কাছে জনতা ব্যাংকের বর্তমানে পাওনা রয়েছে পাঁচ হাজার ৫১০ কোটি টাকা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, জনতা ব্যাংকের বর্তমান এমডি (ব্যবস্থাপনা পরিচালক) আবদুছ ছালাম আজাদ এবং তৎকালীন এমডি এসএম আমিনুর রহমান দুজনই ইউনুস বাদলের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ঋণ দেওয়ার ব্যাপারে অতি উৎসাহী ছিলেন। আবদুছ ছালাম আজাদ ঋণের প্রস্তাব পাঠাতেন। আর এসএম আমিনুর রহমান ব্যাংকের বোর্ডে তা উপস্থাপন করতেন। ব্যাংকটির বোর্ডের সদস্যরাও কোনও বাছবিচার ছাড়াই সেই ফাইল পাস করে দিতেন।

ব্যাংকটির তৎকালীন এমডি এসএম আমিনুর রহমান বলেন, আমার সময়ে ইউনুস বাদলের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ঋণ সুবিধা পেলেও তাতে আমার কোনও হাত ছিল না। আমি চলে আসার পরও ইউনুস বাদলের প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণসুবিধা পেয়েছে।

ক্রিসেন্ট গ্রুপঃ

বিসমিল্লাহ গ্রুপকে অনুকরণ করে জনতা ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে ক্রিসেন্ট গ্রুপও। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে— চামড়া খাতের কোম্পানি ক্রিসেন্ট লেদারের রপ্তানির অর্থ দেশে না আসলেও নিয়ম-নীতি লঙ্ঘন করে একের পর এক বিল কিনেছে জনতা ব্যাংক। ভুয়া রপ্তানি বিল কিনে গ্রুপটির হাতে নগদে টাকা দিয়েছে জনতা ব্যাংক। এখন রপ্তানির টাকা ফেরত আসছে না।

এর বাইরে সরকারের নগদ সহায়তা তহবিল থেকেও ক্রিসেন্ট গ্রুপ নিয়েছে এক হাজার ৭৫ কোটি টাকা। বিদেশে রপ্তানির এক হাজার ২৯৫ কোটি টাকা আটকা রয়েছে। সব মিলিয়ে গ্রুপটি সরকারি ব্যাংক ও সরকারের তহবিল থেকে ২০১৩ সাল থেকে এ বছরের মার্চ পর্যন্ত পাঁচ বছরে নিয়ে নিয়েছে পাঁচ হাজার ১৩০ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রপ্তানি বিল কেনার ক্ষেত্রে প্রচলিত নিয়ম মানেনি জনতা ব্যাংক। বিলের সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়নি তারা। রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান টাকা দিতে পারবে কি না, সে ব্যাপারে কোনও খোঁজখবর নেয়নি ব্যাংকটি।

জনতা ব্যাংকের ইমামগঞ্জ করপোরেট শাখায় মোট ঋণের পরিমাণ প্রায় ২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ক্রিসেন্ট গ্রুপের ছয় প্রতিষ্ঠানের কাছে ব্যাংকটির ঋণ ২ হাজার ৭৬০ কোটি টাকা। গ্রুপটির মালিক এম এ কাদেরকে ফোন করা হলে তিনি কোনও মন্তব্য করেননি। পরে কথা বলবেন জানিয়ে মোবাইল ফোনে এসএমএস দিলেও পরেও কথা বলেননি তিনি।

এদিকে, জালিয়াতির মাধ্যমে ক্রিসেন্ট গ্রুপকে সহায়তা করার দায়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশে গত মার্চ মাসে ১০ জন কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করেছে জনতা ব্যাংক। অন্যদিকে, জনতা ব্যাংকের হিসাব থেকে এবং নগদ সহায়তার ৪০৮ কোটি টাকা কেটে সরকারের কোষাগারে জমা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এছাড়া, ইমামগঞ্জ করপোরেট শাখার বৈদেশিক ব্যবসার লাইসেন্সও (এডি লাইসেন্স) স্থগিত করে বাংলাদেশ ব্যাংক।

উল্লেখ্য, জালিয়াতির বিষয়টি প্রথমে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি বিশেষ তদন্তে ধরা পড়ে। পরে এ বিষয়ে জনতা ব্যাংককে একটি চিঠি পাঠিয়ে আরও বিস্তারিত তদন্ত ও জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পরে জনতা ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন চার কর্মকর্তাকে নিয়ে গঠিত কমিটি তদন্ত শেষে গত ১৮ মার্চ ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) কাছে এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন জমা দেয়।

জনতা ব্যাংকের নিজস্ব তদন্ত প্রতিবেদনেও বলা হয়— গ্রাহক প্রতিষ্ঠানগুলো ও শাখা ব্যবস্থাপনার পারস্পরিক সমঝোতায় ২০১৭ সালের ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকের ওই পরিমাণ টাকা বের করে নেওয়া হয় বলে প্রতীয়মান হয়েছে।

জনতা ব্যাংকের এমন পরিস্থিতিকে দুর্ভাগ্য বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, হলমার্ক ও বিসমিল্লাহ গ্রুপের অনিয়মের জন্য শাস্তি দেওয়া হলে, নতুন করে একই ঘটনা আর ঘটতো না। সুশাসন না থাকাই এই জালিয়াতির প্রধান কারণ।

 

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.