হিলফুল ফুজুল থেকে গাউসিয়া কমিটি; এক সুনিপুণ মেলবন্ধন 

0

সাইফুল ইসলাম চৌধুরী : হুজুর কেবলা তৈয়্যব শাহ (রহ.), এই ক্রিয়াশীল মোবারকময় নামটি আত্মার প্রশান্তি। হৃদয়ের শিহরণ। প্রেমের ঝর্ণাধারা। যে প্রেমের মেলবন্ধন সুদূর বাগদাদ হয়ে ঈমানের বাড়ি মদিনা। গাউসে জামান তৈয়্যব শাহ আশেক ভক্তের শিরে তাজ।

মানব দরদী, মানবতার পীর, হুজুর গাউসে জামান আল্লামা হাফেজ ক্বারী সৈয়দ মুহাম্মাদ তৈয়্যব শাহ (রহ.)’র অনন্য অবদান বোদ্ধা মহলে সমাদৃত। অবশ্য এ মহান সংস্কারকের সম্মানিত পিতা শাহানশাহে সিরিকোট (রহ.)’র এহসানও অনস্বীকার্য। এশিয়া খ্যাত আধুনিক দ্বীনি বিদ্যাপীঠ জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া মাদরাসা ও সেবা সংস্থা  আনজুমানে রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া হুজুর কুতুবুল আউলিয়া শাহানশাহে সিরিকোটের অমর কীর্তি।

যেগুলো আজ শান্তিকামী মুসলমানদের রাজমুকুট। প্রেরণার আধার, প্রত্যাশার বাতিঘর হুজুর কেবলা তৈয়্যব শাহ (রহ.)’র এক একটি মহান সংস্কার, এক একটি নিদিষ্ট দল বা সম্প্রাদায়ের জন্য ছিল। যেমন ইলমে দ্বীনের (মাদরাসা) সংস্কার আলেম ও ছাত্রদের জন্য। জশনে জুলুছ সুন্নি জনতার জন্য প্রধান প্রাণের উৎস। ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের সংস্কারগুলো মুসলমানদের জন্যই। এভাবে প্রত্যেকটা অবদান।

এ মহান মুজাদ্দিদের একটি অনন্য তাজদিদ (সংস্কার) সারা সৃষ্টি জাহানের জন্য। যা প্রমানিত হয়েছে ২০২০ সালের অন্ধকারাচ্ছন্ন করোনাকালিন। আর তা হলো মানবতার সংগঠন গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ। প্রতিদিন সূর্যের উদয়াস্ত হয়। কিন্তু ১৯৮৬ সালে হুজুর কেবলার নির্দেশে বাংলার আকাশে যে নতুন সূর্যের উদয় হয়েছিল, ইনশাআল্লাহ তাঁর সূর্যাস্ত হবে না কেয়ামততক। সে দীপ্তিময় সূর্যের নাম হলো গাউসিয়া কমিটি। পবিত্র কুরআনের সুমহান নির্দেশ  “সত্যবাদীদের সাথী হও” শ্লোগানকে সামনে রেখে এ সত্যান্বেষী জান্নাতি কাফেলার পথচলা শুরু।

অবশ্য এ মাদানি কাফেলার গোড়াপত্তন আরও বহুদিন আগে। বলাচলে দূর আরবে মরুর দুলাল প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (দ.) প্রতিষ্ঠিত হিলফুল ফুজুলের ছায়াসংগঠন গাউসিয়া কমিটি। ফিলফুল ফুজুল প্রতিষ্ঠা করেন প্রিয় রাসূল (দ.) আর গাউসিয়া কমিটি প্রতিষ্ঠা করেন আউলাদে রাসূল (দ.)। তাই উভয় সংগঠনের কার্যক্রমে আছে সুনিপুণ মিল। আরবের বিখ্যাত ওকাজ মেলায় জুয়া খেলাকে কেন্দ্র করে কুরাইশ ও হাওয়াজিন গোত্রের মধ্যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে। পাঁচ বছর চলতে থাকা এই যুদ্ধে অনেক প্রাণহানি ঘটে। এ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ থেকে ফিরিয়ে সকলের মাঝে শান্তি ও সৌহার্দ্য নিশ্চিতে সমমনা যুবকদের নিয়ে কুরাইশ কর্তৃক আল আমীন খেতাবপ্রাপ্ত হযরত মুহাম্মদ (দ.) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এ শান্তিসংঘ। যে সংগঠন অন্ধকারাচ্ছন্ন আরব সমাজে জ্যোতি ছড়িয়েছে।

আল্লাহ তায়ালা বলেন, “ওমা আরসালনাকা ইল্লা রহমাতাল্লিল আলামিন। অর্থ: আর অবশ্যই আমি আপনাকে বিশ্বমানবতার জন্য রহমত করে পাঠিয়েছি।” হুজুরের সারাজীবন ছিল এ আয়াতের পূর্ণ প্রতিফলন। সামাজিক ঐক্য ও শান্তি প্রতিষ্ঠা, যুদ্ধ বন্ধ করে সম্প্রীতি গড়া, নিঃস্ব, বিধবা ও অভাবীদের পাশে দাঁড়ানো, বিদেশি বণিকদের জানমালের নিরাপত্তা দেয়া, সব ধরনের অন্যায় ও অবিচারের অবসান ঘটিয়ে ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করা এবং সর্বোপরি গোত্র, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে মানবতার কল্যাণে কাজ করাই ছিল হিলফুল ফুজুলের উদ্দেশ্য। প্রিয় রাসূলের হিলফুল ফুজুল আর আউলাদে রাসূলের গাউসিয়া কমিটি।

প্রতিষ্ঠার পর থেকে এযাবৎ কল্যাণমূলক কাজগুলো নিয়ে গবেষণা করলে যেকোনো বিদগ্ধজনের কাছে গাউসিয়া কমিটি নিঃসন্দেহে হিলফুল ফুজুলের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন মনে হবেই। তরিকত জগতের আফতাব গাউসিয়া কমিটি এখন মানবতার আকাশে ধ্রুবতারা।

মানবতার পরম বন্ধু হুজুর গাউসে জামান তৈয়্যব শাহ (রহ.) প্রতিষ্ঠিত গাউসিয়া কমিটি শুরুতে মসজিদ, মাদরাসা, খানেকা ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে সীমাবদ্ধ থেকে মানুষকে সিরাতুল মুস্তাকিম তথা সহজ সরল পথ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের দিকে আহবান করেছেন। কুপথে চলা পথিককে দিয়েছেন সৎপথের সন্ধান। নিশ্চিত জাহান্নামিকে দেখিয়েছেন জান্নাতের স্বপ্ন। চট্টগ্রাম থেকে প্রতিষ্ঠিত গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ আজ শুধু চট্টগ্রাম কিংবা বাংলাদেশে সীমাবদ্ধ নেই। পাকিস্তানের হরিপুর থেকে বিচ্ছুরিত নূর আজ নিখিল দুনিয়াকে মুনাওয়ার করেছে। চট্টগ্রামের গাউসিয়া কমিটি আজ সারা পৃথিবীতে বিস্তৃত।

আধ্যাত্মিক সংগঠনের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ হওয়া গাউসিয়া কমিটি বর্তমানে আষ্টেপৃষ্ঠে একটি মানবতার সেবায় সেচ্ছাসেবী সংগঠনে রূপ নিয়েছে। যা পৃথিবীবাসীর জন্য সুখবর। নিজের মেয়ে বিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব পিতার হলেও, পিতা-মাতা কিংবা বড় ভাইয়ের অপারগতায় এ দায়িত্ব কাধে তুলে নেন মানবিক গাউসিয়া কমিটি। গাছ লাগিয়ে পরিবেশ বাঁনোর দায়িত্ব পরিবেশ অধিদপ্তরের। কিন্তু বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির মাধ্যমে মুক্ত নিঃশ্বাস সঞ্চালনের ব্যবস্থা করছেন সচেতন গাউসিয়া কমিটি। শীতার্তদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ।

শিক্ষার্থীদের শিক্ষাসহায়তা প্রদান। মুসলিম শিশুদের জন্য খৎনা কর্মসূচি। অসহায়ের মুখে অন্নদান। সমাজের কুপ্রথা, অপসংস্কৃতি, ধর্ষণ, মাদক, জোরজুলুম, সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদসহ সবধরনের অন্যায়ের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান। বেকারকে কর্মসংস্থান গড়ে দেওয়া গাউসিয়া কমিটির জনকল্যাণমুখী চলমান কর্মসূচির অন্যতম। গাউসিয়া কমিটির এসব কার্যক্রম ঐতিহাসিক হিলফুল ফুজুলের কার্যক্রমের সদৃশ।

আন্তর্জাতিক সেবা সংস্থা আনজুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়ার অঙ্গ সংগঠন গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ বর্তমানে মানবতার সংগঠন হিসেবেই সমধিক সমাদৃত। মানবতা শব্দটি যখন বইয়ের মলাটে আবদ্ধ। টকশোর টেবিলে সীমাবদ্ধ।

কথিত মানবাধিকার কর্মীদের বক্তব্যের ভাষা মাত্র। মানবতা শব্দের যত্রতত্র ব্যাপারে বেচারা মানবতা শব্দটি নিজেই যখন অমানবিকতার জাতাকলে পিষ্ট ঠিক তখনই মানবতার বাস্তব সংজ্ঞা হয়ে ভিন্নরূপে আবির্ভাব হলো মানবতার বন্ধু গাউসিয়া কমিটির। সকলের জানা পৃথিবী নামক মানবগ্রহটি আজ বড় অন্ধকার সময় পার করছে। এ অন্ধকার রাতের গহিন কালোর চেয়েও ঢের কালো। চারদিকে বাজছে এক নিরব যুদ্ধের দামামা।

যে যুদ্ধের নাম কভিট-১৯ বা করোনা মহামারি। সে যুদ্ধ কোন দেশের সাথে দেশের নয়; বরং অদৃশ্য মরণঘাতী ভাইরাসের সাথে মানবসভ্যতার। বিপর্যস্ত হচ্ছে মানুষ ও মানবতা। আজ মানুষ যেন মানুষের বড় শত্রু। প্রেমালিঙ্গণ মানা। পাশে বসা নিষেধ। একে অন্যের স্পর্শ যেন বিষের চেয়েও বিষাক্ত। একের স্পর্শে অন্যের কাছে যাওয়া করোনা ভাইরাসের ভয়ে মুহূর্তেই সন্তান ভুলে যাচ্ছে পিতা-মাতার স্বর্গীয় সম্পর্ক।

অসুস্থ আপনজন সঙ্গীহারা। অথচ প্রিয় নবীর সুন্নাত হলো অসুস্থ ব্যাক্তির সেবা করা। করোনা উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুবরণকারীর লাশ পড়ে আছে ঘরে বা বাড়ির আঙ্গিনায়, কেউ ছুঁয়েও দেখে না। দাফন-কাফন তো দূরের কথা। অসুস্থ বাবাকে পাওয়া যাচ্ছে রাস্তার ধারে। করোনা উপসর্গ আছে বলে মাকে হাসপাতালের গেইটে ফেলে সন্তানের পালায়ন। স্ত্রীকে রেখে স্বামীর দৌড়! মানবতার আর্তনাদে আকাশ বাতাস বারি হয়ে আসছে। টকশোর টেবিল গরম করে এক কথিত মানবিক উপস্থাপিকার জোর দাবি করোনায় মৃত্যুবরণকারীদের পুড়িয়ে ফেলা হোক!

এমন ঘোষণা একজন প্রকৃত মানবিক মানুষের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ করলো। এক মানবপ্রেমীর চোখের ঘুম কেড়ে নিল। কী করা যায় মানবতার জন্য, কী করা যায়; ভাবতে ভাবতে চিন্তার বন্দরে নোঙর করলো এক অসাধারণ কনসেপ্ট। আর তা হলো করোনায় মৃতের দাফন-কাফন ও সৎকার কার্যক্রম। এ দুঃসাধ্য কর্মযজ্ঞের সহজ স্বপ্নদ্রষ্টা আর কেউ নন, সিরিকোট বাগানের সুবাসিত ফুল, হোসাইনী আদর্শে অনুপ্রাণিত গাউসে পাকের সৈনিক, বিশিষ্ট আইনজ্ঞ, বরেণ্য গবেষক এডভোকেট সৈয়দ মোছাহেব উদ্দিন বখতিয়ার। যিনি মানবতার সংগঠন গাউসিয়া কমিটির যুগ্ম মহাসচিব ও আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আত বাংলাদেশের সম্মানিত মুখপাত্র।

সেদিন এ বিদগ্ধ সংগঠকের একটি ফেইসবুক স্টাটাস (করোনায় মৃত্যুবরণকারীদের দাফন-কাফন করবে গাউসিয়া কমিটি) ক্ষোভ, ভয় ও শঙ্কিত আত্মায় প্রশান্তির সূর্যোদয় ঘটায়। সবাই নিজে নিজেকে অভয় দিতে শুরু করে। যাক সর্বহারাদের জন্য অন্তত  গাউসিয়া কমিটি আছে। ঘোষণা মাত্রই কাজ শুরু। প্রথমে উপজেলা প্রশাসন ও ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সমন্বয়ে কাজ শুরু হলেও পরের চিত্র ভিন্ন।

তখনও করোনা এমন ভয়াবহ আকার ধারণ করেনি। কেউ কেউ বলছিল করোনা বাংলাদেশে আসবে না। আসলেও ভয়াবহ হবে না। কিন্তু দূরদর্শী গাউসিয়া কমিটির মানবিক টিম সেইদিন থেকে প্রস্তুত ছিল। ২০২০ সালের শুরুতে করোনা সংক্রমণ কম থাকলেও করোনা এখন ভয়ংকর থেকে ভয়ংকর।

আজ পর্যন্ত এ করোয়ায় বাংলাদেশে প্রায় ২০ হাজার তাজাপ্রাণ ঝড়ে গেছে। সংক্রামণের কোন অন্ত নেই। প্রথমে শহরে করোনার বসবাস হলেও এখন করোনা বেশি গ্রামে। সারাবিশ্বে একটিই শ্লোগান ঘরে থাকুন, ঘরে থাকুন এবং ঘরে থাকুন। প্রায় সকলেই যখন ঘরে তখন গাউসিয়া কমিটির মানবিক কর্মীরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে দিবা-রাত্রি বাইরে। সব চাকরিতে ছুটি আছে। আছে বিশ্রাম। কিন্তু এ মানবিক কাজে ঈদের দিনেও ছুটি নেই। নেই রাতেও বিশ্রাম। ছুটি কেউ দিচ্ছি না তা নয়; বরং বলা চলে এ মানবিক কর্মীরা ছুটি নিচ্ছে না! রমজানে সবাই যখন বাহারি ইফতারের পশরা সাজিয়ে বসে, ঠিক তখন গাউসিয়া কমিটির মানবিক কর্মীরা লাশ কিংবা অক্সিজেন নিয়ে ব্যস্ত।

ইফতার হিসেবে সামান্য পানিতেই স্বাদ মেটাচ্ছিল। রোজামুখে সবাই যখন বিশ্রামে গাউসিয়া কমিটির মানবিক কর্মীরা তখন লকডাউনে কর্মহীন মানুষের ঘরে ঘরে সাহরি ও ইফতার সামগ্রী নিয়ে পাশে দাঁড়াচ্ছিল। ঈদুল ফিতরে সবাই যখন নিজের শপিংয়ে ব্যস্ত, ঠিক তখন গাউসিয়া কমিটির কর্মীরা নিজের শপিংয়ের টাকায় অভুক্তের মুখে অন্নদান করে হাসি ফুটাচ্ছিল। ঈদুল আযহায় যখন আমরা কুরবানি পশুর গোশতের ঝোলে পিঠা ভিজিয়ে অমৃতের স্বাদ নিয়েছিলাম, ঠিক তখন গাউসিয়া কমিটির মানবিক কর্মীরা মুমূর্ষুর মুখে অক্সিজেন সেবা দিয়ে বাঁচার স্বপ্ন দেখাচ্ছিল।

এ সেবা কি শুধু মুসলমানদের জন্য? নারে ভাই, না। এ সেবা সব মানুষের জন্য। হোক না সে লাওয়ারিশ, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান। সকলের তরে গাউসিয়া কমিটির এহসান। গাউসিয়া কমিটির মানবসেবা বিধর্মীদের কাছেও শান্তির বার্তা দেয়।

দিন-রাত বিনিময়হীন কর্মে ছুটে চলা। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা, ঝড়-তুফান, বৃষ্টি-বাদল, আগুন-পানি কোন বাধায় তাঁদের এ অদম্য ছুটে চলার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। যে করোনা রোগী ভয়ের কারণ, সে করোনা রোগীর সেবায় ব্যস্ত গাউসিয়া কমিটি। স্বজনের ফেলে দেওয়া ভালোবাসাগুলোকে খুড়িয়ে কাধে তুলে শেষ বিদায়ে উপযুক্ত মর্যাদা দিচ্ছে গাউসিয়া কমিটি। আজ আমার বলতে দ্বিধা নেই, গাউসিয়া কমিটি তরিকত জগতের মুখ উজ্জ্বল করেছেন।  হে আল্লাহ এ মানবিক মানুষগুলোকে নিরাপদে রাখুন। উত্তম প্রতিদান প্রদান করে সম্মানিত করুন উভয় জাহানে। সব চেয়ে বিষ্ময়কর ব্যাপার হলো, করোনার ভয়ে আপনজন একে অন্যকে ফেলে চলে গেলেও; করোনা রোগীর সেবা ও দাফন-কাফন টিমের একজন মানবিক কর্মীও অদ্যাবধি করোনায় আক্রান্ত হয়নি। আলহামদুলিল্লাহ।

এ কাজে গাউসিয়া কমিটির চারটি অ্যাম্বুলেন্সের পাশাপাশি রয়েছে প্রায় তিন হাজার স্বেচ্ছাসেবক। যে ফোন করছে রোগী বহনের জন্য। এম্বুলেন্স ছুটে চলছে সেদিকে। একটু নিঃশ্বাসের জন্য চারিদিকে হাহাকার। একটু অক্সিজেন হলে বেঁচে যায় তাজাপ্রাণ। বাঁচার শেষ অবলম্বন অক্সিজেন নিয়ে হাজির গাউসিয়া কমিটি। গভীর রাতেও রোগীর স্বজনের ফোনে বিরক্ত হন না মানবিক টিমের সদস্য মাওলানা আব্দুল্লাহ ও আহসান হাবিব চৌধুরী হাসান। প্রতিদিন ২০ জন মৃত ব্যক্তির লাশ দাফন-কাফনের কাজ করতে হয় তাঁদের। শুধু মুসলিম নয় হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের সৎকারেও কোন গড়িমসি নেই। হ্যাঁ, এটাই প্রিয় নবীর দেখানো উত্তম পথ। এটাই মানবতা। হাসপাতাল যখন অসহায় আত্মসমর্পণ করেছে তখনও গাউসিয়া কমিটি কাদাজল গায়ে মেখে দিয়ে যাচ্ছে সেবা। করে যাচ্ছে দাফন কাফন। প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, সর্বশেষ ২৫ জুলাই পর্যন্ত চট্টগ্রামে ২ হাজার ৯২৪ জনসহ সারাদেশে ৩ হাজার ৫৭৯ জন মৃত ব্যক্তির দাফন ও সৎকার সম্পন্ন করেছে গাউসিয়া কমিটি। এদের মধ্যে ৩৭ জন হিন্দু, ৫ জন বৌদ্ধ, ১ জন মারমা, ১ জন খ্রিস্টানসহ মোট ৪৪ জন ভিন্ন ধর্মাবলম্বী। এছাড়া ৩৭ জন মুক্তিযোদ্ধা, ২৪ জন অজ্ঞাত লাশ এবং ৪ জন কারাবন্দি কয়েদির লাশ দাফন করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জীবন্ত সংজ্ঞা উপস্থাপন করেন মানবিক গাউসিয়া কমিটি।

এ পর্যন্ত ২১ হাজার ০৩৭ জন করোনা রোগীকে জরুরি অক্সিজেন সেবা দেওয়া হয়েছে। অ্যাম্বুলেন্স সেবা দেওয়া হয়েছে ৫ হাজার ৬৯ জনকে। প্রায় ১২০০০ জনকে দেওয়া হয়েছে ফ্রি চিকিৎসা সেবা। প্রতিদিন গড়ে ৪০ জন ব্যক্তিকে ভ্রাম্যমাণ কোভিড-১৯ টেস্ট টিমের সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। অন্ধের যষ্টি গাউসিয়া কমিটি এ করোনাকালে প্রায় আড়াই লাখ পরিবারকে দিয়েছেন খাদ্য ও অর্থ সহায়তা। এছাড়াও সারাবিশ্বে বিস্তৃত গাউসিয়ার গর্বিত কর্মীরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অগণিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে মানবতার স্বাক্ষর রেখেছেন। ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরাও আজ গাউসিয়া কমিটির সামনে শ্রদ্ধাবনত। মসজিদ-মাদরাসা-খানেকা আর মুসলমানদের গাউসিয়া কমিটির মানবতার আলো আজ গীর্জা, মন্দির ও প্যাগোডায়। বিনাযুদ্ধে এ বিজয় সত্য দ্বীনের। এ বিজয় শান্তির ধর্ম ইসলামের। এ বিজয় সুফিবাদী মুসলমানদের।

বিভিন্ন মুসলিম বুদ্ধিজীবী ও ইসলামী সংগঠন মুহাম্মদ (দ.)’র রাজনৈতিক জীবন নিয়ে হাঁক ডাক দেখালেও মানবসেবা ও সামাজিক কাজে তাদের অনুপস্থিতি আমাদের আশাহত করে। পাশাপাশি মহানবী (দ.)’র আশেক পরিচয় দেওয়া বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে বিশাল বিশাল আয়োজন হলেও হুজুর পাকের দেখানো মানবসেবার আদর্শিক ও সাংগঠনিক কার্যক্রম চোখে পড়ে না। অথচ মহানবী (দ)’র আদর্শের প্রতিফলন ছাড়া শান্তির কথা কল্পনাও করা যায় না। পবিত্র কুরআনের ভাষায়, “তোমাদের জন্য রাসূল (দ.)’র জীবনেই রয়েছে সর্বোত্তম আদর্শ।” আরও এসেছে, “রাসূল তোমাদের জন্য যা নিয়ে এসেছেন তা গ্রহণ কর এবং যা থেকে বিরত থাকতে বলেছেন তা বর্জন কর। আর আল্লাহকে ভয় কর। অপরাধীদের জন্য তিনি কঠোর শাস্তিদাতা।” তাই আসুন! আমরা নবীজির সাংগঠনিক সুন্নাতকে লালন করি। প্রিয় নবীর হিলফুল ফুজুলের অনুপ্রেরণায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে মানুষের কল্যাণে নিজের মেধা-শ্রম ব্যয় করি। শেষ বিদায়ের সাথী গাউসিয়া কমিটির এ মানবিক কর্মযজ্ঞে নিজেকে সম্পৃক্ত করে গাউসে জামান তৈয়্যব শাহ (রহ.)’র বেলায়তের খাতায় নাম লেখাই। তবেই ইসলাম স্বমহিমায় বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। তবেই বুক চেতিয়ে বলা যাবে আমরাই শ্রেষ্ঠ নবীর গর্বিত উম্মত।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও গবেষক 
প্রতিষ্ঠাতা: আলো একাডেমি, চট্টগ্রাম। 
msinejam@gmail.com

সিটি নিউজ/এসআরএস

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.