চট্টগ্রামে তদবির বানিজ্য 

0

জুবায়ের সিদ্দিকী –  

রাজনীতির মানচিত্রে তদবির এখন একটি অপরিহার্য বিষয় হয়ে পড়েছে। সামাজিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, এমনকি রাষ্ট্রীয় সব কর্মকান্ডে তদবিরের কোন বিকল্প নেই। সিডিএর নকশা অনুমোদন থেকে শুরু করে বিদ্যুৎ সংযোগ, গ্যাস সংযোগ, পানির লাইন সহ রাজনীতি, ব্যবসা, বানিজ্য, অর্থনীতি, বিজ্ঞাপন বানিজ্যের তদবির থেকে সব ক্ষেত্রে তদবিরের প্রয়োজন পড়ে। চাহিদামাফিক টাকার পাশাপাশি তদবিরও জরুরী হয়ে পড়ে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে মোটা অংকের টাকা সহ শক্তিশালী তদবিরের দরকার। চাকরীর আবেদন থেকে শুরু করে নিয়োগপ্রাপ্তী, পদোন্নতি, এমনকি পছন্দসই জায়গায় পোষ্টিং পাওয়ার জন্য ঘাটে ঘাটে চলে তদবির। মন্ত্রী, এমপি অথবা রাজনৈতিক দলের সরকারী ও বিরোধীদলের নেতা হতেও চলে তদবির। দেশের তদবিরবাজি রীতিমত প্রাতিষ্টানিক রুপ নিয়েছে। এই নগরীতে রাজনৈতিক অনেক নেতা অফিস চেম্বার সাজিয়েও তদবির বাজি ও দালালীতে লিপ্ত।

বিভিন্ন থানা, ভুমি অফিস, বিদ্যুৎ, গ্যাস, ওয়াসা, সিটি কর্পোরেশন, সিডিএ, জেলা পরিষদ, আদালত, জেলা প্রশাসনের অফিস সমুহে চট্টগ্রাম মহানগরীতে প্রায় দুইশ’জন পেশাদার দালাল তদবিরবাজ ধাপিয়ে বেড়াচ্ছেন এমন অনেক অভিযোগ রয়েছে। এমন কোন কাজ নেই, যা তদবিরবাজরা করতে পারেন না। তদবিরবাজদের অপ্রতিরোধ্য কর্মকান্ড চলছে সর্বত্র। জেলা পর্যায়ের সব দপ্তর, বন্দর, কাস্টমস, সিডিএ, সিটি কর্পোরেশন, আদালতের মালখানা, সাব রেজিষ্ট্রি অফিস, তহশিল অফিস, রেকর্ড ও জরিপ দপ্তর পর্যন্ত সর্বত্র সমান বিচরন তদবিরবাজদের। এসব দপ্তরের এক শ্রেনীর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা তাদের প্রধান সহযোগী। নগরীতে এবং এসব দপ্তর ও থানার সামনে নিজেদের ছবিযুক্ত করে ঢাউস সাইকের প্লাষ্টিক সাইন, ব্যানার, ফেষ্টুন লাগিয়ে তদবিরবাজরা ক্ষমতাসীন দলের স্বঘোষিত নেতা বনে যান তারা। দলীয় পরিচয়ে যে কাউকে কর্মী ঘোষনা দিয়ে থানা থেকে ছাড়িয়ে নেওয়া সহ টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, দুর্নীতি ও লুটপাটের ভাগ বসাতে সক্ষম হন তারা। তদবির বানিজ্যে প্রভাবশালীদের ও ক্ষমতাসীন দলের এক শ্রেনীর নেতাকর্মীর উপার্জনের একটা বড় মাধ্যমে পরিনত হয়েছে।

তদবিরের প্রকোপ বেড়ে যাওয়াতে যোগ্যরা বঞ্চিত হচ্ছে নানা ক্ষেত্রে। যোগ্য প্রার্থীরা চাকরী পাচ্ছেন না। যোগ্য ব্যবসায়ী টিকে থাকতে পারছেন না টেন্ডারে। যোগ্য ছাত্র-ছাত্রী ব্যর্থ হচ্ছেন উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্টানে ভর্তি হতে। তদবিরের জন্য লাগছে টাকা। তদবিরবাজ দালালদের সবচেয়ে বেশি দৌরাত্ব্য দেখা যায় সিএমপি ও জেলার বিভিন্ন উপজেলায় থানাগুলোতে। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর থেকে থানা প্রাঙ্গনগুলো ভিড় জমে উঠতে থাকে। স্বঘোষিত নেতারা চামচা চাটুকার নিয়ে থানার অফিসার ইনচার্জ, অপারেশন অফিসার বা ওসি (তদন্ত) কক্ষকে নিজেদের আড্ডখানায় পরিনত করেন। রাত গভীর হলেই শুরু হয় তদবিরবাজদের আসল দৌরাত্ব্য। কাউকে ধরিয়ে আনা, মামলা ছাড়া ধরে হয়রানী, আটক আসামীকে মুক্ত করার কাজে ব্যস্ত থাকেন তদবিরবাজরা। জিডি থেকে শুরু করে মামলা নথিভুক্ত, আসামী আটক ও ছাড়িয়ে নেওয়ার নানা ধাপে মোটা অংকর টাকা হাতিয়ে নেন তারা। থানা পেরিয়ে তদবিরের বিস্তৃতি ঘটেছে মেট্রোপলিটন পুলিশ দপ্তর থেকে হেড কোয়াটার পর্যন্ত সর্বত্র। এসব দপ্তরে চলে কনষ্টেবল, এসআই, সার্জেন্টসহ অন্যান্য পদে বদলির তদবির। পাশাপাশি মামলার তদবিরও চলে কমবেশি।

পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, ক্ষমতাসীন দলের নেতা ছাড়াও কিছু দৈনিরে কথিত সাংবাদিকও পুলিশ প্রশাসন ছাড়াও কাষ্টম, বন্দর, তেল সেক্টর সহ প্রশাসনের নানা স্তরে তদবিরবানিজ্য করে এখন কোটিপতি সাংবাদিক। গাড়ি, ফ্ল্যাট. বাড়ি, জায়গা কিনে এখন এরা সমাজে অনেক বড় সাংবাদিক বলে পরিচিত। মফস্বল থেকে উঠে আসা অখ্যাত এসব সাংবাদিক কর্মস্থলের পত্রিকার জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে দাপটে আছেন । যেন তাদের তদবির বানিজ্যে এখন এরা মহারথী। ইলেক্ট্রিক মিডিয়ারও কিছু কর্মরত সাংবাদিক চলনে বলনে কথাবার্তায় মনে হয় ’তিনি ছাড়া নগরীতে কোন সাংবাদিক নেই’। তদবির বানিজ্য গ্রাস করেছে প্রবলভাবে তাদের দেহে ও মনে। বিগত সরকারের আমলে মফস্বলের এক থানাতে যেতে হয়েছিল পত্রিকার কাজে, এজেন্টদের ছিল ঝামেলা অথাৎ সংবাদপত্র এজেন্টদের ঝামেলা। থানায় গিয়ে দেখলাম, থানা চালাচ্ছে মফস্বলের তথিত সাংবাদিকরা। এদের কথায় পুলিশ মামলা দেওয়া ও না নেওয়ার কাজ সারছে। বর্তমান সরকারের আমলে মফস্বলের থানাগুলোর চিত্র আরও ভয়াবহ। এমপি ও মন্ত্রীদের এপিএস সহ চামচা-চাটুকাররা থানায় বসে পুলিশকে তদবিরে বিরক্ত ও অপকর্মের অনেক ফিরিস্তী কমবেশি এখন ওপেন সিক্রেট। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, যে ক্ষমতাসীন বা অংগ সংগঠনের সদস্য পদ না জুটলেও ’জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানের সঙ্গে নিজের ঢাউস ছবি যুক্ত করতে এতটুকু দ্বিধা নেই। কয়েক ডজন রংবেরং এর প্যানাসাইন টাঙ্গিয়ে দেন হাটবাজারে।

সিএনজি ষ্ট্যান্ড, নগরীর মোড়, থেকে শুরু করে প্রশাসনিক দপ্তরের যত্র তত্র। নব্বইয়ের দশকের থেকেই মুলত রাজনীতির নামে বিত্তশালী হওয়া ও ভোগবিলাশের সংস্কৃতি শুরু। ধারাবাহিকভাবে এর পরের নেতারাও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে টেন্ডারবাজি, নিয়োগ, তদবির ও কমিটি বানিজ্য, টিকাদারী সহ নানা কাজে পকেট ভরছেন। এসব লোভনীয় উত্থানের কারনেই রাজনীতি না করেই টাকার বিনিময়ে নেতা বনে যাওয়ার প্রবনতার সুত্রপাত ঘটে। চুনোপুটি অনেক নেতা, পাতি নেতা, চামচা, চাটুকার মন্ত্রী, এমপিদের পেছনে ঘুর ঘুর করে কোটিপতি হয়েছেন। সমাজে ও প্রশাসনে এদের দাপটই সবচেয়ে বেশি। নগরীর পত্রিকাপাড়া খ্যাত জামালখান চেরাগীপাহাড় এলাকায় দেখা হল একজন নেতার সাথে বেশ কয়েকবছর পর। চেহারাতে যেন ঝিলিক মারছে। এক সাবেক মন্ত্রীর পাইক পেয়াদা হিসাবে রোজগার করেছেন ভাল। বিএনপি সরকারের আমলে এলাকা ছাড়া এই নেতা অফিসে এসে বলতেন, আমাদের জায়গা এখন আপনার অফিসে। এলাকায় যেতে পারছি না। মামলা ও হামলার ভয়। সে নেতা এখন এত ব্যস্ত যে, কথা বলারও সময় নেই। অবৈধ অর্থে এসব নেতাদের গায়ে জমেছে অতিরিক্ত চর্বি। চট্টগ্রাম মহানগরীতে এই তদবিরলীগের শীর্ষে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের অনেকেই জড়িয়ে আছেন আষ্টেপৃষ্টে এমনভাবে যে, রাজনীতি মানেই যেন তাদের কাছে তদবিরবাজি।

এই তদবিরবাজির কারনে তৃনমুলের ত্যাগী নেতাকর্মীগন কোনঠাসা হয়ে পড়েছেন। অবৈধ অর্থের ও অযাচিত দাপটের কাছে রাজনীতি যেন আজ অসহায় হয়ে পড়েছে। পেশিশক্তি, প্রভাবশালী, বিত্তশালীদের পকেটে চলে গেছে রাজনীতি। সাধারন মানুষের কাছে রাজনীতি মানে এখন তদবিরবানিজ্য, ব্যবসা বানিজ্য, আধিপত্যের লড়াই ইত্যাদি। তদবির বানিজ্যের কাছে রাজনীতি এখন যেন জিম্মি হয়ে পড়েছে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে এখানকার ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিবিদরা সরে আসছেন। মুখে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মুজিবকোর্ট পড়লেই বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক বলা যায় না। এমপি মন্ত্রীদের অনেকেই এখন নানা কর্মকান্ডে প্রশ্নবিদ্ধ।

অটোপাশ এমপিদের নানা অবৈধ কর্মকান্ডে মানুষকে বিরক্তিকর করে তুলেছে। এটা দলের ভাবমুর্তি বিনষ্টের কাজ করছে। এভাবে যত্র তত্র তদবিরবানিজ্য চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে যাচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের। এই তদবিরবানিজ্য মারাত্বকভাবে ক্ষতি করছে সমাজ ও রাষ্ট্রকে। সভ্য সমাজে বাস করেও আমরা যেন মানুষকে জলাঞ্জলি দিচ্ছি। রাজনীতির এই কুৎসিত কালচার যেন সর্বত্র।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.