বিদ্রোহী কবির ১২২তম জন্মবার্ষিকী আজ

0

সিটি নিউজ ডেস্ক: তিনি দ্রোহের কবি। মানবতা ও সাম্যের কবি। শোষিত ও নিপীড়িত মানুষের কণ্ঠস্বর। তিনি প্রেমেরও কবি। বিদ্রোহের রণশিঙ্গা হাতে সব অনিয়ম-শৃঙ্খল ভেঙে মানুষে মানুষে সাম্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখিয়েছেন তিনি। আবার অবুঝ প্রেমের দোলাতেও দুলিয়েছেন তরুণ হৃদয়। তিনি নজরুল— জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো এই মহান পুরুষের আজ ১২২তম জন্মবার্ষিকী।

১৮৯৯ সালে ২৫ মে বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্ম ক্ষণজন্মা কাজী নজরুলের। দারিদ্র্যপীড়িত এক শৈশবের পর বাউন্ডুলে-ছন্নছাড়া জীবন কাটিয়েও বাংলা সাহিত্যের আকাশে তার আবির্ভাব ধূমকেতুর মতো, তারুণ্যের তেজদীপ্ততায় সবাইকে চমকে দিয়ে। তবে ধূমকেতুর মতো ক্ষণস্থায়ী নয়, ধ্রুবতারার মতো এক স্থায়ী আসন তিনি গড়ে নিয়েছেন বাংলায়।

শোষণ, নিপীড়ন, বঞ্চনার বিরুদ্ধে এক দৃপ্ত কণ্ঠস্বর ছিলেন নজরুল। মানুষের প্রতি, মানবতার প্রতি অন্যায়-অনিয়ম আর বঞ্চনা তার হৃদয়ে রক্ত ঝরাত। আর তাতে কেবল বেদনা নয়, সেসব অন্যায়-অনিয়মের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ অসি হয়ে বেরিয়ে আসত তার মসির কালিতে। ব্রিটিশরাজ তখন ক্ষমতায়, তার বিরুদ্ধেও সমান সোচ্চার নজরুলের কলম। তাই বারবার শোষকের কোপানলে পড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন কারাগারে। কিন্তু আপসহীনতার আদর্শে অন্যায়ের কাছে মাথানত করেননি, প্রতিবারই ফিরে এসেছেন আপন মহিমায়।

দ্রোহের সঙ্গে সঙ্গে নজরুলের সাহিত্যেও তাই সমানভাবে মিশে আছে সাম্য ও মানবতাবাদ। মানুষে মানুষে সাম্যের বাণী এমন করে আর কেউ বলেনি তার আগে। তবে ছন্নছাড়া এই চিরতরুণের বুকের ভেতরে এক কোমল হৃদয়ের বসবাসও ছিল, অভিমান আর আবেগ তাতে জলসিঞ্চন করত। প্রেমের অপরূপ বাণী তাই নিঃসৃত হয়েছে তার কলম থেকেই।

বিদ্রোহী কবি হিসেবেই কাজী নজরুলের পরিচিতি তার অন্য সব পরিচয়কে ছাপিয়ে গিয়েছে। তারপরও সংগীতজ্ঞ, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক, চলচ্চিত্রকার, গায়ক ও অভিনেতা— এমন অসংখ্য পরিচয়ের প্রতিটিতেই স্বমহিমায় ভাস্বর নজরুল। অগ্নিবীণা, বিষের বাঁশী, দোলন চাঁপা, ছায়ানট, ইত্যাদি তার বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ। বাঁধনহারা, মৃত্যুক্ষুধা, কুহেলিকা তার উপন্যাস। ব্যথার দান, রিক্তের বেদন, শিউলিমালা ইত্যাদি তার বিখ্যাত গল্পগ্রন্থ।

এর বাইরে বিশেষ করে বাংলা গানে কাজী নজরুলের অবদান অনন্য। তার হাত ধরে অসংখ্য রাগ-রাগিনীর সৃজন বাংলা গানের ভাণ্ডারকে করে সমৃদ্ধ। লোকজ বিভিন্ন ধাঁচে করা তার গানগুলোও আবহমান বাংলা ও বাংলার মানুষের রঙ-রূপ-আবেগ-অনুভূতিকে ফুটিয়ে তুলেছে অপরূপ রূপে। তিন হাজারেরও বেশি গানের রচয়িতা নজরুলের কাছে বাংলা গান অনেকখানি ঋণী।

শৈশব থেকেই এক সংগ্রামী জীবন কেটেছে কাজী নজরুল ইসলামের। ১৯০৮ সালে পিতার মৃত্যুর পর মাত্র ১০ বছর বয়সেই উপার্জনে নামতে হয় তাকে। মক্তবের শিক্ষক, মুয়াজ্জিন ও মাজারের খাদেম, লেটোর দলের হয়ে গান বাধা, নাটকে অভিনয় করা— জীবন ও জীবিকার জন্য কী করেননি তিনি! রেলের ইংরেজ গার্ডের খানসামা, রুটির দোকানের কর্মচারী হিসেবেও কাজ করতে হয়েছে। আর জীবন সংগ্রামের এই যুদ্ধে কোথাও থিতু হয়েও বসতে পারেননি।

এর মধ্যেই কাজী নজরুলের শিক্ষা জীবন কেটেছে রানীগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ স্কুল, মাথরুন উচ্চ ইংরেজি স্কুল, ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালের দরিরাম স্কুলে। দারিদ্র্যের কষাঘাত কবিবে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা শেষ করতে দেয়নি। সিয়ারসোল রাজ স্কুলে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর তিনি যোগ দিয়েছিলেন সেনাবাহিনীতে।

দুরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত হয়ে মাত্র চল্লিশেই সাহিত্য সাধনা স্তব্ধ হয়ে যায় কাজী নজরুল ইসলামের। স্মৃতিবিভ্রাটের শিকার হন, শয্যাগত হয়ে পড়েন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কবিকে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। তাকে বাংলাদেশের জাতীয় কবির সম্মান দেন। ১৯৭৬ সালের ২৭ আগস্ট সব জাগতিক বাঁধন ছিন্ন করে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন নজরুল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে তাকে সমাহিত করা হয়।

জাতীয় কবির ১২২তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাণী দিয়েছেন। বাণীতে রাষ্ট্রপতি বলেন, বাংলা সাহিত্য-সংগীতে কাজী নজরুল ইসলামের অবদান অনস্বীকার্য। তার লেখায় অন্যায়, অসত্য, নির্যাতন, পরাধীনতার গ্লানি ও শৃঙ্খল মোচনের দীপ্ত উচ্চারণ যুগ যুগ ধরে মানুষকে সাহসী হওয়ার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। নজরুলের অবিনশ্বর উপস্থিতি বাঙালি জাতির প্রাণশক্তিকে চিরকাল জাগরিত রাখবে।

বাণীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, কবি নজরুলের সাহিত্য ও সংগীত শোষণ, বঞ্চনা ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে মুক্তির দীক্ষা স্বরূপ। তার ক্ষুরধার লেখনীর স্ফূলিঙ্গ যেমন ব্রিটিশ শাসনের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল, তেমনি তার বাণী ও সুরের অমিয় ঝরনাধারা সিঞ্চিত করেছে বাঙালির হৃদয়কে। কবি নজরুল তার প্রত্যয়ী ও বলিষ্ঠ লেখনীর মাধ্যমে এ দেশের মানুষকে মুক্তি সংগ্রামে অনুপ্রাণিত ও উদ্দীপ্ত করেছিলেন। তার গান ও কবিতা সবসময় যেকোনো স্বাধীনতা আন্দোলনে অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।

জাতীয় কবির জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে প্রতিবছর জাতীয় পর্যায়ে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করা হলেও গত বছরের মতো এ বছরও করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে তেমন কোনো আনুষ্ঠানিকতরা থাকছে না। তবে সকালে বিভিন্ন সংগঠন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ সংলগ্ন কবির সমাধিতে শ্রদ্ধা জানাবে।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ সকাল সাড়ে ৭টায় কবির সমাধিতে শ্রদ্ধা জানাবেন। রাত ৮টা ৩০ মিনিটে আর্ন্তজাতিক নজরুল চর্চা কেন্দ্র এক প্রীতি সম্মেলন আয়োজন করেছে। সেখানে প্রধান অতিথি হিসাবে যোগ দেবেন প্রতিমন্ত্রী।

জাতীয় কবির জন্মদিনে সোমবার (২৪ মে) থেকেই শুরু হয়েছে দুই দিনব্যাপী ‘আমিই নজরুল আর্ন্তজাতিক নজরুল উৎসব’। নজরুলের সাম্যবাদ নিয়ে এ আয়োজন করেছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সংগঠন ‘মুক্ত আসর’। উৎসবে বাংলাদেশ, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও পর্তুগাল থেকে ৩২ জন নজরুল গবেষক, লেখক ও নজরুল সংগীতশিল্পী অংশ নিচ্ছেন।

এছাড়াও বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতার এবং বেসরকারি বিভিন্ন টেলিভিশন ও বেতার চ্যানেল কবির জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করবে। সংবাদপত্র ও অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলো দিনটি উপলক্ষে প্রকাশ করবে বিশেষ রচনা।

সিটি নিউজ/এসআরএস

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.