আজ রাজশাহী মুক্ত দিবস

0

সিটিনিউজবিডি :: রাজশাহী মুক্ত দিবস ১৮ ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালের এই দিনে রাজশাহী শত্রুমুক্ত হয়েছিল। রাজশাহীর অবরুদ্ধ মানুষ এদিন নেমে এসেছিলেন মুক্ত বাতাসে। তারা হারানো স্বজনদের খুঁজতে ছুটে যান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুজ্জোহা হলে এবং সেখান থেকে উদ্ধার হয়েছিল নির্যাতিত বাঙালীর লাশ ও বিবস্ত্র নারী।

রাজশাহীর মুক্তিযোদ্ধা নূর হামীম রিজভি বীরপ্রতীক জানান, ঘোষণার আগেই রাজশাহীতে শুরু হয়েছিল স্বাধিকারের আন্দোলন। পাকিস্তানের দুঃশাসন থেকে বাঁচার জন্য রাজশাহীবাসী ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ থেকেই শহরের সর্বত্রই মিছিল ও হরতাল পালন করতে থাকেন। হরতাল চলাকালে পাকিস্তানী আর্মিরা মালোপাড়া টেলিফোন এক্সচেঞ্জ অফিসের ছাদ থেকে মুক্তিকামী মানুষের ওপর গুলি চালালে একজন মারা যান। এ ঘটনার প্রতিবাদে ওই দিন বিকেলে ভুবনমোহন পার্কে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সেখান থেকেই মূলত শুরু হয় রাজশাহীতে আন্দোলন।

তিনি জানান, ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর রাজশাহীর মুক্তিকামী মানুষ প্রবল শক্তি ও উদ্যম নিয়ে বিভিন্নভাবে পাক আর্মিকে প্রতিরোধে নেমে পড়ে। এদের প্রতিরোধে প্রথমে ব্যবহার করা হয় হাতবোমা। রাজশাহী কলেজের ছাত্ররা এ হাতবোমা তৈরির রাসায়নিক পদার্থ হস্তগত করেছিল। ২৩ মার্চ ছিল পাকিস্তানী প্রজাতন্ত্র দিবস, কিন্তু রাজশাহীর পুলিশবাহিনী তা অমান্য করে তার পরিবর্তে পালন করল প্রতিবাদ দিবস। হাবিলদার আতিয়ার রাজশাহী পুলিশ লাইনসে ওড়ালেন বাংলাদেশের পতাকা। এতে ক্ষুব্ধ হয় পাক আর্মিরা এবং পুলিশকে অস্ত্র সমর্পণ করার আদেশ দেয়। কিন্তু তারা এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে।

পাক সেনারা ২৬ মার্চ সকালে ডিআইজি মামুন মাহমুদকে তার গাড়ি ও ড্রাইভারসহ নিয়ে যায় রংপুরে এবং হত্যা করে তার কলম ও চশমা রাজশাহীতে পাঠিয়ে দেয়। ২৭ মার্চ সন্ধ্যার আগে পাক সেনারা রাজশাহী পুলিশ লাইনসের পূর্বে গির্জার কাছে অবস্থান নিয়ে পুলিশকে আবারও অস্ত্র ত্যাগ করে আত্মসমর্পণ করার নির্দেশ দেয়। কিন্তু তারা অস্বীকৃতি জানালে বেধে যায় তুমুল যুদ্ধ। সারারাত ধরে চলল প্রচণ্ড গোলাগুলি। পাকবাহিনীর সঙ্গে পুলিশবাহিনী প্রচণ্ড লড়াই করে। পরদিন ২৮ মার্চ দুপুরে পাক সেনারা মর্টারশেল মেরে দখলে নেয় রাজশাহী পুলিশ লাইনস এবং বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে বহু পুলিশকে।

মুক্তিযুদ্ধকালে রাজশাহী সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের চেয়ারম্যান ও প্রবীণ রাজনীতিক এ্যাডভোকেট আব্দুল হাদী, ২৮ মার্চ রাজশাহী পুলিশ লাইনসের পতন হলেও ৩ এপ্রিল পর্যন্ত ক্যাপ্টেন গিয়াস ও সারদা ক্যাডেট কলেজে কর্মরত ক্যাপ্টেন রশীদের নেতৃত্বে এখানে প্রতিরোধ যুদ্ধ অব্যাহত রাখা হয়। একপর্যায়ে পাক আর্মিরা কোণঠাসা হয়ে পড়ে এবং রাজশাহী ক্যান্টনমেন্টে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। উপায়ন্তর না পেয়ে পাকিস্তান থেকে আসা বিমান বর্ণালী মোড়, দরগাপাড়া ও শিবপুর এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর গুলি চালাতে থাকে। এর আগে ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে পাক হানাদারবাহিনী আওয়ামী লীগ নেতা এ্যাডভোকেট আব্দুস সালামের বাড়িতে হানা দেয়। তাকে না পেয়ে তার দুই মেধাবী সন্তান সেলিম এবং ওয়াসিমকে হত্যা করে। ২ এপ্রিল পাক হানাদাররা রাজশাহী প্রেস ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি বাম নেতা এ্যাডভোকেট বীরেন্দ্রনাথ সরকারকে তার ষষ্টিতলা বাসায় গুলি করে হত্যা করে। ১৩ এপ্রিল আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত পাক সেনাদের ৮৪টি ট্রাকের কনভয় যমুনা নদী পাড় হয়ে রাজশাহী এসে পৌঁছে। তাদের অতর্কিত আক্রমণে বেলপুকুরিয়ায় হাবিলদার আকবরসহ ৩২ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।

১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানে শাহাদাতবরণকারী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহার নামে উৎসর্গিত জোহা হলে পাক আর্মিরা এসে আস্তানা গাড়ে। সেখানে রাজশাহীর মুক্তিকামী নারী-পুরুষ-যুবকদের ধরে এনে চালানো হয় বর্বরতম নির্যাতন। ১৪ এপ্রিল রাতেই পাক সেনারা রাবির ভাষা বিভাগের শিক্ষক সুখরঞ্জন সমাদ্দারের বাসায় হানা দিয়ে তাকে ধরে নিয়ে হত্যা করে। বিনোদপুর বাজারের বধ্যভূমিতে তাকে মাটিচাপা দেওয়া হয়। ওই দিন হত্যা করা হয় আরও শ’খানেক মুক্তিকামী মানুষকে। ১৫ এপ্রিল পাক বাহিনী রাবির গণিত বিভাগের শিক্ষক হবিবুর রহমানকে হত্যা করে। আলবদর, আলশামস ও রাজাকারবাহিনী ন্যক্কারজনকভাবে পাক হানাদারদের সাহায্য করতে থাকে। অনেক যুবককে ধরে এনে দেয় রাজাকাররা। এ সময় নারীদের তুলে দেওয়া পাক সেনাদের কাছে। ২৮ জুন ধরে নিয়ে যায় দৈনিক আজাদ পত্রিকার রাজশাহী প্রতিনিধি ও রাজশাহী সাংবাদিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবু সাঈদকে এবং তাকে রাবির জোহা হলে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়।

এদিকে ভারত থেকে ট্রেনিং নিয়ে আসা মুক্তিযোদ্ধারা রাজশাহী এসে পৌঁছলে অক্টোবর মাসে যুদ্ধে নতুন মোড় নেয়। ১০ অক্টোবর মুক্তিযোদ্ধারা ভানপুরে ট্রেন অপারেশন চালায়। ওই দিন গভীর রাতে রেললাইনে মাইন পুঁতে ৩২ জন পাক সেনাকে উড়িয়ে দেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। ২৫ নভেম্বর রাবির মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মীর আব্দুল কাইয়ুমসহ ১৭ জনকে ধরে নিয়ে হত্যা করে পাক সেনারা। এভাবে একের পর এক শহীদ হন এখানকার মুক্তিকামী মানুষ। এক সময় ভারতীয় বিমান পাক সেনাদের ঘাঁটিগুলোতে বোমাবর্ষণ করতে শুরু করে। এতে তারা দিশাহারা হয়ে পড়ে। আত্মরক্ষার্থে পাক সেনারা রাজশাহী ক্যান্টনমেন্ট থেকে সরতে শুরু করে। ১৭ ডিসেম্বর তারা জোহা হলে একত্রিত হয় এবং রাতের অন্ধকারে নাটোরের দিকে পালিয়ে যেতে শুরু করে। এদিনই রাজশাহীর মানুষ পাক সেনাদের কবল থেকে মুক্তি পায়। আর তাদের হারানো স্বজনদের লাশ খুঁজে পায় রাবির জোহা হলসহ বিভিন্ন বধ্যভূমিতে।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.