জাতিসংঘের জঙ্গি তালিকায় জঙ্গি মাসুদ আজহার

0

আন্তর্জাতিক ডেস্কঃ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ জঙ্গি গোষ্ঠী জইশ-ই-মোহাম্মদ এর জঙ্গি নেতা মাসুদ আজাহারকে আন্তর্জাতিক জঙ্গি হিসেব ঘোষণা করেছে একই সঙ্গে তাকে জাতিসংঘের কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে চীন তাদের আপত্তি তুলে নেয়ায় পাকিস্তানের এই সন্ত্রাসী নেতাকে আন্তর্জাতিক জঙ্গি হিসেব তালিকাভুক্ত করা সম্ভব হলো। ফলে জাতিসংঘের এই পদক্ষেপকে বড় ধরনের কূটনৈতিক সফলতা হিসেবে দেখছে ভারত।

গত ফেব্রুয়ারিতে জম্মু কাশ্মীরের পুলওয়ামায় সিআরপিএফের ক্যাম্পে হামলা চালিয়ে ৪০ ভারতীয় জওয়ানকে হত্যা করার নেপথ্যে ছিল মাসুদের দল এই জইশ-ই-মোহাম্মদ। এরপরই তাকে জঙ্গি তালিকাভুক্ত করতে জোর প্রচেষ্টা চালায় ভারত। যদিও ১৯৯৯ সাল থেকেই এই চেষ্টা চালিয়ে আসছিলো ভারত।

কিন্তু এতদিন নিরাপত্তা পরিষদের অন্যতম সদস্য চীনের আপত্তির কারণে তাদের সে চেষ্টা সফল হয়নি। কিন্তু চীনের অবস্থান বদলাতে দেশটির ওপর ভারতের পাশাপাশি চাপ বাড়িয়েছিলো যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ফ্রান্স। যার ফলে বেইজিং তাদের দীর্ঘদিনের আপত্তি থেকে সরে আসে এবং অবশেষে ভারতের প্রচেষ্টা সফল হয়। মাসুদ আজহারকে আন্তর্জাতিক জঙ্গি হিসেবে তালিকাভুক্ত করে জাতিসংঘ।

বুধবার জাতিসংঘের ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তের কথা টুইট করে জানান সেখানে নিযুক্ত ভারতের প্রতিনিধি সৈয়দ আকবরউদ্দিন। তিনি বলেন, ‘বড় ছোটো সবাই একসঙ্গে। জাতিসংঘের তালিকায় আন্তর্জাতিক জঙ্গি মাসুদ আজাহার। সমর্থনের জন্য সবার কাছে কৃতজ্ঞ।’

জাতিসংঘের এই পদক্ষেপের ফলে মাসুদ আজাহারের সমস্ত অর্থ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে। তার বিদেশ ভ্রমণের ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে।

জাতিসংঘের এই নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়ন করা হবে বলে এক বিবৃতিতে জানিয়েছে পাকিস্তান। যদিও এ নিয়ে তারা জম্মু-কাশ্মীরের ওপর ভারতীয় নির্যাতনের প্রসঙ্গ টেনে বলেছে, কেবল জইস-ই- মোহাম্মদ নয়, পৃথিবীর বুক থেকে সব ধরনের সন্ত্রাস উচ্ছেদ করা উচিত। পাকিস্তান সব ধরনের সন্ত্রাসের বিপক্ষে।

এদিকে মাসুদ আজহারকে জঙ্গি তালিকাভুক্ত করায় ভারতের চলমান লোকসভা নির্বাচনে মোদির দল বিজেপি নির্বাচনী প্রচারণায় বড় ধরনের ফায়দা তুলবে বলে ধারণা করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। ইতিমধ্যেই এ নিয়ে প্রচার শুরু করেছেন মোদি এবং একে তিনি তার সরকারের বড় সফলতা হিসেবে দাবিও করেছেন।

বুধবার রাজস্থানের এক জনসভায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বালাকোট অভিযানের দিনও আমি রাজস্থানে ছিলাম। আজও বড় খবর নিয়ে এসেছি।’

বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ টুইট করেন, ‘এই জন্যেই শক্তিশালী নেতার প্রয়োজন। এটা সন্ত্রাসের প্রতি মোদির ‘জ়িরো টলারেন্স’ নীতির ফসল।’

কে এই মাসুদ আজহার!

কে এই মাসুদ আজহার? কী তার পরিচয়? জইশ প্রধান মাসুদ আজহার এক সময় ওসামা বিন লাদেনের অতি ঘনিষ্ঠ সহকারী ছিলেন। বহু আফ্রিকান দেশে সন্ত্রাসবাদী হামলায় মদদ দিয়েছেন।

জাতিসংঘের জঙ্গি তালিকায় জঙ্গি মাসুদ আজহার

এই ৫০ বছর বয়সী জঙ্গি নেতার প্রভাব এতটাই বেশি যে, ১৯৯৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর আইসি-৮১৪ নামের বিমানটিকে হাইজ্যাক করে কান্দাহার বিমানবন্দরে দাঁড় করিয়ে রেখে দিয়েছিল। তার বিনিময়ে তৎকালীন ভারত সরকার মাসুদ আজহারকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। সেই রাতে ওসামা বিন লাদেন নিজে দাঁড়িয়ে থেকে একটি ব্যাঙ্কোয়েট পার্টির আয়োজন করেছিলেন মাসুদ আজহারের ‘সম্মান’-এ।

১৯৯৪ সালে জম্মু ও কাশ্মীরে জিহাদি বক্তৃতা দেওয়ার জন্য মাসুদ আজহারকে গ্রেপ্তার করেছিলো ভারত সরকার। ওই সময় তার অন্যতম ডানহাত, ব্রিটিশ নাগরিক ওমর শেখ, তৎকালীন অতি কুখ্যাত জঙ্গি সংগঠন হরকত-উল-আনসারের সদস্য, ভারত থেকে পণবন্দি করেছিল চারজন পশ্চিমা পর্যটককে। তাদের দাবি ছিল, মাসুদ আজহারকে ছাড়ার পর তবেই ওই বিদেশি বন্দিদের ছাড়া হবে। যদিও, তাতে তখন তারা সফল হয়নি। গোয়েন্দারা ওই চার পণবন্দিকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসে ওমর শেখের জিম্মা থেকে এবং গ্রেপ্তার করে ওই কুখ্যাত জঙ্গিকেও।

১৯৯৫ সালে ফের ৫ জন বিদেশি পর্যটকদের পণবন্দি করে হরকত উল আনসার মাসুদ আজহারকে ছেড়ে দেওয়ার দাবি নিয়ে। পরে তাদের পাঁচজনকেই হত্যা করা হয়।

১৯৯৯ সালে কান্দাহারে বিমান হাইজ্যাক করার পর মাসুদ আজহারকে ছাড়তে বাধ্য হয় ভারত সরকার। তার কয়েকদিনের মধ্যেই ২০০০ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় জঙ্গি সংগঠন জইশ-ই-মোহাম্মদ। ২০০০ সালের এপ্রিল মাসে জম্মু ও কাশ্মীরের শ্রীনগরের বাদামি বাগ ক্যান্টনমেন্টে প্রথম আত্মঘাতী হামলা চালায় এই দলের সদস্যরা।

ওই হামলায় মানববোমা হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছিল ২৪ বছর বয়সী আসিফ সাদিককে। মাসুদ আজহারের একদম প্রথম দিকে বাছাই করে তোলা পরে প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি করা ভয়ঙ্কর জঙ্গি। সেও ছিল ব্রিটিশ নাগরিক। ওই সময় আল কায়দার বহু জঙ্গিকেও নিজেদের সংগঠনের কাজে ব্যবহার করতেন মাসুদ আজহার।

সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধের পর যখন মাসুদ আজহার জখম হয়ে যায়, তারপর থেকেই তার মূল কাজ হয়ে দাঁড়ায় হরকত-উল-আনসারে নতুন আসা ছেলেদের ‘উদ্বুদ্ধ’ করা। গত শতাব্দীর নয়ের দশকের শুরুতেই মাসুদ আজহার হরকত-উল-আনসারের মহাসচিব পদে বসেন। তারপর তার কাজ হয় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ঘুরে ঘুরে জঙ্গি সংগঠনের জন্য অর্থ সংগ্রহ করা। ওই দেশগুলির মধ্যে ছিল- জাম্বিয়া, আবু ধাবি, সৌদি আরব, মঙ্গেলিয়া, গ্রেট ব্রিটেন এবং আলবেনিয়া।

১৯৯৩ সালে আল-কায়দা জঙ্গি অধ্যুষিত কেনিয়াতেও প্রবেশ করেন মাসুদ। সোমালিয়ায় দায়িত্বরত এক আল-কায়দা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জঙ্গির সঙ্গে দেখা করার জন্য। ১৯৯৩ সালের আগস্ট মাসে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য যুক্তরাজ্যে যান মাসুদ আজহার। তারপরই শুরু হয় সে দেশের সেই সব মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করা, যারা জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ দিতে বিশেষভাবে দক্ষ। ১৯৯৩ সালে মাসুদ আজহার সাজ্জাদ আফগানির সঙ্গে আসেন বাংলাদেশে। ১৯৯৪ সালে ভারত থেকে যখন তাকে গ্রেপ্তার করা হয়, সেই সময় তিনি ছিলেন হরকত উল মুজাহিদিন বা হরকত উল আনসারের সদস্য।

তার হামলাগুলোর মধ্যে আলোচিত হচ্ছে, ২০০১ সালের ১৩ ডিসেম্বর সংসদ ভবনে হামলা; ২০১৬ সালের ২ জানুয়ারি পাঠানকোটে বিমান বাহিনীর ঘাঁটিতে হামলা এবং ২০১৬ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর উরিতে সেনাবাহিনীর সদর দপ্তরে হামলা। উরি হামলায় ভারতের ১৭ জওয়ান নিহত এবং আহত হয় আরো ৩০ জন।

এছাড়া চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে জম্মু কাশ্মীরের পুলওয়ামা হামলার পিছনেও মাসুদের দল এই জইশ-ই-মোহাম্মদের হাত রয়েছে বলে দাবি করে আসছে ভারত। ওই হামলায় ৪০ ভারতীয় জওয়ান নিহত হয়। খবর এনটিভি।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.