সোনা চোরাচালানে জড়িত চট্টগ্রামের সিন্ডিকেট

0

জুবায়ের সিদ্দিকী – 

আন্তর্জাতিক সাত সিন্ডিকেটের সহযোগী হিসেবে দেশী ২০টি চক্রের হাতে জিম্মি হয়েছে সোনা চোরাচালান। এসব চক্রে সরাসরি সম্পৃক্ত বিভিন্ন স্তরের দুই শতাধিক সদস্য। দেশের ২টি আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর সহ কয়েকটি পয়েন্টে গড়ে তুলেছে শক্তিশালী ঘাঁটি। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ছাড়াও অন্তত আটটি আন্তর্জাতিক এয়ারলাইন্স কর্মকর্তাদের সঙ্গে গোপন যোগসাজস রয়েছে তাদের। বিমানের একজন কর্মকর্তা সহ অর্ধ শতাধিক কর্মী সোনা চোরাচালানে সরাসরি ভুমিকা রাখে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। অনুসন্ধানে ও অভিযোগে জানা যায় যে, সিভিল এভিয়েন্সের বেশকিছু কর্মকর্তা কর্মচারী সহ ঢাকায় শাহজালাল বিমানবন্দর ও চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরে নিয়োজিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কতিপয় সদস্য এই সিন্ডিকেটের সক্রিয় কর্মী। বিমানবন্দরে সোনার চালান আনা নেওয়া নির্বিঘেœ করতে রয়েছে নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী। দেশের বিমানবন্দর কেন্দ্রীক দলীয় কোন নেতার তত্ত্বাবধানে রীতিমত পেশাদার অপরাধী গ্রুপ গড়ে উঠেছে। বিমান বন্দর ও সংলগ্ন এলাকায় সোনা চোরাচালানীদের আশ্রয়দাতা এসব অস্ত্রবাজ রাতদিন বিচরন করে এবং ঘুরে বেড়ায় যথেচ্ছ।

বিগত কয়েক বছরে দেশে সোনা চোরাচালানীরা অসম্ভব রকমের প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে। বিমানবন্দরে বিশেষ নজরদারীর মাধ্যমে মনে মনে সোনা আটক করেও চোরাচালানীদের দৌরাত্ব্য কোনভাবেই থামানো যাচ্ছে না। মাঝে মধ্যে সোনার চালান আটক হওয়া নিয়ে অবাক হওয়ার মতো নানা তথ্য পাওয়া গেছে। অভিজ্ঞ মহল মনে করেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক সোনার চালান আটক হওয়ার বিষয়টি হাস্যকর। তাদের ভাষায়, চোরাচালানীরাই তাদের নির্বিঘেœ পাচারের কৌশল হিসেবে ছোট আকারের চালানগুলো ধরিয়ে দেয়। এসব নিয়ে হৈ চৈ হলেও তাদের ধরে রাখা যায় না। আইন আদালতে তাদের কারও শাস্তিও নিশ্চিত করা হয়নি। অদৃশ্য ক্ষমতাবলে নানান ঘাট মাড়িয়ে এরা বের হয়ে আসেন। ২০১৩ সালের জানুয়ানী থেকে চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে ২টি বিমানবন্দর সহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে চোরাপথে আসা প্রায় ৪৬মন সোনা আটক হয়েছে। এসব ঘটনায় ১৩৫ ব্যক্তিকে আটক করা হয়। বিভিন্ন সংস্থা মামলা করে ১৪২টি। ধৃত ব্যক্তিদের অধিকাংশই জামিনে বেরিয়ে গেছেন। কোনভাবেই তাদের জেলে আটকে রাখা সম্ভব হয় না।

কোন মামলায় একেকজন আসামী হাইকোর্ট থেকে জামিন পাওয়ার পর ওই মামলার অন্য আসামীরা সেই জামিন আদেশ দেখিয়ে নি¤œ আদালত থেকে জামিন নিচ্ছেন। এ ছাড়া এসব মামলার তদন্তেও তেমন অগ্রগতি নেই। মনে মনে সোনা উদ্ধার, ডজন ডজন মামলা ও আটকের পরও বন্ধ হয়নি সোনা চোরাচালান বাড়ছে দিন দিন।
অনুসন্ধানে জানা যায় যে, ২০০৯ সালে সরকারী বিভিন্ন সংস্থার হাতে চোরাচালানের পৌনে ২২ কেজি সোনা ধরা পড়ে। এ ছাড়া ২০১০ সালে ৯ কেজি, ২০১১ সালে ৪ কেজি, ২০১২সালে প্রায় ২৪ কেজি ধরা পড়ে। গত বছরে এই সোনার চোরাচালান ধরা পড়েছে কয়েকগুন বেশি। ২০১৩ সালে গড়ে ৫০০ কেজি সোনা আটক করা হয়েছে। এসব সোনার আনুমানিক দাম ৬৭ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। ২০১৪ সালের জানুয়ারী থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসে ৪১৪ কেজি ১৭০ গ্রাম সোনা আটক হয়, যার বাজার মুল্য ১৮৮ কোটি ২৯ লাখ টাকা।

এ সময় আটক হয়েছেন ৩৭ জন। ২০১৪ সালের জুলাই থেকে ২৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত জব্দ করা ২২৭ কেজি ৭৩৮ গ্রাম সোনার দাম ১১৩ কোটি ৩৫ লাখ টাকা আর আটক হয়েছেন ৩৮জন। চলতি বছরে প্রথম ১০ মাসে প্রায় ৬৫০ কেজি সোনা আটক হয়ে গ্রেফতার হয়েছেন ৪৪ জন। চট্টগ্রামে সোনা চোরাচালানের কাজে রয়েছে বেশকিছু বড় সিন্ডিকেট। এসব সিন্ডিকেট চালিয়ে যাচ্ছেন তাদের অপকর্ম। গোয়েন্দাদের সুত্র থেকে জানা যায় যে, এসব সিন্ডিকেট প্রধানরা বাংলাদেশী নাগরিক হলেও তারা প্রায় সবাই সেকেন্ড হোম গড়ে তুলেছে দুবাইতে। এরা পরিবার নিয়ে দুবাইতেই বসবাস করছেন। গোয়েন্দারা বলছেন, সোনা চোরাচালানের কর্মকান্ডে সহায়তা করে থাকে বিমানের অর্ধ শতাধিক কর্মী। ক্লিনার থেকে ঝাড়ুদার, ফ্লাইট ষ্টুয়াড, কেবিন ক্রু, বিমানবালা, পাইলট, ক্যাপ্টেন সহ বিমানের অনেক কর্মকর্তা। বিমানবন্দরে কর্মরত ৬টি বেসরকারী সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাধ্যমে এই সোনার চালান বাহিরে আসে। সোনা চোরাচালান হিসেবে মুল হোতা হয়ে কাজ জরছে ১৮ জন রাঘববোয়াল। এদের হাত অনেক লম্বা। প্রভাবশালীদের সখ্যতা গড়ে এরা বাধাহীন ভাবে চালিয়ে যাচ্ছে তাদের অবাধ কর্মকান্ড। চোরাচালানীদের প্রধান ও প্রথম পছন্দ চট্টগ্রাম। চট্টগ্রাম বিমানবন্দর ও সমুদ্রবন্দরের মাধ্যমে সোনার প্রচুর চালান প্রবেশ করছে। এরপর নদী, সড়ক ও ট্রেনপথে ঢাকায় এসে বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাচার হচ্ছে।

আরব আমিরাতের দুবাই, আবুধাবী, সারজা, রাস আল খাইমা সহ বিভিন্ন স্থানে বাংলাদেশের শীর্ষ চোরাচালানীদের হেড কোয়ার্টার রয়েছে। এখান থেকে চট্টগ্রাম হয়ে ভারতে পাচারের জন্য পাঠানো হয়ে থাকে। ভারতের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেটের সাথে এসব সিন্ডিকেটের রয়েছে নিবিড় যোগাযোগ। চট্টগ্রামের প্রভাবশালী বেশকিছু রাঘববোয়াল জড়িত বিভিন্নভাবে এসব সিন্ডিকেটের সাথে। চট্টগ্রাম বিমানবন্দরেও জড়িত বিভিন্ন সংস্থার লোকজন। গত দুই বছরে ঢাকা হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ব্যবহার করে ব্যাপকহারে সোনা চোরাচালান হওয়ার ঘটনায় দেশের শীর্ষ পর্যায়ের সব গোয়েন্দা সংস্থার বিশেষ নজরদারী শুরু হয়। এর ফলে ঢাকা বিমানবন্দরে কড়াকড়ি আরোপ করায় সোনা চোরাচালানীরা নতুন পথ বেছে নেয়।

এ ক্ষেত্রে তাদের প্রথম পছন্দ চট্টগ্রাম। চট্টগ্রাম বিমানবন্দর ও সমুদ্র বন্দরের মাধ্যমে সোরার প্রচুর চালান প্রবেশ করছে। সিন্ডিকেটে বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতায় থাকা প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়ায় এরা বেপরোয়া হয়ে তাদের অপরাধ চালিয়ে যাচ্ছে। গোয়েন্দাদের ধারনা, সোনা চোরাচালানে জড়িত রাঘববোয়ালরা বরাবরের মত ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে সবসময়। আইনের ফাঁকফোঁকরে বের হয়ে আসে চুনোপুটিরা অর্থাৎ বহনকারীরা। কিন্তু নেপথ্যে নিরাপদে থাকে গড়ফাদাররা। এদের বিরুদ্ধে কোন সময়ে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। কোন তদন্তেই বের হয়ে আসে না মুলনায়কদের নাম ঠিকানা। রহস্যের বেড়াজালে সব সময় অন্ধকারে রয়ে সোনা চোরাচালানের মুল মালিকদের পরিচয়। ওরা ধরা পড়ে না। ওদের পরিচয় জানা যায় না। ওদের আইন স্পর্শ করে না।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.