ডেঙ্গু হত্যা-মাদক ও গুজব সংকটে দেশ

0

জুবায়ের সিদ্দিকীঃ বন্দরনগরী চট্টগ্রাম সহ দেশের মানুষ বহুবিদ সংকটে নাকাল, নাভীশ্বাস উঠেছে মানুষের। রাজনৈতিক ও পারিপাশ্বিক সংকট ও সমস্যা চারপাশে। দ্রব্যমুল্যের ক্রয়-উর্ধ্বগতি, নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষের যাপিত জীবনকে করে তুলেছে কষ্টসাধ্য। মাদকের সর্বগ্রাসী বিস্তার, সামাজিক মুল্যবোধের অবক্ষয় ক্রমেই বাড়ছে হতাশা।

এর মধ্যেই রাজধানী ঢাকা সহ বিভিন্ন এলাকায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে একের পর এক মৃত্যু, উদ্ভট-অযৌক্তিক গুজবে অস্থিরতা, ছেলেধরা সন্দেহে নিরীহ-নিরপরাধ মানুষকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা, মধ্যযুগীয় বর্বরতায় প্রকাশ্যে কুপিয়ে মানুষ হত্যা, নারী-শিশু ধর্ষন উদ্বেগজনক হারে বেড়ে যাওয়া, দেশের বিস্তীর্ন অঞ্চল বন্যায় আক্রান্ত হওয়া, ঝনখেলাপীদের দৌরাত্ব্যে কাবু ব্যাংক খাত, শেয়ারবাজারে ধারাবাহিক দরপতন ইত্যাদি বিষয় দেশবাসীর কাছে যারপরনাই মারাতœক উপদ্রুব হয়ে দেখা দিয়েছে। সব মিলিয়ে সংকট খুবই প্রকট আকার ধারন করেছে।

নিকট অতীতে দেশে সংকটের এমন চিত্র কখনো দেখা যায়নি। এসব অন্তহীন সংকট আর সমস্যায় উৎকন্ঠিত, শঙ্কিত সাধারন মানুষ যাবে কোথায়? এটিই এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। মাদকের সর্বগ্রাসী বিস্তারসহ নানাবিধ কারনে সামাজিক মুল্যবোধের অবক্ষয়ে বেড়ে চলা হতাশায় সৃষ্টি হচ্ছে গুজবের মতো ঘটনা। যেখানে গণপিটুনির মতো ঘটনাও ঘটছে। প্রানহানিসহ মারাত্বক আহত হতে হচ্ছে নিরীহ মানুষদের। একের পর এক গুজবের সৃষ্টি, গনপিটুনি, ডেঙ্গু, বন্যা, জলাবদ্ধতা, ঋনখেলাপীতে কাবু ব্যাংক খাত, শেয়ারবাজারে ধারাবাহিক দরপতন সব মিলিয়ে সংকট যেন এখন প্রকট আকার ধারন করেছে।

এতে শঙ্কিত যেমন দেশের মানুষ তেমনি উদ্বিগ্ন সরকার। তবে মাদকের বিরুদ্ধে সোচ্চার বর্তমান সরকার যুদ্ধ ঘোষনা করে অসংখ্য মাদকের গডফাদারকে ক্রসফায়ারের মাধ্যমে নিবৃত্ত করতে সক্ষম হলেও কার্যত মাদক কারবারিদের দৌরাত্ব্য বন্ধ করতে পারেনি আদৌ। সরকারের যুদ্ধ ঘোষনার আগে মাদকের অবস্থা যেমন ছিল, যুদ্ধের পরও তেমনই রয়ে গেছে। বরং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের তালিকাভুক্ত কারবারিদের অধিকাংশই এখনো প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে মাদকের হাটে।

টেকনাফের সাংসদ বদিসহ একাধিক রাজনৈতিক নেতার নাম মন্ত্রনালয়ের তালিকাভুক্ত হলেও এখনো তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থাই গ্রহন করেনি প্রশাসন। গত সপ্তাহে যশোরের বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালানোর সময় বদির এক সহযোগী টেকনাফের বহুল আলোচিত ইয়াবা স¤্রাট শাহজাহান চেয়ারম্যানকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের ৯ নম্বর তালিকাভুক্ত এ ইয়াবা কারবারী ভারতে পালানোর চেষ্টা করছিলেন বলে জানায় পুলিশ। টেকনাফের সদর ইউপি চেয়ারম্যান ও শ্রমিক লীগের সভাপতি এই ইয়াবা কারবারী এর আগেও দুবাই পালিয়ে যাবার চেষ্টা করেন।

তিনি এলাকায় সাবেক এমপি বদির বাম হাত এবং তার বাবা সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর আহমদের ডান হাত হিসেবেই পরিচিত। এ রকম অসংখ্য মাদক কারবারী এখনো সমাজে মাদকের বিস্তার করেই চলেছে। যাদের আইনের আওতায় আনা নিয়ে প্রশাসন রয়েছে রহস্যজনক ভুমিকায়। চলতি মাসে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের তালিকাভুক্ত ইয়াবা কারবারীদের মধ্যে কতজন বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে তা বলতে পারছে না সংশ্লিষ্ট প্রশাসন।

এ ছাড়া ক্রসফায়ারে মারা যাওয়ার আগে বেশ কয়জন ইয়াবা কারবারী, বেশ কয়েকজন ইয়াবা ব্যবসায়ী ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের নাম বলে গেলেও তাদের পরিচয় জানা যাচ্ছে না। অথচ মাদকের সর্বগ্রাসী বিস্তার বেড়েই চলেছে দিনের পর দিন। যে কারনে বাড়ছে অপরাধ আর সংকটে পতিত হচ্ছে দেশ। এদিকে মাদকের সংশ্লিষ্টতায় বরগুনার রিফাত শরীফ হত্যাকান্ডের মতো ঘটনাও ঘটছে দেশে। সমাজ ও অপরাধ বিজ্ঞানীরা বলছেন, এক শ্রেনির লোক যারা হতাশায় নিমজ্জিত, তারাই বিভিন্নভাবে গুজবের মত ঘটনা ঘটাচ্ছে। আর এসব হতাশা রাষ্ট্রের নির্লিপ্ততার কারনে সৃষ্টি হচ্ছে।

সাম্প্রতিক সময়ে কল্লাকাটা ও ছেলেধরা গুজবও হতাশার সৃষ্টি বলে মনে করছেন তারা। এ ছাড়া আরও একটি মহল রয়েছে যারা দেশকে অস্থিতীশীল পরিস্থিতির সম্মুখীন করতে গুজব ছড়িয়ে দেশে সংকট সৃষ্টির পাঁয়তারা করে। এতে তারা কখনো সফল হয়, আবার কখনো হয় না। পদ্মা সেতুতে মাথা লাগবে এমন গুজব ছড়িয়ে সরকারের উন্নয়ন অগ্রযাত্রার ধারাবাহিকতাকে টেনে ধরতে সরকারবিরোধী রাজনীতির অংশ হিসেবে কল্লাকাটা গুজবে বেশ কজন নিরীহ মানুষের প্রানহানীর ঘটনা ঘটছে মনে করছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। তথ্যমন্ত্রী হাসান মাহমুদ বলেছেন, গুজবের কারনে গনপিটুনির ঘটনায় যেসব হত্যাকান্ড হয়েছে, তাতে গ্রেপ্তারকৃত দের মধ্যে ৭০ ভাগই বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।

যখন বাংলাদেশ পৃথিবীকে অবাক করে করে দিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মান করছে, তখনই একটি মহল প্রচন্ডভাবে হতাশ হয়ে পড়ে। তারা রাজনৈতিকভাবে আমাদের মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয়ে জনগন কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়ে নানা ধরনের হীন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে এবং নানা ধরনের অপকৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে। তারই অংশ হিসেবে সৃষ্ট কল্লাকাটা ও ছেলেধরা গুজবের সৃষ্টি। আবার এ নিয়ে জামায়াত তাদের দলের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে বিবৃতিও পাঠিয়েছে। কিন্তু এরই মধ্যে এসব ঘটনায় দেশের মানুষের আতঙ্ক যখন চরমে পৌছায়, ঠিক তখনই পুলিশসহ সরকারের সম্মিলিত চেষ্টায় অনেকটাই নিবৃত্ত হয়েছে গণপিটুনির ঘটনা। যদিও এখনো গুজবের বেশ কাটেনি, বরং অব্যাহতই রয়েছে বলে দাবী করেছেন অনেকেই।

গুজবে সৃষ্ট সংকটের মধ্যেই আবার বিদ্যুৎ নিয়েও নতুন গুজবের সৃষ্টি হয়েছে। যা গ্রাম গঞ্জে সাধারন মানুষের মুখে মুখে। ছড়ানো হচ্ছে তিনদিন সারা দেশে বিদ্যুৎ থাকবে না। তবে এ গুজবের রহস্য কী, তা জানা যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে গুজবে সৃষ্ট সংকট যেন মানুষের পিছু ছাড়ছে না, বরং সংকট বাড়িয়েই চলছে। সরকারের নানাবিধ উন্নয়নের অংশ হিসেবে বন্যা ও নগরীতে জলাবদ্ধতার দুর্যোগ মোকাবেলায় ব্যাপক প্রস্তুতির কথা বলা হলেও কার্যত বন্যা ও জলাবদ্ধতার পরিস্তিতি মোকাবেলায়ও হিমশিম খাচ্ছে সরকার। বন্যায় সৃষ্ট সংকটে বানভাসী মানুষরা মানবেতর জীবন যাপন করছেন, সৃষ্টি হচ্ছে নানাবিধ সমস্যা। চলতি বন্যা পরিস্থিতিতে সরকারের পক্ষ থেকে গৃহহীন মানুষের স্বপ্নের নীড় হিসেবে গড়া গুচ্ছগ্রামগুলোও ডুবে গেছে পানির নিচে।

পদ্মানদীর স্রোতে গ্রামটির মাঝখান থেকে ২০টিরও বেশি ঘর ভেঙ্গে পড়েছে। ঘরগুলো প্রায় সম্পুর্নই পানির নিচে চলে তলিয়ে গেছে। শুধু গুচ্ছগ্রামই নয়, সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে বন্যায় চরম সংকটে পড়েছে। চট্টগ্রামের সাতকানিয়া ও চন্দনাইশের বন্যার পানি নেমে গেলেও বন্যা অনেক পরিবারকে পথে বসিয়েছে। কল্লাকাটা আর ছেলেধরা গুজবে গণপিটুনির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ক্রমেই বেড়ে চলেছে ডেঙ্গু সংকট। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে শিশু, চিকিৎসকসহ প্রায় সব পেশার অসংখ্য মানুষ।

দেশের বানিজ্যিক রাজধানী খ্যাত বন্দরনগরী চট্টগ্রামে অর্থেক এলাকা জোয়ার ও বৃষ্টির পানিতে ডুবছে প্রতিদিন। দুয়েক ঘন্টার বৃষ্টিতে সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা। শহরের নিচতলার মানুষগুলো সবচেয়ে বেশি কষ্টে আছে। নগরীতে সেবসংস্থা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মধ্যে উন্নয়ন কর্মকান্ডে সমন্বয়ের অভাব দীর্ঘদিনের। যে কারনে সংস্থাগুলো নিজেদের খেয়ালখুশীমত প্রকল্প করছে, যার সুফল পাচ্ছে না মানুষ। অপর সেবা প্রতিষ্টান চট্টগ্রাম ওয়াসার কান্ডজ্ঞান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে সচেতন মহলে। একই সড়কে বারবার খোড়াখুড়ি করছে তারা। শহরের অধিকাংশ সড়ক নষ্টের পেছনে দায়ী ওয়াসা ও পিডিবি। দুর্ভোগ দুর্দশা ছাড়ছে না মানুষকে। এরই মধ্যে মরার উপর খাড়ার ঘাঁ’র মত বাড়ানো হয়েছে গ্যাসের দাম।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.