৭ মার্চের রেসকোর্সের লাখ জনতায় আমিও একজনঃ সিইসি
সিটি নিউজ ডেস্কঃ প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নূরুল হুদা বলেছেন, বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে লাখ লাখ জনতার মাঝে আমিও একজন। মনেপ্রাণে স্বাধীনতা চেয়েছিলেন। এজন্য সেদিন মশারি টানানোর লাঠি নিয়েই ভাষণ শুনতে গিয়েছিলাম।
আজ মঙ্গলবার (২৬ মার্চ) আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসের আলোচনায় তিনি এসব কথা জানান।
স্বাধীনতা যুদ্ধে যাওয়ার প্রস্তুতির স্মৃতিচারণ করে সিইসি বলেন, ‘আজ বলব তাদের কথা, যাদের বয়স একাত্তর সালে ১৮ থেকে ২২ ছিল। তারা স্বাধীনতাকে কিভাবে দেখেছিলেন? স্বাধীনতা অর্জনে কিভাবে প্রস্তুতি নিয়েছিলেন? কিভাবে তাদের মধ্যে সংগ্রামী চেতনার উন্মেষ ঘটেছিল?’
তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে বলতে গিয়ে, আমি আমার জীবনের কিছু কথা বলব। তার মানে এই নয়, আমি আমাকেই মহিমান্বিত করার চেষ্টায় বক্তব্য রাখছি। আসলে আমি বলতে চাচ্ছি, একাত্তরে যারা যুবক ছিল, তারা প্রত্যেকেই নিজের অবস্থান থেকে স্বাধীনতা অর্জনের পথে কোনো না কোনো ভূমিকা রেখেছে।’
নূরুল হুদা বলেন, ‘৩ মার্চ একাত্তরে অধিবেশ স্থগিত ঘোষণা করা হয়। ওইদিন ছিল ঢাক স্টেডিয়ামে ক্রিকেট খেলা। ইয়াহিয়ার ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত দেশ বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল। আমার ওইদিন মাস্টার্সের ব্যবহারিক পরীক্ষা (ঢাবি) ছিল। আমরাও পরীক্ষা রেখে রাস্তায় নেমে আসি।’
তিনি বলেন, ‘৭ মার্চের ভাষণে রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) আমরা কেউ মশারি টানানোর লাঠি, কেউ বাঁশ নিয়ে ছুটে যাই। আমি মশারি টানানোর লাঠি খুলে নিয়ে গিয়েছিলাম। ভেবে ভাল লাগে যে, সেখানে যে লাখ লাখ মানুষ ছিল, তার মধ্যে আমিও ছিলাম।’
সিইসি বলেন, ‘রাতে আমার এক স্যারের সঙ্গে দেখা করে বললা, বঙ্গবন্ধুতো দিকনির্দেশনা দিয়ে দিয়েছেন, এখন কি করব? স্যার বললেন, ঢাকা শহর কারও জন্য নিরাপদ নয়, তুমি বরং গ্রামে চলে যাও।’
তিনি বলেন, ‘আমি ফরিদপুরের এক বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে গ্রামের দিকে রওনা হই। গ্রামে পৌঁছে দেখি, সব তরুণ, জুবা, কৃষক-শ্রমিক-জনতা, সবার মধ্যেই যুদ্ধে যাওয়ার প্রস্তুতি। আমরা শুধু ,মনোবল সঙ্গী করে বাঁশের লাঠিকে রাইফেল আকারে ধরে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেয়া শুরু করি। আসলে তখন দেশের সবাই একজন যোদ্ধা, এদেশের নদী-নালা, খাল-বিল, গাছ-পালাও ছিল স্বাধীনতার পক্ষে। ওরা (পাক হানাদার বাহনী) সাঁতার জানতো না। ফলে নদী পার হতে পারতো না। ওরা গাছে উঠতে পারতো না। আমাদের গেরিলা বাহিনীর সদস্যরা তালগাছের ওপর বসেও তাদের আক্রমণ করতো। এভাবে পুরো মুক্তিযুদ্ধটা জনযুদ্ধে রূপান্তরিত হয়।’
আলোচনা সভায় নির্বাচন কমিশনার মাহাবুব তালুকদার বলেন, একরাতে আমি সোফায় ঘুমিয়ে ছিলাম। রাতে রাউন্ডে এসে আমার মাথার নিচে কোনো বালিশ না দেখতে পেয়ে নিজের ঘুমানোর বালিশ আমার অজান্তে মাথায় নিচে দিয়ে যান বঙ্গবন্ধু।’
তিনি বলেন, আজ আমার কার কথা মনে পড়ছে আপনারা জানেন? আমার মনে পড়ছে বঙ্গবন্ধুর কথা। আমার পরম সৌভাগ্য যে, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সরকারিভাবে কাজ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। অনেক স্মৃতি। আজ মাত্র দু’টি বলবো।
তিনি বলেন, ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ওই দিনই তিনি আমায় ডেকে বলেন-মাহবুব তুমি আমার সঙ্গে থাকবা। আমাকে রাষ্ট্রপতির সহকারি প্রেস সচিবের দায়িত্ব দেওয়া হয়। পদবি বড় কথা নয়, দায়িত্ব অর্পিত হওয়ার পর সভাবতই আমি খুব খুশি হই।
তিনি আরও বলেন, আমার দায়িত্ব পড়ে, বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীর ডিকটেশন নেওয়ার। সিদ্ধান্ত হয়-দুপুরে খাওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর বিশ্রামের সময়টুকুতে আমি তার রুমে ঢুকে যাবো। তিনি আমাকে বলেন-যদি কোনো অজুহাতে ডিকটেশন দেওয়ার জন্য তিনি সময় না দিতে পারেন, তাহলে আমি যেন জোর করে ডিকটেশন নিই।
সেই মতে, আমি পরপর তিনদিন বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীর ডিকটেশন নিই। তার ডিকটেশন রেকর্ডও করি। চতুর্থ দিন এসে বঙ্গবন্ধু বেঁকে বসেন। বলেন, তোমার জন্য তো আমি বিশ্রামটুকুও নিতে পারছি না। আমি তাঁকে বলি-আইয়্যূবের শাসন, আপনার ছয় দফা, পাকিস্তানের জেলে বন্দির দিনগুলো, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা এরকম গুরুত্বপূর্ণ সব অধ্যায়ের বিষয়গুলো নিয়ে তো আপনাকে ডিকটেশন দিতে হবে। আপনার বিশ্রামের সময় আপনাকে বিরক্ত করা আমারও ভাল লাগে না। তাই আপনি আমাকে অন্য একটা সময় বের করে দিন। বঙ্গবন্ধু বলেন- আমি সমস্ত কাজ গুছিয়ে আনছি, পরিবারের বিয়ে শাদি শেষ করে দিয়েছি। সামনেই ডিকটেশন নেওয়ার সময় বের করে দেবো। কোনো কিছুই আটকে থাকবে না।
আলোচনা সভায় নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমার কাছে স্বাধীনতা মানে একটা নির্বাচন (’৭০ সালের নির্বাচন)। ৭ মার্চে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালির মহাকাব্য, স্বাধীনতা যুদ্ধ আর ৩০ লাখ শহীদের আত্মত্যাগ।’
আরেক নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানম বলেন, ‘স্বাধীনতা মানে কেবল একটি পতাকা নয়। স্বাধীনতা মানে শহীদদের আত্মত্যাগ, মা-বোনদের সম্ভ্রব হারানো। আর এই হারানোর বেদনাটা আমাদের লজ্জার নয়, গর্বের।’
অনুষ্ঠানে ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বলেন, ‘আমাদের সৌভাগ্য, আমাদের সিইসি একজন সম্মুখ যোদ্ধা। নির্বাচন কমিশনার রফিকুল স্যার তরুণ যোদ্ধা, মাহবুব তালুকদার স্যার একজন অন্যতম সংগঠক। এ রকম একটি কমিশন আমরা পেয়েছি, এজন্য আমরা গর্বিত। আমি তখন চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র। ফলে মুক্তিযুদ্ধে যেতে পারিনি। মুক্তিযুদ্ধকে আমিও একটি জনযুদ্ধ হিসেবে বিবেচনা করি। এই যুদ্ধে যারা জীবন উৎসর্গ করেছেন, তারা স্বাধীন দেশের সুফল ভোগ করতে পারেননি। আমরা সৌভাগ্যবান, আমরা স্বাধীনতার সুফল ভোগ করতে পারছি। সেজন্য মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আমরা চিরঋণী।’