জামায়াতের রাজনীতির ষ্টাইল পাল্টে যাচ্ছে

0

জুবায়ের সিদ্দিকী

চট্টগ্রামে বিএনপির রাজপথের যুগপথ আন্দোলনের একমাত্র ভরসা জামায়াত এখন মাঠছাড়া। হদিস পাওয়া যাচ্ছে না শীর্ষ নেতা সহ দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের। মাঠে এখন বিচরনে দেখা যাচ্ছে না কর্মীদেরও। এ ব্যাপারে দলের গুরুত্বপুর্ন দায়িত্বশীল নেতাদের কোন প্রতিক্রিয়া নেই। এদিকে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত নেতাকর্মীদের মুক্তির দাবীতে গত ৫ বছরের আন্দোলনে রাজপথে ছিল জামায়াত শিবির। পাশাপাশি দলটি ২০ দলীয় জোটের প্রধান শরীক বিএনপির আন্দোলনে একমাত্র চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে আসছে। দেখা গেছে বিগত দিনে সাংগঠনিক বিভিন্ন কর্মসুচীতে জনগনের সাড়া না মিললেও হরতাল অবরোধই ছিল এক সময়ে তাদের হাতিয়ার। এই দলের যারা নেতৃস্থানীয় বাইরে আছেন তারাও আটকের ভয়ে চলেছেন এখন পিঠ বাঁচিয়ে।

প্রধান মিত্র হিসেবে জামায়াতকে রাজপথের আন্দোলনের প্রধান ভরসা বিএনপি মনে করলেও এখন সেই জামায়াত মাঠছাড়া। ৫ জানুয়ারীর নির্বাচনের আগে ও পরে লাগাতার হরতাল অবরোধ কর্মসুচীতে দেশজুড়ে পেট্রোলবোমা নিক্ষেপের জন্য দলটিকে দায়ী করে আসছে আওয়ামী লীগ। অপরদিকে রাজনৈতিক কৌশলে একের পর এক ব্যর্থতা অন্যদিকে নাশকতার দায়ে জনরোষে নেতাকর্মীরা হয়ে পড়েছেন দিশেহারা। নির্বাচন প্রতিহত ও যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত জামায়াত নেতা ও মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের ফাঁসি ঠেকানোর চেষ্টা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। অতীতে দেখা গেছে, বিএনপি বা ২০ দলীয় জোটের যৌথ আন্দোলন কর্মসুচী আহবান করার পর আগেরদিন সন্ধ্যায় গাড়ি ভাংচুর অগ্নি সংযোগ করে আতঙ্ক ছড়ানো হতো দলটির নেতাকর্মীদের পক্ষ থেকে।

এ ছাড়া হরতালে নেতাকর্মীরা ঝটিকা স্টাইলে মাঠে নেমে বিক্ষোভ মিছিল বা পিকেটিং করতে দেখা গেছে। এখন সে রকম কিছুই হচ্ছে না। গত ৫ আগষ্ট সারাদেশে নারী ও শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে জামায়াত কর্মসুচী আহবান করলেও দেশের দুয়েকটি স্থানে বিক্ষোভ ছাড়া কোথাও নামতে পারেনি নেতাকর্মীরা। অনুসন্ধানে ও অনেক নেতাকর্মীর সাথে আলাপ করে জানা গেছে, দলের ত্যাগী নেতাকর্মীরা এখন রাজনীতিতে জীবন ঝুকি নিতে ইচ্ছুক নন। এ বিষয়ে জামায়াতের এক শীর্ষ নেতা বলেছেন, এই সরকারের অধীনে কিছুই নিরাপদ নয়। রাজনীতির স্বাধীনতা নেই, মানুষের নিরাপত্তা নেই। এই নেতা বললেন, কেউ এই সরকারের নানা অনিয়ম দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে মাঠে নামলে পরের দিন দেখা যায় ওই ব্যক্তির হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। হয় তাকে হত্যা করা হচ্ছে, না হয় গুম হচ্ছে অথবা মামলা দিয়ে জেলে পাঠানো হচ্ছে। এ অবস্থায় দেশে রাজনীতি চলতে পারে না। প্রায় ৫০টি জেলায় মাঠছাড়া জামায়াত।

একই অবস্থা দলটির সহযোগী সংগঠন ছাত্র শিবিরের। তাই মাঠ ছাড়া জামায়াতকে মাঠে অবস্থানের জন্য নানা কৌশলে নিয়েছে দলটি। কেন্দ্রীয় নেতাদের এই কৌশলে নেতাকর্মীদের শক্তি ও মনোবল চাঙ্গা করতে জেলা সম্মেলন, দায়িত্বশীল নেতাদের মধ্যে সাংগঠনিক বিষয়ে গোপন আলোচনা, প্রত্যেকে নিজেদের রাখা ও কর্মীদের মধ্যে ভাতৃত্ববন্ধন তৈরী। যথাযথভাবে বায়তুল মাল সংগ্রহ, স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের সাথে সুসম্পর্ক রাখা ও আইনশৃঙ্কলাবাহিনীর সঙ্গে ধীরে ধীরে সখ্য তৈরীর জন্য দেশের সব জেলা, উপজেলা নেতাদের নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় জামায়াত। এদিকে সাম্প্রতিক সময়ে গোপনে জামায়াত জেলার নেতাদের সম্মেলন আহবান করলেও পরে কোন এক অজ্ঞাত কারনে তা বাতিল করা হয়। চট্টগ্রামের জামায়াতের এক নেতা জানান, খন্ড খন্ড ভাবে ৬৪ জেলায় সাংগঠনিক সম্মেলন করা হচ্ছে।

আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নজর এড়াতে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। দলীয় সুত্র জানিয়েছে দলের নেতাকর্মীরা এখন নিরব থেকে সাংগঠনিক ভাবে কার্যক্রম খুব শতর্কতার সাথে এগিয়ে নিচ্ছে। যখন দলের চুড়ান্ত নির্দেশ আসবে তখন পুরো শক্তি নিয়ে মাঠ দখলের লড়াইতে অংশ নেবে। জামায়াতের আরেকটি সুত্র জানায়, আওয়ামী লীগকে এখন সহিংসতার পরিবর্তে আদর্শিক রাজনীতির মাধ্যমে মোকাবেলা করতে দেশের প্রতিটি গ্রামে উচ্চশিক্ষিত সোসাইটিকে টার্গেট করে মাঠে কাজ করছে জামায়াত শিবির।

রাজনীতির মাঠে টিকে থাকতে বিকল্প পথের সন্ধান করতে পরামর্শ দিয়েছেন শীর্ষনেতারা। অনুসন্ধানে জানা গেছে, একটি মধ্যপন্থী ইসলামী দল হিসেবে আমেরিকা ও ইউরোপের মতো দেশগুলোর কাছে নিজেরে তুলে ধরতে জামায়াতের একটি কুটনৈতিক মিশন কাজ করছে। তারা চাইছেন, সন্ত্রাসী তকমা থেকে বের হয়ে নতুন ভাবে গড়ে তোলা হোক জামায়াতকে। এ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সৌদিআরব সফর করে পক্ষে আন্তর্জাতিক লবিং করছেন সেক্রেটারী জেনারেল ব্যরিষ্টার আবদুর রাজ্জাক। তার সঙ্গে বিভিন্ন বিদেশী মিড়িয়া এবং জামায়াতের মতাদর্শের সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবিদের নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে বলে জানা গেছে। সবকিছু ছাপিয়ে জামায়াতের সংস্কারপন্থী নেতারা চাইছেন, ২০১০ সালের ২৬ ডিসেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে পাঠানো কামরুজ্জামানের চিঠিতে বর্নিত কৌশল অবলম্বন করতে। সেদিকেই এগুচ্ছে জামায়াতের সংস্কারপন্থী । পরিবর্তিত পরিস্থিতি আর নানামুখী চাপে দিকপ্রান্ত জামায়াত ইসলামী এখন নতুন পথের সন্ধান করছে।

চলমান ধারায় দলটি তৎপরতা চালু থাকলে ভবিষ্যতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দুরে থাক, নিজেদের অস্তীত্ব টিকিয়ে রাখাও কঠিন হয়ে পড়তে পারে বলে মনে করছেন নীতি নির্ধারকরা। জামায়াতকে আবার নতুন ভাবে সাজাতে ও সারাদেশে অগনিত নেতাকর্মীকে আবার সংগঠিত করার চেষ্টা করছেন। চট্টগ্রাম ও ঢাকায় এ নিয়ে জামায়াতের শীর্ষ নেতৃবর্গ দফায় দফায় সভা করেছেন বলে দলীয় সুত্র নিশ্চিত করেছে। এ ছাড়া সংগঠনের সব পর্যায়ে তথ্য প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার কেন্দ্রীয় কমিটিতে সব পেশার লোকের প্রতিনিধিত্ব থাকার বিষয়েও দলটির শীর্ষ নেতারা সিন্ধান্ত নিয়ে কাজ করছেন।

দলকে পুরনো ধাঁচের খাছা থেকে বের হয়ে নতুন আঙ্গিকে জনগনের কাছাকাছি যেতে নানা পদক্ষেপ ও সহিংসতার সকল পথ পরিবার করে নান্দনিক ও গনতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রামে সাংগঠনিক তৎপরতায় এগিয়ে যাওয়ার একটি সিদ্ধান্ত শীর্ষ নেতারা গ্রহন করেছেন। জামায়াতের মহানগরীর এক নেতা জানান, এভাবে দল পরিচালনা করে ক্ষতি ছাড়া লাভের কোন সম্ভাবনা নেই। তিনি বলেন, পুরনো ধাচের ইসলামী দলের চেয়ে আধুনিক জনকল্যান, সুশাসন ও ন্যায় বিচার ভিত্ত্বিক দল তুরস্কের একে পার্টি, মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুড এবং মালয়েশিয়ার জাষ্টিজ এন্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির সাফল্য অনেক বেশি। এশিয়ার কোন মুসলিম দেশে নির্বাচনে জয়লাভ করতে হলে ইসলামী এজেন্ডা গোপন রাখতে হবে।

এ কারনে অবশ্যই এ ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনতে হবে। তিনি বলেন, জামায়াত দেশের মাটিতে ব্যাপক সাংগঠনিক ভিত্ত্বি অর্জন করলেও ভোটারদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সমর্থন তৈরী করতে পারেনি। ২০০৯ সালে শিবিরের তৎকালীন সেক্রেটারী জেনারেল শিশির মুহাম্মদ মনির জামায়াত শিবির সংস্কারের একটি প্রস্তাবনা পেশ করেন। তবে তার নির্দেশনাও আমলে নেয়নি দলটি। উল্টো শিশিরকে ’চর’ আখ্যায়িত করে সংগঠন থেকে বের করে দেয়া হয়। এ নিয়ে দেশব্যাপী শিবির কর্মীদের মধ্যে অস্তিরতা দেখা দেয়। ২০০৯ সালে দলের নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন শিরোনামে জামায়াতের রাজনীতির ধরন পাল্টে উদার নৈতিক দল গঠনের পক্ষে পল্টনের একটি গোপন বৈঠক হয়। সে বৈঠকে বর্তমানে কারাবন্দী মীর কাশেম আলীসহ জামায়াতের অনেক তরুন নেতা উপস্থিত ছিলেন। এরপর মুহাম্মদ কামারুজ্জামান কারাগার থেকে জামায়াতকে সংস্কারের জন্য কারাগার থেকে সুদীর্ঘ একটি চিঠি পাঠান।

একাধিক সুত্র জানাচ্ছে, জামায়াতের একটি কুটনৈতিক মিশন বিদেশে কাজ করছে দলের পরিস্থিতি ও দলকে সাংগঠনিকভাবে কিভাবে শক্তিশালী করা যায়। তবে জামায়াতের এক নেতা বললেন, জামায়াতের রাজনীতিতে চলছে মাদারীর খেইল। জামায়াতী ষ্টাইল বিচিত্র। জামায়াতের একাধিক নেতার সাথে কথা বলে জানা যায়, জামায়াত নেতারা এই সময়ে সবচেয়ে কঠিন সময় পার করছেন। দলের শীর্ষ নেতারা একদিকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে আটক, কসাই কাদের মোল্লা, কামরুজ্জামানের ফাঁসি, শিবিরের শত শত কর্মী বিভিন্ন মামলায় কারাগারে যাওয়া, ফেরারী সহ এলাকা ছাড়া হওয়াতে দলের নাজুক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

জামায়াতের এক প্রবীন সদস্য বলেন, আগের জামায়াত আর এখনকার জামায়াতের অনেক পার্থক্য। আমাদের সময়ে সহিংসতা ছিল না। জামায়াত যত তারাতারি সহিংসতার পথ থেকে বেরিয়ে আসবে ততই মঙ্গল। বোমাবাজি, পেট্রোলবোমা নিক্ষেপ,সাধারন মানুষ হত্যা করে রাজনীতি হয় না। সাধারন মানুষের সমর্থন দুরে থাক, মানুষের ঘৃনা, ক্ষোভ নিন্দা তত বাড়বে। রাজনীতিতে ভায়োলেন্স কোনভাবেই দলের ও দেশের জন্য সুখকর নয়। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, জামায়াত সহিংসতা ছেড়ে সংস্কারের পথে এগুলে দলটিল জন্য হবে মঙ্গল। অনুসন্ধানে ও জামায়াতের নানা সুত্রমতে, বিগত ৫ বছর রাজনীতিতে এক ধরনের মাদারীর খেইল দেখিয়েছে সারাদেশে জামায়াত।

জীবন্ত মানুষকে বাসে পুড়িয়ে সারা দেশে সহিংশতার সব পথ তারা অনুসরন করেছে। এতে কোন ফায়দা তাদের হয়নি। সাধারন নিরহ মানুষ বার বার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। স্বজন হারানোর বেদনায় আল্লাহর আরশ কেঁপেছে বারবার। এখন তাদের হুশ হয়েছে। এই মাদারীর খেইল জামায়াতী ষ্টাইল বন্ধ হচ্ছে শুনে জামায়াত শিবিরের সাধারন নেতাকর্মীরাও আনন্দিত।

সহিংসতার পথ ছেড়ে গনতান্ত্রিক ও শান্তিপুর্ন আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দাবী আদায় করতেই আগ্রহী অধিকাংশ নেতাকর্মী।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.