বাংলার বন্ধু জ্যাকবের চিরবিদায়

0

সিটিনিউজবিডি :: একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনীকে আত্মসমর্পণে রাজি করিয়ে নিজে হাতে দলিলের খসড়া লিখেছিলেন যিনি, বাংলাদেশের বন্ধু সেই ভারতীয় জেনারেল জেএফআর জ্যাকব আর নেই। বেশ কিছুদিন অসুস’তার পর ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত এই লেফটেন্যান্ট জেনারেল গতকাল সকালে দিল্লির একটি সামরিক হাসপাতালে মারা যান। তার বয়স হয়েছিল ৯২ বছর। খবর বিডিনিউজ’র।

তার ব্যক্তিগত সহকারী কিম বাহাদুর জানান, নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ায় গত ১ জানুয়ারি জেএফআর জ্যাকবকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ‘স্যার স্মৃতিভ্রমসহ বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন সমস্যায় ভুগছিলেন। তবে শেষ সময়েও তার চেতনা জাগ্রত ছিল। একজন সৈনিকের মতোই মুখে হাসি নিয়ে তিনি মারা গেছেন।’

মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্বে পূর্ব পাকিস্তানের রণাঙ্গনে সরাসরি যোগ দেয় ভারতীয় সেনাবাহিনী। ঢাকা দখলের মূল পরিকল্পনায় মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি ছিলেন ভারতীয় সেনানায়করাও। জেনারেল জ্যাকব তখন ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় চিফ অব স্টাফ।

‘সারেন্ডার ইন ঢাকা, বার্থ অফ এ নেশন’ এবং ‘অ্যান ওডেসি ইন ওয়ার অ্যান্ড পিস’ বইয়ে জ্যাকব লিখে গেছেন সেইসব আগুনঝরা দিনের কথা, যে পথ ধরে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক এএকে নিয়াজী ঢাকার তখনকার রেসকোর্স ময়দানে ভারত ও বাংলাদেশের যৌথবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন, পৃথিবীর মানচিত্রে জন্ম হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের।

মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয়দের অংশগ্রহণের প্রসঙ্গে যেটুকু আলোচনা তার বেশিরভাগই তৎকালীন ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল স্যাম মানেক্শকে ঘিরে, যিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ও বীরত্বের জন্য ‘মিলিটারি ক্রস’ অর্জন করেন।

সেই দিনগুলোতে ভারতীয় পূর্বাঞ্চলীয় সেনা কমান্ডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার ওপর খুব বেশি আস’া রাখতে পারছিলেন না মানেক্শ। ফলে মুক্তিযুদ্ধের সমর পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়নের দায়িত্ব বর্তায় তখনকার মেজর জেনারেল জ্যাকবের ওপর।

মুক্তিযুদ্ধে ‘এস ফোর্স’ এর অধিনায়ক ও সেক্টর কমান্ডার কে এম সফিউল্লাহ বলেন, ‘জে এফ আর জ্যাকবের সহযোগিতাতেই ঢাকায় পাকিস্তান বাহিনীর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজীর আত্মসমর্পণ পত্রের খসড়া তৈরি এবং এ সংক্রান্ত সব আনুষ্ঠানিকতা ঠিক করা হয়। জ্যাকব একজন দক্ষ সেনা কর্মকর্তা। পাকিস্তানি বাহিনীর বিপর্যয়ের শুরুতেই জ্যাকব তাদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনী কখন, কোথায় ও কীভাবে আত্মসমর্পণ করবে সেটাও ঠিক করেছিলেন তিনি।’

জ্যাকব বুঝতে পেরেছিলেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সফল হতে হলে এর ভূ-রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু ঢাকা দখল করতে হবে আগে। তাই নিজস্ব পরিকল্পনা অনুসারেই ভারতীয় পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডকে রণাঙ্গনে এগিয়ে নিচ্ছিলেন তিনি, যদিও সেনা সদরদপ্তর তার পরিকল্পনাকে উচ্চাভিলাষী বলেছিল।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অগ্রসরমান ভারতীয় সেনা কন্টিনজেন্ট শত্রুর প্রতিরোধ গুঁড়িয়ে দিয়ে দ্রুততার সঙ্গে ঢাকার দিকে এগিয়ে যায়, যা ভেঙে দেয় পাকিস্তানি সৈন্যদের মনোবল। মাত্র ছয়দিনের মধ্যে মূল লক্ষ্যের কাছাকাছি পৌঁছে যায় ভারতীয় সেনাবাহিনী। শত্রুর অবস’ানের তথ্য আগেভাগে জানিয়ে ও বিপদসঙ্কুল জলাভূমিগুলো এড়ানোর পথ দেখিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা ভারতীয় সেনাদের অগ্রযাত্রায় গতি সঞ্চার করেন।

১৬ ডিসেম্বর সকাল ৯টায় যৌথবাহিনীর কাছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ করার কথা থাকলেও পরে তা ছয় ঘণ্টা পেছানো হয়। জেনারেল জ্যাকবই পরে নিয়াজীর সঙ্গে আলোচনা করে তাকে প্রস্তাব মেনে নিয়ে আত্মসমর্পণে রাজি হতে বাধ্য করেন।

জ্যাকব ফার্জ রাফায়েল জ্যাকবের জন্ম ১৯২৩ সালে। ইরাক থেকে প্রায় দেড়শ বছর আগে কলকাতায় বসতি গড়া এক ইহুদি পরিবারের সন্তান তিনি। ব্যবসায়ী বাবা ছেলেকে লেখাপড়ার জন্য পাঠিয়েছিলেন দার্জিলিংয়ের একটি স্কুলে। ১৯৪১ সালে ১৮ বছর বয়সে ব্রিটিশ সরকারের অধীন ভারতীয় সেনাবাহিনীতে নাম লেখান জ্যাকব। শুরুতে জ্যাকবের সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার বিষয়টি মেনে নিতে না পারলেও পরে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ইহুদিদের ওপর নাৎসী বাহিনীর নির্যাতনের বিভৎসতা দেখে বাবার মনোভাব পাল্টায়।

তিন যুগের সৈনিক জীবনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে অংশ নেন জ্যাকব। সাহসিকতার জন্য পেয়েছেন নানা পদক।
১৯৭৮ সালে সেনাবাহিনী থেকে অবসরে যাওয়ার পর জ্যাকব বিজেপিতে যোগ দেন এবং পার্টির নিরাপত্তা উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন। গোয়া ও পাঞ্জাবের গভর্নরের দায়িত্বও তিনি পালন করেন।

আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখা বিদেশি বন্ধুদের সম্মাননা জানানোর উদ্যোগ নিলে ২০১২ সালের ২৭ মার্চ আরও ৮৩ জনের সঙ্গে রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা নেন অবসরপ্রাপ্ত লেফটেনেন্ট জেনারেল জেএফআর জ্যাকব।
সম্মাননা নেওয়ার পর ভারতের অবসরপ্রাপ্ত লেফটেনেন্ট জেনারেল জেএফআর জ্যাকব মঞ্চে দাঁড়িয়ে দর্শকদের দিকে তাকিয়ে স্যালুট দেন। দর্শকসারি জয় বাংলা শ্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠলে তিনিও বলেন- ‘জয় বাংলা’।11902-jacamar

এর আগে ২০০৮ সালের মার্চে বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে ঢাকায় এসেছিলেন জ্যাকব। সে সময় ভারতীয় হাই কমিশনে এক অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধা ও ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অসাধারণ বীরত্বের সুবাদেই স্বাধীন হয়েছে বাংলাদেশ। সীমিত সামর্থ্য নিয়ে স্রেফ তুমুল দেশপ্রেম পুঁজি করেই একটাশক্তিশালী নিয়মিত বাহিনীর বিরুদ্ধে জয় ছিনিয়ে এনেছে তারা। আমরা তাদের সাহায্য করেছি, আমরা তাদের সহযোদ্ধা। কিন’ তাদের লড়াইটা তারা নিজেরাই লড়েছে। চেতনার পুরোটা ঢেলে দিয়েই তারা তাদের লক্ষ্য পূরণ করেছে।’

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.