বন্দর ধ্বংস করছে কর্ণফুলী নদী

৮৬৬ মিটার প্রস্থের কর্ণফুলী এখন ৪১০ মিটার

0

সিটি নিউজ,চট্টগ্রাম : কর্ণফুলী নদীর বন্দর শাসিত এলাকা হালদা মোহনা থেকে কর্ণফুলী মোহনা পর্যন্ত ১০ মাইল কর্ণফুলী রক্ষায় ২০১৪ সালে এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তপক্ষ “স্ট্রাটেজিক মাস্টার প্ল্যান ফর চিটাগাং পোর্ট” শীর্ষক একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। বিএস জরিপ অনুযায়ী কর্ণফুলী নদীর প্রস্থ ঠিক রেখেই সেই পরিকল্পনা করা হয়। বন্দরের স্বাভাবিক গতিশীলতা ও কর্ণফুলীর নাব্যতা রক্ষায় এই প্রকল্প বাস্তবায়নের বিকল্প নাই। কিন্তু বন্দর কর্তৃপক্ষ এই প্রকল্পকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নিজেদের খেয়াল খুশী মতো নদী লিজ দিয়ে কর্ণফুলী সর্বনাশ করেছে।

বন্দর কর্তৃক নিজেদের ব্যবহৃত অংশে কর্ণফুলী নদী খনন, শাসন ও উভয়তীরে সীমানা প্রাচীর না দেয়ায় কর্ণফুলী স্বাভাবিক গতি প্রবাহ ধ্বংস হয়েছে।

বিগত ২১ দিন ব্যাপী চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলন কর্ণফুলী নদীর শাহআমানত ব্রিজ থেকে ফিরিঙ্গিবাজার মনোহর খালী পর্যন্ত কর্ণফুলী প্রস্থ জরিপ করেছে। উক্ত জরিপে কর্ণফুলীর দখল ও ভরাট হওয়ায় ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে।

বিএস সিট ও এডিবি বন্দর যৌথভাবে প্রণীত মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী কর্ণফুলীর প্রস্থ ধরে উক্ত জরীপ করা হয়।

জরীপে দেখা যায়, কর্ণফুলী ব্রিজ নির্মানের সময় এডিবি মাস্টার প্ল্যান ও বিএস সিট অনুযায়ী কর্ণফুলী দৈর্ঘ্য ছিল ৮৮৬.১৬ মিটার। আমাদের জরিপে দেখা যায়, শাহা আমানত সেতুর নিচে বর্তমানে কর্ণফুলী নদী ভাটার সময় প্রস্থ মাত্র ৪১০ মিটার। জোয়ারের সময় চর অতিক্রম করে ৫১০ মিটার পর্যন্ত জোয়ারের পানি আসে।

ভরাট হয়ে যাওয়ায় সেই অংশে কোন প্রকার নৌযান চলাচল করেনা। নদী ভরাট হওয়ায় শাহ আমানত সেতুর মাঝ পিলারের পাশে অঘোষিত একটি যাত্রী পারাপার ঘাট তৈরি করেছে স্থানীয়রা। জোয়ার ভাটার সময় লিংক রোড থেকে অর্থ কিলোমিটার নদীর অংশ পায়ে হেটে যাত্রীরা ব্রিজের নিচে কর্ণফুলী নদীর মাঝখানে এসে সাম্পানে উঠে।

চাক্তাই খালের মুখে এসে বিএস সিট ও এডিপি মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী নদীর প্রস্থ ৯৮২ মিটার। বাস্তবে ৫১০ মিটার নদী রয়েছে। এর পর চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্মিত মেরিনার্স পার্ক এলাকায় কর্ণফুলীর প্রস্থ ৯৮১ মিটার। বন্দর কতৃপক্ষ বর্তমানে সেই অংশে খনন করেছে। খননের পর নদীর প্রস্থ দাড়িয়ে মাত্র ৮৫০ মিটার। এরপর ফিরিঙ্গি বাজার মোড়ে কর্ণফুলী নদীর প্রস্থ ৯০৪ মিটার। বর্তমানে বন্দর খনন করার পর সেখানে নদী আছে ৭৫০ মিটার। বাকি অংশ চট্টগ্রাম বন্দর কর্তপক্ষ গাইড ওয়াল নির্মান করে চিরতরে বিলুপ্ত করে দিয়েছে।

জরিপ পরিচালিত জরিপে দেখা যায়, কর্ণফুলী ব্রিজের উত্তর অংশে ৪৭৬ মিটার কর্ণফুলী নদী ভরাট হওয়ায় জোয়ার ভাটার সময় সেখানে ব্যাপক নদীর স্রোত হয় । স্রোতের এই তীব্রতার চাপ কর্ণফুলীর দক্ষিণ প্রান্তে শাহ আমানত ব্রিজের সংযোগ সড়কের বর্ধিত অংশ ও দুই পিলারে পড়ছে। যা শাহা আমানত সেতুর জন্য বিপজ্জনক। বন্যা বা সাইক্লোন হলে শাহ আমানত ব্রিজের ব্যাপক ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

রাজাখালী খাল ও চাক্তাই খালের মোহনা কর্ণফুলী সেতুর মাঝ বরাবর সংযুক্ত হয়েছে। বৃষ্টি বা নদীতে জোয়ারের উচ্চতা বাড়লে ছোট কর্ণফুলী অংশের প্রবল চাপ সৃষ্টি হয়। যে কারণে চট্টগ্রাম নগরী থেকে চাক্তাই ও রাজাখালী খালে প্রবাহিত পানি নদীতে আসতে বাধা সৃষ্টি করে। এর ফলে চাক্তাই খাতুনগঞ্জ থেকে শুরু করে বহদ্দার মোড় পর্যন্ত জলাবন্ধতার সৃষ্টি হয়।

জরিপে প্রতিফলিত হয়, কর্ণফুলী ব্রিজের পশ্চিম পাশে রাজখালী খালের পাশে বেড়ামার্কেট বস্তি, রাজাখালী ও চাক্তাই খালের সংযোগস্থলে সোনালী মৎস আড়ৎ, চাক্তাই খালের পশ্চিম পাড় থেকে ফিরিঙ্গিবাজার পর্যন্ত মেরিন ফিশারিজ পার্ক সম্পূর্ণ কর্ণফুলী দখল করে গড়ে উঠেছে। এডিবি মাস্টার প্ল্যানে এই সমস্থ মার্কেটের অস্থিত্ব নাই। সেখানে নদী দেখানো হয়েছে। বন্দরের স্বাভাবিক গতি প্রবাহ, কর্ণফুলী ব্রিজ রক্ষা ও চাক্তাই খাতুনগঞ্জসহ নগরীর বিস্তৃর্ণ এলাকা নিয়মিত প্লাবন থেকে রক্ষা করতে এবং কর্ণফুলীর স্বাভাবিক গতি প্রবাহ রক্ষা করতে এইসব স্থাপনা উচ্ছেদ করে মেরিন সড়ককে কর্ণফুলীর তীর ধরে তা গাইড ওয়াল তৈরি করা জরুরি।

নদী রক্ষা কমিশনের প্রতিবেদন-
জেলা প্রশাসনের জরিপ অনুযায়ী, বিএস রেকর্ড অনুযায়ী কর্ণফুলীর তীরে অবৈধ স্থাপনা ২ হাজার ১১২টি। এর মধ্যে ব্যক্তি পর্যায়ে ২ হাজার ১০৮টি, বেসরকারি সংস্থার ১টি ও সরকারি সংস্থার ৩টি স্থাপনা রয়েছে। অপর দিকে আরএস রেকর্ড অনুযায়ী ৭৫টি অবৈধ স্থাপনা রয়েছে। এর মধ্যে ব্যক্তি পর্যায়ে ৬২টি, বেসরকারি সংস্থার ৯টি ও সরকারি সংস্থার ৪টি স্থাপনা রয়েছে।

কর্ণফুলী নদী রক্ষায় প্রয়োজনীয় নির্দেশনা চেয়ে ২০১০ সালে হাইকোর্টে রিট করে মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইআরপিবি)। এর চূড়ান্ত শুনানি নিয়ে ২০১৬ সালের ১৬ আগস্ট হাইকোর্ট কয়েক দফা নির্দেশনাসহ রায় দেন। রায়ে ওই নদীর তীরে থাকা ২ হাজার ১৮১টি অবৈধ স্থাপনা সরাতে নির্দেশ দেওয়া হয়। রায়ে অপসারণের বিষয়ে আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়নের অগ্রগতি প্রতিবেদন জেলা প্রশাসকসহ বিবাদীদের দাখিল করতে নির্দেশ দিয়ে বলা হয়, বিষয়টি চলমান পর্যবেক্ষণ থাকবে।

মনজিল মোরসেদ বলেন, আদালতের নির্দেশ অনুসারে ২০১৫ সালে কর্ণফুলী নদীর পাড়ে যেসব অবৈধ স্থাপনা আছে, তার তালিকা আদালতে দাখিল করা হয়েছিল। এসব স্থাপনা উচ্ছেদে ২০১৬ সালে হাইকোর্ট রায় দেন। তবে রায় অনুসারে ব্যবস্থা না নেওয়ায় জেলা প্রশাসকসহ কয়েকজন বিবাদীর প্রতি আদালত অবমাননার রুল হয়। এরপর চলতি বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি জেলা প্রশাসক উচ্ছেদ কার্যক্রম, যা পাঁচ দিন পর বন্ধ হয়ে যায়। এ অবস্থায় ওই আবেদন করা হয়। আদালত চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যানের প্রতি ওই নির্দেশ দিয়েছেন।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.