চট্টগ্রামে সাংসদ লতিফ : অত:পর অরিন্দম কহিলা বিষাদে

0

জুবায়ের সিদ্দিকী – 

সরকার স্থিতিশীল হলে অস্থির হয়ে উঠে আওয়ামী লীগের কিছু সংখ্যক এমপি ও প্রভাবশালী নেতা। তারা যার যার এলাকায় নিজেদের স্বঘোষিত গডফাদারে পরিনত করেন। ক্ষমতার দাপটে অন্ধ হয়ে গড়ে তুলেন বিভিন্ন বাহিনী, সন্ত্রাসী গোষ্টী, চাটুকার ও চামচা বাহিনী। নিয়ন্ত্রন করেন টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, বালু মহাল, খেয়াঘাট, হাটবাজার ইজারা, মাদক ব্যবসা সহ বিভিন্ন ব্যবসা বানিজ্য এবং স্থানীয় পর্যায়ে বিভিন্ন দপ্তরে নিজস্ব লোকজনকে চাকরী দেওয়া ও নিয়োগ বানিজ্য সহ অনেক কিছুই। এদিকে চট্টগ্রাম মহানগরে নিজের ছবির উপর বঙ্গবন্ধুর মুখমন্ডলের ছবি ছাপিয়ে ব্যানার টাঙ্গিয়েছেন সরকার দলীয় এমপি এম এ লতিফ। এ অভিযোগ করেছেন, খোদ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। এই বিকৃত ফেস্টুন নিয়ে রাজনৈতিক উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছে। সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী বলেছেন, আমি ফেস্টুনে লাগানো ছবিগুলো দেখেছি। বঙ্গবন্ধুকে কাছ থেকে দেখেছি। তাতে ফেস্টুনের ওই ছবির মাথার অংশ বঙ্গবন্ধুরই।

কিন্তু মাথা থেকে পা পর্যন্ত শারিরীক কাঠামো সাংসদ লতিফের। এ জন্য আমি তার কাছে উকিল নোটিশ পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তিনি বলেন, জাতির জনকের শারিরীক কাঠামো পরিবর্তন করে তিনি (সাংসদ) ফেস্টুন টাঙ্গিয়েছেন। এটি আইনত দন্ডনীয় অপরাধ। জাতির পিতাকে নিয়ে লতিফ ঠাট্টা মশকরা করছেন। আইনজ্ঞরা বলছেন, যেহেতু বঙ্গবন্ধু সংবিধানের একটি অংশ, তাই তার বক্তৃতা, বিবৃতি বা ছবি বিকৃত করা রাষ্ট্রদ্রোহের সামিল। চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের জ্যাষ্ট সহ-সভাপতি খোরশেদ আলম বলেন, আমরা বঙ্গবন্ধুর জীবনধারা, চালচলন, পোশাক-আশাক চিনি। কিন্তু ফটোশপের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর ছবি যারা বিকৃত করে প্রচারনা চালিয়েছেন, তাদের ক্ষমা নেই। সবকিছুতে সমঝোতা হবে, কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ব্যাপারে কোন সমঝোতা নেই। বিভিন্ন সময়ে আলোচিত সমালোচিত এই সাংসদ অনেক ঘটনার জন্ম দিয়েছেন চট্টগ্রামে। বর্তমানে এই বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলছে তোলপাড়।

এসব এমপিদের এহেন ন্যাক্কারজনক কর্মকান্ডে এক চরম বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে দল ও সরকার। এদের নিয়ে উৎকন্ঠায় আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। বিগত মহাজোট সরকারের সময় সরকারদলীয় কয়েকজন এমপি এবং দলীয় নেতারা নিজেদের গডফাদারে পরিনত করে সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দেন। তাদের কর্মকান্ডের কারনে সরকারকে নানমুখী সমালোচনার মুখেও পড়তে হয়। বিগত সময়ের মত এবারও কয়েকজন এমপি এবং দলীয় নেতা নিজেদের কর্মকান্ডের মাধ্যমে সডফাদারের ভুমিকায় অবর্তীর্ন ও বিতর্কিত কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ায় সরকার পড়ে বেকায়দায়। একজন এমপির বিরুদ্ধে মানবপাচার, ইয়াবা ব্যবসা সহ অনেক অপকর্মের অভিযোগ রয়েছে। এভাবে অনেক এমপির বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই। যাদের কারনে ও কর্মকান্ডে সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ড ম্লান হয়ে যাচ্ছে। সরকার বিরোধীরা বারবার সমালোচনায় বিদ্ধ করছে সরকারকে। তবে সরকারের শীর্ষ মহল দলীয় এসব এমপি ও নেতাদের বিরুদ্ধে একেবারেই জিরো ট্রলায়েন্স নীতি গ্রহন করেছে। স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে আইনের শাসনের প্রতি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে সরকারের নীতি নির্ধারক মহল।

সরকারের একাধিক সুত্র জানিয়েছে, এই মেয়াদে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার আগের চেয়ে অনেক বেশি কঠোর। দলের নাম ভাঙ্গিয়ে বা নিজের ক্ষমতা দেখিয়ে অপরাধ কর্মকান্ড পরিচালনা বা নিজস্ব বাহিনী গড়ে তোলা কিংবা কাউকেই নিজ এলাকায় একক নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্টায় কোন রকম সুযোগ দিতে চায় না সরকারের শীর্ষ মহল। সরকার চায় না কোন ব্যক্তি বিশেষের জন্য সরকারের ভাল কাজগুলো ম্লান হয়ে যাক। এ কারনেই কঠোর অবস্থান গ্রহন করেছেন সরকারের নীতি নির্ধারকরা। বিতর্কিত এমপিদের উল্টাপাল্টা কর্মকান্ড শুধু দল ও সরকারে নয়, তৃনমুলের দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে দেখা দিচ্ছে ক্ষোভ ও হতাশা। পর-পর ২ বার এমপি হয়ে যাওয়াতে অনেকে দলকে যেনতেনভাবে ব্যবহার করছেন। দলেল ভাবমুর্তি বিনষ্ট করা ছাড়াও দলীয় নেতাকর্মী ও সমর্থকগন এবং বিতর্কিত প্রভাবশালী নেতা ও সাংসদের কারনে অস্বস্থিতে রয়েছেন। এমনিতে বর্তমান সরকারের কর্মকান্ডে ও দলীয় সকল কার্যক্রমে ত্যাগী ও নিবেদিত নেতাকর্মীদের কোনভাবে মুল্যায়ন হচ্ছে না। বর্তমানে অধিকাংশ এমপি চামচা ও চাটুকার পরিবেষ্টিত হয়ে দাপটের সাথে ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন।

তাদের দাপটের কাছে অসহায় এখন ত্যাগী নেতারা। অনেক এমপি ডিগবাজি দিয়ে বা অর্থবিত্তের কারনে সংসদ সদস্যের টিকেট পেয়ে নির্বাচিত হলেও আগের বদঅভ্যাস ছাড়তে পারেননি। বিএনপি-জামায়াত থেকে দলবদল করে আসা হাইব্্রীড় এসব নেতাদের উদ্ভট কর্মকান্ডও সরকারকে বারবার ফেলছে বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখে। রাজনৈতিক অঙ্গন হচ্ছে উত্তপ্ত। গ্রুপিং কোন্দল চাঙ্গা হচ্ছে। দলের সাংগঠনিক ভিত্ত্বি নড়েবড়ে হচ্ছে। চট্টগ্রামে এভাবে উড়ে এসে জুড়ে বসা অনেক প্রভাবশালী নেতা ও সাংসদ আওয়ামী লীগের সকল কর্মকান্ডে থাকলেও এরা সত্যিকার রাজনীতিবিদ ও আওয়ামী লীগের একনিষ্ট নেতাকর্মী হতে পারেননি। বুর্জোয়াগোষ্টী বরাবরই দলীয় ভাবমুর্তিকে বিসর্জন দিয়েছেন নানাভাবে। নিজেরা বিতর্কিত হলেও এসব এমপি ও প্রভাবশালী নেতা এক এক করে ঘটাচ্ছেন অঘটন। এসব বুর্জোয়া গোষ্টী ও ডিগবাজি দিয়ে দলে প্রবেশ করলেও তারা দলকে মারাত্বকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। দলবদলের এসব রাজনীতিবিদকে নিয়ে উৎকন্ঠায় দল। বিশেষ করে জামাতীদের মহল আওয়ামী লীগের সাইনবোর্ড দিয়ে এমপি বানানোর খেসারত দিচ্ছে আওয়ামী লীগ। বর্তমান সময়ে আওয়ামী লীগের শহর থেকে গ্রাম সর্বত্র হাইব্্রীড় নেতা, পাতি নেতা, চামচা, চাটুকার ও তোষামোদকারীদের দৌরাত্ব্য যেন দিন দিন বাড়ছে। এরাই এখন বড় বড় নেতাদের ঘিরে রাখে। যার কারনে সাধারন নেতাকর্মীগন কাছে যেতে পারেন না। ক্ষমতার হালুয়ারুটি ভোগ করছে দলের চিহ্নিত কিছু সুবিধাবাদী।

এমপি হোক, মন্ত্রী হোক সকলে যেন এই তোষামোদকারীদের ভালবাসেন। এতে করে ক্ষোভ ও হতাশায় ত্যাগী নেতাকর্মীগন। অনেকে দু:খে ও বেদনায় দলীয় কর্মকান্ড থেকে সরে দাড়িয়েছেন। সরকার যখন দেশ গড়ার কাজে এগিয়ে যাচ্ছে, উন্নয়নের ধারায় সরকার সরকার সফল হচ্ছে। তখন মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে ঘাটটি মেরে থাকা সুবিধাভোগী গোষ্টী বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চালাচ্ছে তেলেসমাতি। এদের চিহ্নিত করা উচিত। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিকৃতরুচির মানুষের ফটোশেসনকারী সে এমপি না মন্ত্রী হোক তাকে অবশ্যই আইনের আওতায় এনে শাস্তি ও দল থেকে বহিস্কার করা উচিত। এদের এত সাহস এল কোথায় হতে। জাতির জনকের ছবিকে বিকৃতকারীকে কোনভাবেই ক্ষমা করা যাবে না। সরকার ও দলকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে এসব এমপি ও নেতাদের এখনই লাগাম টেনে ধরতে হবে। হাইব্রীড়দের আগাছা উপড়ে ফেলতে হবে। এখনই এদের বিরুদ্ধে দলীয় ব্যবস্থা না নিতে পারলে দলকে হয়তো চরম মুল্য দিতে হতে পারে। দলের বিভক্তি, কোন্দল ও দালালীও চাঙ্গা হতে পারে। বিকৃত মানসিকতার নেতাদের এখন সময় পরিত্যাগ করার। যাদের থেকে দল, বঙ্গবন্ধুর ছবি, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিরাপদ নয়, তাদের দলীয় পরিচয়ে লেবাসে রাখার প্রয়োজন কেন।

চট্টগ্রাম আদালতে এমপি লতিফের বিরুদ্ধে দুটি মানহানির মামলা হয়েছে। নগরীতে বিক্ষোভ মিছিল, সমাবেশ, মানববন্ধন এবং নিন্দা অব্যাহত আছে। সাধারন জনগন বলছে, এমপি লতিফের কান্ডজ্ঞানহীন কাজ সবাইকে আহত করেছে।

আজ এসব কান্ডকারখানা দেখে আমার বলে হচ্ছে, বঙ্গবন্ধু তুমি আজ নেই, কোথায় যাব, কি বলবো, কাকে বলতে যাব? ১৯৯৭৫ এর সেই সময়ের কঠিন দিনগুলো আজও যেন মানসপটে ভেসে উঠেছে, স্মৃতিগুলো আমাদের তাড়া করে। কতদিন, কত নির্ঘুমরাত, কত কষ্ট, কত নির্যাতন। তারপরও তোমার হত্যার বিচার চেয়ে মিটিং, মিছিল, লিফলেট, বিতরন ও অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলাম। নগরীতে মুহুমুহু বোমার প্রকম্পিত করেছিলাম এবং নগরাবাসীকে জানান দিয়েছিলাম, আমরা বঙ্গবন্ধুর সৈনিকরা আছি। আজ চারিদিকে তোমার পতাকা উড়ছে বাংলার জমিনে, আবার তোমাকে নিয়ে হাইব্রীডদের আস্ফালন, তাদের অতি উৎসাহ ও ক্ষমতার অপব্যবহারে তোমার পায়ের কালো চামড়ার সেই সেন্ডেল এখন নেই। তোমার পায়ে রঙ্গিন কাপড়ের হালফ্যাশনের জুতো।

তোমার ঢিলাঢালা পায়জামা নেই, আছে কাবুলির পোশাক। তোমার পাঞ্জাবীর হাতটা কত আধুনিক। তোমার হাতে উঠেছে মোবাইল। তোমার বুকটা কত উচু হয়ে গেছে। তোমাকে তোমার দলের কিছু নষ্ট মানুষ আজ যখন বিকৃত রুচির দৃষ্টতা দেখাচ্ছে তখন জাতি হতাশ ও বেদনাহত হচ্ছে। নব্য আওয়ামী লীগার, হাইব্রীড়, পাকিস্তানপন্থীদের আনাগোনা ও তাদের দাপট যেন সীমা অতিক্রম করেছে। এদের আস্ফালন, ঔদ্ধত্য আচরন জাতিকে বারবার বেদনাহত করছে। তোমার নির্দেশে যে মুক্তিযোদ্ধা জীবনবাজি রেখে রনাঙ্গনে যুদ্ধ করেছে স্বাধীনতার জন্য, তোমার জন্য, তাদের মনের গহীনে এখন আগুন জ্বলছে। বঙ্গবন্ধু আমাদের ক্ষমা কর। আমরা অকৃতজ্ঞ এক জাতি।
চট্টগ্রামে পর পর ২ দিন ব্যবসায়ীদের সংগঠন চেম্বারে সাংবাদিক সম্মেলন করে তিনি একদিন প্রত্যাখ্যান ও ষড়যন্ত্র এবং পরের দিন ডিজাইনারের উপর দোষ চাপানোর চেষ্টা করেছেন। তাই দুইদিনের বক্তব্যে গড়মিল ও দায় এড়ানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন। একজন প্রবীন আইনজীবি বলেছেন, তিনি এই ঘটনাকে কোনভাবে এড়িয়ে যেতে পারেন না। নিজের লোকজনের খামখেয়ালী ও উদাসীনতা এবং দায়িত্বজ্ঞানহীনতার জন্য তাকে জাতির কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। সাংবাদিক সম্মেলনে ২ দিনের বক্তব্যে এটা স্পষ্ট যে তিনি অকপটে স্বীকার করেছেন এটা তার মাধ্যমেই ঘটেছে। অরিন্দম কহিলা বিষাদে-বললেন আওয়ামী লীগের মহানগরের এক শীর্ষ নেতা।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.