মানবতার অনন্য দৃষ্টান্ত কাউন্সিলর মোরশেদ আলম
এম এ হোসাইন, সিটি নিউজ : কয়েকদিন আগে পত্রিকার পাতায় একটি ছবি দেখেই মূলত আমার আজকে লিখতে বসা। ছবিতে দুইজন ব্যক্তির কোলে দুইজন শিশু কন্যাকে দেখা যায়। তবে এ দুই কন্যা তাদের নয়। কিন্তু মা-বাবার আদরে তারা কন্যা দুটিকে তাদের কোলজুড়ে নিয়েছেন। কন্যা সন্তান দুটি এক পাগলীর (মানসিক সমস্যায় জজরিত নারীর)। একটি কবরস্থানে আশ্রয় নেওয়া দুকন্যাসহ মহিলাটিকে সুস্থ্য ও কন্যাদের সুষ্ট পরিবেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ হিসেবে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের শুলকবহর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোরশেদ আলম দম্পতি এমন মহান মানবিক দায়িত্ব নিয়েছেন। এমন মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন কাজের জন্য কাউন্সিলর মোরশেদ দম্পতিকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
যুগ যুগ ধরে কিছু মহান ব্যক্তি মহান সব অনুকরনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেলেন। এসব মহান ব্যক্তিদের অনুকরনীয় কাজের কারণেই তাঁরা মহান হন। মানুষের মাঝে হাজার বছর বেঁচে থাকেন। ব্যতিক্রমী মানুষ হিসেবে সবার মনে স্থান করে থাকেন। মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নেওয়া এমন মানুষের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। এখন আমরা সবাই নিজে নিয়ে ব্যস্ত থাকছি। আত্মকেন্দ্রিকতা আমাদের সামাজিকতাকেও আঘাত করতে শুরু করেছে। আমাদের বন্ধনগুলো যেনো দিনে দিনে নড়েবড়ে হয়ে যাচ্ছে। নিজের মা-বাবা, ভাই-বোনের খবরও আমরা নিচ্ছি না। শুধু নিজের সুখের কথাই চিন্তায় মত্ত্ব হয়ে যাচ্ছি।
পত্রিকার পাতা খুললেই আমরা খুন, হত্যা, ধর্ষণ, ডাকাতি, আন্দোলন-সংগ্রাম আরো কত কি সংবাদ পাই। মানবতার সংবাদ কতটুকুই বা পায়। তাহলে কি দেশে ভালো মানুষ নেই? আছে, অবশ্যই আছে। ভালো মানুষ আছে বলেই দেশটা আজো ঠিকে আছে। স্বার্থের উর্দ্বে থেকে কিছু মানুষ কাজ করছে বলেই আজো আমরা ঠিকে আছি। সংখ্যায় কম হলেও এখনো আমরা কিছু ভালো সংবাদ দেখি। যাদের স্যালুট করতে মন চায়। অন্তরের অন্তস্থল থেকে তাদের জন্য দোয়া করি। এসব মানুষগুলোই আমাদের পথপ্রদর্শক হয়ে থাকবেন আজীবন।
কাউন্সিলর মোরশেদ আলম যে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তিনি কবরস্থান থেকে একজন মানসিক প্রতিবন্ধিকে তুলে আনলেন। দুই শিশুর স্বাভাবিকভাবে জীবন যাপনের জন্য একটি আশ্রয়কেন্দ্রে ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, নিয়মিত তাদের দেখাশোনা ও খোঁজ খবর নিচ্ছেন। নিজের পরিবারকে নিয়ে অত্যন্ত আদর মমতা বিলিয়ে দিয়েছেন এসব শিশুদের জন্য।
জানতে পেরেছি, শুলকবহর ওয়ার্ডের এমইএস কলেজ সংলগ্ন বায়তুল জান্নাত কবরস্থানে দুই শিশু কন্যাকে নিয়ে এক সপ্তাহ ধরে বসবাস করছে এক মা। ছোট শিশুটির বয়স প্রায় এক বছর। দ্বিতীয়টির বয়স প্রায় তিন বছর। মায়ের কথায় কিছুটা অসংলগ্নতা থাকলেও শিশু দুইটি বেশ চনমনে।কবরস্থানে এক সপ্তাহেরও বেশি সময় থাকার পর স্থানীয়দের বিষয়টি নজরে আসে।
তারা আশংঙ্কা করতে থাকেন, এভাবে থাকলে অবুঝ শিশু দুইটির বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। এমনকি মৃত্যুও ঘটতে পারে। কিন্তু নাম ঠিকানাহীন অসহায় এই পরিবারের সহযোগিতায় কেউ এগিয়ে আসার সাহস পায়নি। এরই মধ্যে স্থানীয় কাউন্সিলর মোরশেদ আলম বিষয়টি জানতে পারেন। কাউন্সিলর ছুটি যেন কবরস্থানে। কথা বলেন মানসিক প্রতিবন্ধি মহিলাটির সাথে। কাউন্সিলর বুঝতে পারেন, ফুটফুটে দুই শিশু কন্যার মা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হলেও তিনি শিক্ষিত। অসংলগ্ন কথা বলার মধ্যেও তিনি মোটামুটি একটি ধারণা তৈরি করে নেন। এরপর শিশু দুটিসহ মহিলাটিকে কিভাবে রক্ষা করা যায় তা নিয়ে কথা বলেন স্থানীয় থানা ও সমাজসেবা অধিদপ্তরসহ ডাক্তারের সাথে। পরামর্শক্রমে মহিলাটিকে ভর্তি করানো হয় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মানসিক বিভাগে। আর শিশু কণ্যা দুটিকে ভর্তি করান একটি শিশু নিকেতনে।
পত্রিকা পড়ে জেনেছি, মহিলাটি শিক্ষিত। উচ্চ মাধ্যমিক পাড়ি দেওয়ার পর তার বিয়ে হয়। বেশ কিছুদিন সংসার হয় তাদের। এরই মধ্যে জন্মনেয় এক সন্তান। তবে সে সংসারে তার বেশিদিন থাকার সুযোগ হয়নি। নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া না হওয়াতে এক সময় তাদের বিচ্ছেদ হয়ে যায়। আশ্রয় নেয় বাপের বাড়িতে। এরই মধ্যে তার মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। মাঝে মধ্যে সে ঘর ছেড়ে পালিয়ে যেতো। এরই মধ্যে সে পরিবারের অমতে আরেকটি বিয়ে করে। এ সংসারে তার দুটি কন্যা সন্তান জন্ম নেয়। মানসিক সমস্যা থাকায় ঘর থেকে সন্তানদের নিয়ে সে মাঝে মধ্যে বেরিয়ে যেতো। পাগল হিসেবে চিহ্নিত হওয়াতে তার ভাইরা কেউ তার খবর রাখে না। অবসর প্রাপ্ত শিক্ষক পিতার পক্ষেও মেয়ের নিয়মিত খবর রাখার মতো সামর্থ নেই। এরই মধ্যে সে কোনো এক সময় বাড়ি থেকে পালিয়ে বেরিয়ে পড়ে, চলে আসে চট্টগ্রামে। তবে এবার ব্যতিক্রমভাবে সে আশ্রয় নেয় কবরস্থানে।
ভয়ংকর পরিবেশে সে আশ্রয় নিলেও ছাড়েনি তার দুই সন্তানকে। শিশু দুটিকে সে ঠিকই আগলে রেখেছে। অন্যদিকে মা‘য়ের এ অবস্থায়ও কন্যা শিশু দুটি ছাড়েনি তার মাকে। শিশু দুইটিকে কেউ খাবার দিতে চাইলে তারা মায়ের মুখের দিকে থাকাতো। মায়ের মুখের দিকে থাকিয়ে সম্মতি পেলেই তারা অনেকের খাবার নিত। ভয়ানক পরিবেশে থাকলেও শিশু দুটির মাঝে যেনো মায়ের প্রতি অন্যধরনের টান ছিলো।
শেষ করার আগে সুবিবেক সম্পন্ন একজন কাউন্সিলর হিসেবে মোরশেদ আলমের মহত্বকে আবার স্মরণ করছি। সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলরদের মধ্যে সবচেয়ে কম বয়সী এ তরুণ কাউন্সিলর ইতিমধ্যে সবার নজর কেড়েছেন। ওনার ব্যত্রিকর্মী সব কাজ তাক লাগিয়ে দেয় মানুষের হৃদয়ে। ভালোবাসা দিবসের দিন পথশিশুদের নিয়ে দিবস উদযাপন, মা দিবসে সংগ্রামী মা‘দের সম্মাননা অথবা পথশিশুদের এনে বিদ্যালয়ে ভর্তি করানোর মতো অনেক ব্যতিক্রমী কাজে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছেন তিনি। আগামীতে সমাজ বদলে দেওয়ার মতো সব কাজে তরুণ এ কাউন্সিলর এগিয়ে আসবেন এ প্রত্যাশা করছি।
লেখক: সাংবাদিক