মাছের রাজা ইলিশ, দেশের রাজা পুলিশ

0

জুবায়ের সিদ্দিকী – 

পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি অনিয়ম স্বজনপ্রীতির অভিযোগ অনেক পুরনো। ঘুষ ছাড়া সেবা দানের অনীহা, প্রভাবশালী রাজনৈতিক মহলকে তুষ্ট করার প্রানন্তর চেষ্টা, অর্থ আদায়ে নিরহ মানুষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়া, অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ক্রসফায়ারের হুমকি কিংবা পেন্ডিং মামলায় চালান করা সবকিছুই চলছে মহাসমারোহে। দেশজুড়ে পুলিশী ভাবমুর্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে কিছু পুলিশ সদস্য। পুলিশ সদস্যদের দৃষ্টান্তমুলক ব্যবস্থা কখনো দৃশ্যমান হয়নি জনগনের কাছে। পুলিশের অপরাধকে কঠোর হস্তে দমন না করায় সমাজে পুলিশ দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে। বিএনপি বলছে, সরকারের অবাধ প্রশ্রয়ে পুলিশ বাড়াবাড়ি করছে। টহল পুলিশ রাস্তার মানুষ নিয়ে টানা হেচড়াও আজ নতুন নয়। শহরের প্রায় থানায় পুলিশের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ। ঢাকায় বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা রাব্বি ও সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তা বিকাশকে বেধম মারধর করেছে। বিকাশকে মারধর করার সময় বলেছে,’ মাছের রাজা ইলিশ, দেশের রাজা পুলিশ’।

এ ছাড়া সাদা পোশাকের পুলিশ নানা বিড়ম্বনার সৃষ্টি করছে। চট্টগ্রাম মহানগরীতে থানা পুলিশ বা ট্রাফিক পুলিশের ডিউটিরত অবস্থায় সোর্স ও চামচা লালনের অভ্যাস রয়েছে। এ ছাড়া পুলিশের ঘুষ বানিজ্য থেকে চাঁদাবাজি রেকর্ড ছাড়িয়ে যাচ্ছে। পুলিশের এই বেপরোয়া আচরনের লাগাম টেনে না ধরায় বারবার মানুষ নিগৃহীত হচ্ছে। কর্মস্থলে ও কর্মস্থল থেকে বাসায় ফিরতে পুলিশের আক্রমনের শিকার হচ্ছে মানুষ। সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসীদের দমনের চেয়ে পুলিশ বেশি তৎপর হয়ে উঠে টাকা রোজগারে।
পুলিশের জবাবদিহিতা না থাকায় সমস্যা হচ্ছে প্রকট। সাময়িক বরখাস্ত, ষ্ট্যান্ড রিলিজ, বদলী, প্রত্যাহারের মত কোনটা শাস্তির আওতায় পড়ে না। অনেক পুলিশ এতই বেপরোয়া হয়ে উঠে যে, আইন প্রয়োগের চেয়ে আইন নিজেরাই ভঙ্গ করেন অনেক কর্মকর্তা। একজন সাংবাদিক মোটরসাইকেল নিয়ে চট্টগ্রামের মেহেদীবাগ এলাকা দিয়ে যাচ্ছিলেন। গোলপাহাড় এলাকায় কর্তব্যরত সার্জেন্ট ছিদ্দিক সিগন্যাল দিয়ে থামালেন তাকে। জিজ্ঞেস করলেন ডকুমেন্ট আছে কি না? সাংবাদিক বললেন, জি, ডকুমেন্ট আছে। আমি পত্রিকার লোক।’ এই কথায় তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন সার্জেন্ট ছিদ্দিক। বললেন, তাতে কি আপনি কি প্রেসিডেন্ট হয়েছেন! এমন সময় ভাগ্যক্রমে সে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম, আর ঘটনাটি আমার চোখে পড়লো। সার্জেন্ট ছিদ্দিকের ভাবসাব দেখে মনে হয় তিনি পুলিশের আইজি।

ডবলমুরিং থানার এক দারোগা বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত কবির আহমদকে বন্ধুরা ’গাছ কবিরা’ বলতেন তার উচ্চতার জন্য।এই কবির দারোগা তার বাড়ির একটি মসজিদের চাঁদার বই সঙ্গে রাখতেন। মানুষের কাছ থেকে জোর করে মসজিদের জন্য রশিদমুলে চাঁদা আদায় করতেন। নগরীতে বিভিন্ন এলাকায় আবাসিক হোটেলে দেহব্যবসা, মদ বিক্রি ও জুয়া খেলা চলে। পুলিশ এই সমাজে বেশ্যার গতরবেচা টাকায়ও ভাগ বসায়। যে কারনে এসব অসামাজিক কাজ বন্ধ করতে পারেনি পুলিশ। পুলিশ ইচ্ছা করলে জুয়া, মাদক ও পতিতাবৃত্তি যে কোন সময় বন্ধ করতে পারে। কিন্তু বন্ধ করলে পুলিশের রোজগারে ভাটা পড়বে। যে কারনে সমাজে অপারাধের মাত্রা যেন দিন দিন শুধু বাড়ছে। শিশু ও নারী নির্যাতনের মামলায় আদালত থেকে গ্রেফতারী পরোয়ানা থানায় পৌছালেও একমাসেও আনোয়ারা থানা পুলিশ আসামীদের গ্রেফতারে কোন ভুমিকা রাখছেনা।

নিরহ মানুষকে রাস্তা থেকে ধরে এনে ইয়াবা ও ফেন্সিডিল পাওয়া গেছে বলে হুমকি দিয়ে মহাসমারোহে টাকা আদায়ের ঘটনা দিন দিন বাড়ছে। দৈনন্দিন জনজীবনে রাষ্ট্রের পক্ষে সব থেকে প্রত্যক্ষ শাসন পরিচলানাকারী প্রতিষ্টান হচ্ছে পুলিশ। সেই পুলিশ বিভাগের ভাবমুর্তি সাম্প্রতিক সময়ে গুরুতরভাবে কলুষিত হয়ে যাচ্ছে। কোন কার্যকর প্রতিকার মিলছে না। এমনকি পুলিশের উদ্ধতন কর্মকর্তারা যে যথেষ্ট বিচলিত তাও মনে হচ্ছে না। পুলিশের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রচুর অভিযোগ থাকলেও জনমনে আস্থা সৃষ্টি করে এমন প্রতিকার বা ন্যায় বিচারের কোন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তেমন দৃষ্টান্ত বিরল। গনমাধ্যমে কোন ঘটনা নিয়ে হৈ চৈ পড়লে অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যকে বড়জোর প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। না হয়, সাময়িক বরখাস্ত। কয়দিন পর সে বরখাস্ত প্রত্যাহার হয়ে প্রমোশনও হয়। এটা একটা কলুষিত রেওয়াজ। পুলিশ তার বাহিনীর সদস্যদের কতজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে, সেই পরিসংখ্যান তাদের সরকারী ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা উচিত। গনমাধ্যমে লেখালেখি যতদিন হয়, পুলিশও তার স্বভাব চরিত্র অনুযায়ী ব্যবস্থা নিচ্ছে। শাস্তি হচ্ছে, বিভাগীয় শাস্তি পাবে এমন অনেক আশ্বাস মানুষ শুনতে পায়।

কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য যে, সমাজে পুলিশের নির্যাতনের প্রতিবাদে কেউ এগিয়ে আসেনা নানা হয়রানীর ভয়ে। এদিকে এ ব্যাপারে দেশের মাঠপর্যায়ের কর্মরত সদস্যদের সতর্ক করেছে পুলিশ সদর দপ্তর। সাম্প্রতিক সময়ের ঘটনাগুলো পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিব্রত করেছে বলে দাবী করা হলেও অবস্থাদৃষ্টে তা মনে হয় না। একজন পাবলিক যদি কোন পাবলিককে রাস্তায় মারধর করে হাতপা ভেঙ্গে দেয়। তাহলে তার বিরুদ্ধে অর্থাৎ নির্যাতনকারীর বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেফতার হতে পারে তবে পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা ও অভিযুক্ত ব্যক্তি সে পুলিশ হলে কি গ্রেফতার হবে না? পুলিশের জন্য কি দেশে আলাদা কোন আইন আছে। তাহলে সে অভিযুক্ত পুলিশ গ্রেফতার না হওয়ার কারন আমাদের বোধগম্য হচ্ছে না। এভাবে যদি রাস্তায় মানুষকে অমানুষের মত মারধর করে চাঁদার জন্য হাসপাতালে পাঠায় তাহলে সে পুলিশ সদস্যকে পুলিশ বিভাগে রেখে সরকারের ভাবমুর্তি ক্ষুন্ন করার মানে কি? চট্টগ্রাম শহরে এভাবে পুলিশের টোকেন বানিজ্য, ঘুষ বানিজ্য সহ নানা আকাম কুকামের জন্য প্রত্যেক থানায় রয়েছে ক্যাশিয়ার। এই ক্যাশিয়ারার নগরীতে চষে বেড়াচ্ছে মাসিক ও সাপ্তাহিক চাঁদাবাজিতে।

এই ক্যাশিয়াররা প্রায় প্রতিদিন মাছ, তরকারি বাজার করে পৌছে দেন উদ্ধতন পুলিশ কর্মকর্তাদের বাসায়। এভাবে ওপেন সিক্রেট বানিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। ফুটপাতের দোকানীদেরও রাস্তার পাশে কাঁচাবাজারের থেকে প্রতিদিন চাঁদা আদায় করে পুলিশ। পুলিশ তার নিজের স্বার্থে বছরশুরুর দুটি মানবাদিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় যে, তদন্ত কমিটি করেছে, তার দ্রুত ফল প্রকাশ করবে। আমরা মনে করি, জনস্বার্থে পুলিশের কার্যকর শাসন তার লাঠিতে নয়। মানুষের মর্যাদার ওপরই টিকে থাকে। পুলিশ জনগনের বন্ধু বললেও এখন পুলিশ কি আতংকের নাম হচ্ছে। পুলিশের ভাবমুর্তি উদ্ধারে পুলিশকেই কাজ করতে হবে।

পুলিশের প্রতি জনগনের আস্থা ও বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগ নিতে হবে। মানুষের অপদ বিপদে পুলিশই পাশে থাকে। যে কোন দুর্ঘটনায় পুলিশই প্রথম ছুটে যায়। কাজেই পুলিম জনগনের অতন্ত্র প্রহরী হয়ে থাকতে হবে। সেদিন বাসায় ফিরছিলাম। রাত তখন বারোটা। রাস্তায় অনেক লোকের জটলা দেখে জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে। লোকজন জানালেন, চায়ের দোকানের সওদাগরের পুত্রকে টহল পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। কিছুদুর গিয়ে দেখা গেল, টহল পুলিশের পিকআপ ভ্যানের পেছনে সওদাগর পুত্র বসে আছে। সামনের সারিতে ড্রাইভারের পাশে দারোগা নাক দেড়ে ঘুমাচ্ছে গাড়িতে বসে। কাশি দিতেই জেগে উঠলেন, কেন এই লোককে নিয়ে এসেছেন বলতেই জানান, ’হেথে দোয়ান খুইল্যা রাখছে এত রাইতে’ কি করমু লই আইলাম।

এখন আপনে সওদাগর আইছেন যা দেওয়ার দেন, লই যান গই। শীতের রাইতে হেথেরে গরম কাপড় কত্তুন দিমু।’ বুঝিয়ে বলার পর দাগোরা সাহেব সওদাগরপুত্রকে টাকা ছাড়াই ছেড়ে দিলেন। পুলিশের মধ্যে ভাল খারাপ আছে। তবে খারাপের লাগাম টেনে ধরতে হবে এখনই।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.