চসিকের করারোপ নিয়ে মহিউদ্দিন-নাছিরের বাকযুদ্ধ

জুবায়ের সিদ্দিকী – 

এবার শব্দযুদ্ধে জড়িয়ে পড়লেন ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী দুই নেতা। তবে এতদিন অনেকটা ব্যক্তিগত ইমেজ রক্ষায় পরস্পরের সঙ্গে এ শব্দযুদ্ধে লিপ্ত থাকলেও এবার কিন্তু ইস্যু হলো নাগরিক স্বার্থ। নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী এবং সাধারন সম্পাদক আ.জ.ম নাছির উদ্দিনই এ শব্দযুদ্ধে লিপ্ত হয়েছেন গত প্রায় একমাস ধরে। এর আগে গত বছর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে দলীয় সমর্থন আদায় এবং প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের কতৃত্ব রক্ষা নিয়ে পরস্পর শব্দযুদ্ধ করেছিলেন দুইজন। তবে সর্বশেষ গত মার্চ মাস থেকে পৌরকর নিয়ে পরস্পরের সঙ্গে নতুন শব্দযুদ্ধে নামলেন তারা। আর নাগরিক স্বার্থ যুক্ত থাকায় এই ইস্যুটিতে কৌতুহল রয়েছে নাগরিকদেরও। এ শব্দযুদ্ধেও কারন অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ২০ মার্চ থেকে নগরীর ১১টি ওয়ার্ডে পঞ্চবার্ষিকী কর পুন: মুল্যায়ন কার্যক্রম শুরু করে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন। তবে পাঁচ বছর আগে বর্গফুটের মুল্যায়নভিত্ত্বিক জেনারেল এসেসম্যান্টের মাধ্যমে করের যে আওতা বাড়িয়েছিলেন তৎকালীন মেয়র এবার তা মানা হচ্ছে না। এর পরিবর্তে এবার ভাড়াভিত্বিক এসেসমেন্ট করা হচ্ছে।

এতে স্বাভাবিকভাবেই ভবন বা স্থাপনার মালিকদের কর বৃদ্ধি পাবে। এ ছাড়া ইতিপুর্বে মেয়র নগরীর ১৬টি নন কনজার্ভেন্সি ওয়ার্ডকে কনজার্ভেন্সি ওয়ার্ডে পরিণত করার ঘোষনা দিয়েছিলেন। ফলে কর: মুল্যায়ন গৃহকরের ক্ষেত্রে এসব ওয়ার্ডে বিদ্যমান করের সাথে অতিরিক্ত ৩ শতাংশ কর পরিশোধ করতে হবে নগরবাসীকে। তবে পুরানো পদ্ধতিতে কর মুল্যায়ন না করলেও বর্তমান পদ্ধতিকেই আইনগতভাবে স্বীকৃত বলে দাবী করে আসছেন তা আ.জ.ম নাছির উদ্দিন।

গত ২১ মার্চ কর মুল্যায়নের উদ্বোধনি অনুষ্টানে তিনি বলেছিলেন, ’এখন থেকে প্রচলিত আইন কানুন এবং বিধি বিধান মেনেই নগরবাসী থেকে কর আদায় করা হবে। অতীতে বিধিবহির্ভুতভাবে কর নির্ধারন করায় নাগরকিদেও সাথে নানা ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে এবং কর আদায়ের ক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রাও পুরন হয়নি। এদিকে কর পুন:মুল্যায়ন কার্যক্রম শুরু হওয়ার দ্বিতীয় দিনে নগরীর বহদ্দারহাটে আয়োজিত একটি সমাবেশ থেকে সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী নগরীর জনসাধারনের সুবিধা বৃদ্ধি না কওে কর বাড়ানোর জন্য সিটি মেয়র আ.জ.ম নাছির উদ্দিনের প্রতি আহবান জানান। সেদিন তিনি বলেছিলেন, ’ট্যাক্স (কর) বাড়াবেন না। আমি ১৭ বছর মেয়র ছিলাম। এক পয়সাও ট্যাক্স বাড়াইনি। ট্যাক্স না বাড়িয়েও উন্নয়ন করা যায়। আমি ট্যাক্স না বাড়িয়েই চট্টগ্রামের স্বাস্থ্য শিক্ষা সহ সামগ্রিক উন্নয়ন করেছিলাম। মুলত ওই দিনের পর থেকে প্রায় বিভিন্ন সমাবেশে পৌরকর বৃদ্ধি না করতে আহবান জানিয়ে আসছেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। গত ৫ এপ্রিল চশমা হিলে এক সভায় মহিউদ্দিন চৌধুরী আবারো বলেন,’ সিটি কর্পোরেশন একটি সেবাধর্মী প্রতিষ্টান। এ প্রতিষ্টান থেকে নগরবাসী সেবা ও উন্নয়ন আশা করে। পৌরকর বৃদ্ধি হোক তা কখনো আশা করে না।

পৌরকর বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত পরিহার করে নগরবাসীর সুযোগ সুবিধা আগে বৃদ্ধি করুন। এর বাইরেও বিভিন্ন সময়ে পৌরকর বাড়ানো হচ্ছে দাবী করে চসিক মেয়রকে উদ্দেশ্য করে বিভিন্ন মন্তব্য করেন বর্ষিয়ান এ আওয়ামী লীগ নেতা। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র ও নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী বলেন,’ আমি জনগনের কথা বলেছি। জনগন যখন অতিরিক্ত করের বোঝায় সাফার করে আমি তখনই বলি। করের বোঝা বাড়তে থাকলে তো নগরবাসীকে একদিন ঘর ছেড়ে চলে যেতে হবে। তাই জনস্বার্থে করের বোঝা বাড়ানো উচিত নয়। নাগরিক সুবিধা বৃদ্ধি না করে পৌরকর বাড়ানো উচিত হবে না। আমি সেটাই বলেছি। কিন্তু বর্তমান মেয়র তো দাবী করছেন আইন মেনেই কর ধার্য্য করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে অতিরিক্ত কর আদায়ের কোন সুযোগ নেই বলে দাবী করেছেন তিনি। এখন আপনি বলছেন করের বোঝা চাপানো হচ্ছে। সেটা কি ভাবে? এমন প্রশ্নের উত্তরে মহিউদ্দিন চৌধুরী বলেন, জনগনের উপর কর চাপিয়ে দিচ্ছে, আর সেটা জনগনই বলছে। যারা কর দিচ্ছে না তাদের সাথে আলাপ করলেই জানতে পারবেন।

আপনারা তো সাংবাদিক কিভাবে করের বোঝা চাপানো হচ্ছে এটা তো জানার কথা। আর এই কর কেন চাপাচ্ছেন, আর যিনি চাপিয়ে দিচ্ছেন, উনিই বলতে পারেন। সিটি কর্পোরেশনের শিক্ষা প্রতিষ্টানগুলোতে শিক্ষার্থীদের বেতন ফি বাড়ানো হয়েছে। এসব কেন? আমি নিজেও জনগনের উপর করের বোঝা না বাড়িয়ে ১৭ বছর সিটি কর্পোরেশন চালিয়েছি। তখন তো কোন সমস্যা ছিল না। সাবেক মেয়রের একের পর এক মন্তব্যের প্রেক্ষিতে পাল্টা মন্তব্য শুরু করেন বর্তমান মেয়র আ.জ.ম নাছির উদ্দিন। সর্বশেষ একটি ক্রীড়া প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরনী অনুষ্টানে তিনি মহিউদ্দিন চৌধুরীকে উদ্দেশ্য করে বলেন,’ সাবেক একজন মেয়র ও বিশিষ্টজনেরা পত্রপত্রিকায় মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্য উপাত্ত উপস্থাপন করে নাগরিকদের বিভ্রান্ত করার অপপ্রয়াসে লিপ্ত। এ প্রসঙ্গে চসিক মেয়র আ.জ.ম নাছির উদ্দিন বলেন,’ এখানে কোন ভুল বুঝাবুঝি নেই।

সরকারের গেজেট নোটিফিকেশন অনুযায়ী কর আদায় করা হচ্ছে। এখানে অতিরিক্ত কর ধার্য্য করার সুযোগ আমার নেই। বরং সর্বশেষ প্রকাশিত গেজেট অনুযায়ী আলোকায়নের বিপরীতে অতিরিক্ত কর আদায়ের সুযোগ থাকলেও সেটা কার্যকর করছি না। আসলে যারা এতদিন কর ফাঁকি দিত তারা এখন ফাঁকি দিতে পারছে না বলেই মনে করছে কর বাড়ানো হচ্ছে। আগে যে পদ্ধতিতে কর আদায় করা হতো সেখানে আদায়কারীর সাথে যোগসাজসে অনিয়ম করার সুযোগ ছিল। এখন সঠিক পদ্ধতিতে আইনগতভাবে কর আদায় করা হবে। তাই এখানে অনিয়ম করার সুযোগও থাকবে না। করের বোঝা চাপানো হচ্ছে মর্মে মহিউদ্দিন চৌধুরীর অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে আ,জ,ম নাছির উদ্দিন বলেন,’ স¤প্রতি পত্রিকায় আমার বক্তব্য এসেছে। উনি কি আমার বক্তব্য খন্ডন করতে পেরেছেন? আমি শিগ্রই মিট দ্যা প্রেস আয়োজন করব। সেখানে সমস্ত তথ্য উপাত্ত উপস্থাপন করব।

কোন আইনে কতটুকু কর আদায় করা হচ্ছে সেগুলো জনগনের সামনে তুলে ধরবো। এখানে জনগনকে বিভ্রান্ত করার কোন সুযোগ নেই। কর্পোরেশন এর রাজস্ব বিভাগ সুত্রে জানা যায়, ১১টি ওয়ার্ডে পঞ্চবার্ষিকী কর পুন: মুল্যায়ন কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ওয়ার্ডগুলো হচ্ছে, ১নং দক্ষিণ পাহাড়তলী, ৮নং শুলকবহর, ২১নং জামালখান, ২৪নং উত্তর আগ্রাবাদ, ৩১নং আলকরন, ৩২নং আন্দরকিল্লা, ৩৩নং ফিরিঙ্গিবাজার, ৩৫নং বক্সিরহাট, ৩৬নং গোসাইলডাঙ্গা, ৩৮নং দক্ষিণ মধ্যম হালিশহর এবং ৪১নং দক্ষিন পতেঙ্গ ওয়ার্ড। এর আগে ২০০৮-০৯ অর্থসালে এসব ওয়ার্ডে সর্বশেষ কর পুন: মুল্যায়ন করা হয়েছিল। চসিকের রাজস্ব বিভাগ সুত্রে জানা যায়,’সরকারী নীতিমালা অনুযায়ী হোল্ডিং মালিকদের তাদের বাসাভাড়া থেকে প্রাপ্ত আয়ের বিপরীতে ১৭ শতাংশ হারে হোল্ডিং ট্যাক্স দিতে হবে কর্পোরেশনকে। ১৭ শতাংশ করের মধ্যে হোল্ডিং বাবদ ৭ শতাংশ এবং সড়কবাতির বিপরীতে ৩ শতাংশ কর নির্ধারন করা আছে। চসিকের রাজস্ব বিভাগ সুত্রে জানা গেছে, দি সিটি কর্পোরেশন ট্যাক্সেশন রুলস ১৯৮৬ এর ২১ ধারা মতে, সিটি এলাকায় প্রতি পাঁচ বৎসর অন্তর সকল প্রকার স্থাপনার পরিমাপ ও সংশ্লিষ্ট তথ্য সরেজমিন সংগ্রহ করে কর নির্ধারন করা হয়। ইতিমধ্যে অনেক বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্টান, স্থাপনা নতুনভাবে নির্মান ও বিলুপ্ত হওয়ার ফলে অনেক স্থাপনা পরিবর্তন, পরিবর্ধন এবং উন্নয়ন হয়েছে।

ফলে সিটি কর্পোরেশন রুলস ১৯৮৬ এর ২১ ধারা মোতাবেক গৃহ ও ভুমির পঞ্চবার্ষিকী কর পুন: মুল্যায়নে তালিকা তৈরী করা হচ্ছে। কর পুন: মুল্যায়ন করার সময় কারো মালিকানধীন ভবনটি যদি সম্পুর্ন ভাড়া প্রদত্ত হয় তবে বাৎসরিক রক্ষানাবেক্ষনের ব্যয় বাবদ দুই মাসের ভাড়া বাদ দেয়া হবে। অবশিষ্ট ১০ মাসের ভাড়া হিসাব করেই কর নির্ধারন করা হবে। এ ছাড়া করো বসতঘর নির্মান বা ক্রয়ে সরকার, বাংলাদেশ হাউজ বিল্ডিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশন, তফশিলী ব্যাংক বা কোন আর্থিক প্রতিষ্টান থেকে ঋন নিয়ে থাকে তাহলে ঋনের বাৎসরিক সুদ মুল্যায়ন থেকে বাদ দেয়া হবে। বিভিন্ন এলাকার ভুমি মালিকদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে,’ মহিউদ্দিন চৌধুরীর সময়কালে আমরা হোল্ডিং ট্যাক্স পরিশোধ করেছি। কারন তখন হোল্ডিং ট্যাক্স নির্ধারন করা হত ভুমি মালিকদের সঙ্গে আলাপ ক্রমে। এতে নগরপিতার সঙ্গে নাগরিকদের সৌহাদ্যপুর্ন সম্পর্ক বজায় থাকতো।

সেলফ এ্যাসেসম্যান্টের মাধ্যমে শতস্ফুর্তভাবে মানুষ কর দিত। পরবর্তীতে মেয়র মনজুর আলমের সময়ে কয়েকগুন বেশি ভুমি মুল্যায়ন কর নির্ধারন করা হয়। চার-পাঁচ তলা বিল্ডিং এর করের চেয়ে দেখা গেছে বস্তীবাড়ির কর দ্বিগুন। ওই সময় এ বিষয়ে ব্যাপক সমালোচিত হন তৎকালীন মেয়র। অভিযোগ উঠে এ্যাসেসমেন্টের দায়িত্বপ্রাপ্তদের অনেকে, নগরীর ভুমি মালিকদের অনেকের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা নিয়ে এ্যাসেসম্যান্ট কমিয়ে দেয়া, টাকা না দিলে বিপুল অংকের কর মুল্যায়নের মত ন্যাক্কারজনক অপকর্ম করে হয়েছেন কোটিপথি। ওই সময় চসিকের তৎকানীন সাইনবোর্ড পরিদর্শক আবুল মনছুর সহ অনেকের বিরুদ্ধে বানিজ্যের অভিযোগ উঠেছিল। এর পর থেকে বিক্ষুব্ধ নাগরিকদের অনেকেই হোল্ডিং ট্যাক্স পরিশোধ করছেন না। তাদের দাবী, যৌক্তিকভাবে ভুমি মালিকদের সাথে আলাপ আলোচনার ভিত্ত্বিতে কর পুন: মুল্যায়ন করতে হবে। তার আগে মেয়র মনজুর আমলের বিতর্কিত কর মুল্যায়ন সম্পুর্ন বাতিল করতে হবে। তবেই চসিকের সঙ্গে নাগরিকদের সম্পর্ক সুদৃঢ় ও কর আদায় বৃদ্ধি পাবে। এদিকে করারোপ নিয়ে মহিউদ্দিন চৌধুরীর অভিমতের পক্ষে নগরবাসীদের অনেকে অবস্থান নিয়েছেন।

এ বিভাগের আরও খবর

Comments are closed.