চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে রোহিঙ্গা পাচার সিন্ডিকেট

জুবায়ের সিদ্দিকী – 

নিজেদের মধ্যে সিন্ডিকেট তৈরী করে ওমরা ভিসার নামে সৌদি আরবে রোহিঙ্গা পাচারের অভিযোগ উঠায় পুলিশের ইমিগ্রেশন শাখার কিছু সদস্যের অনিয়ম দুর্নীতি তদন্ত করছে সদর দপ্তর।সম্প্রতি একটি গোয়েন্দা সংস্থার পাঠানো প্রতিবেদনের ভিত্ত্বিতে সরাসরি এ অভিযোগ তদন্ত করছে পুলিশ সদর দপ্তর। তদন্তের আওতায় স¤প্রতি সিএমপি থেকে থাকায় বদলী হওয়া শীর্ষ এক কর্মকর্তাও রয়েছেন। গোয়েন্দা সুত্রটি জানায়, প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও আর্থিক সুবিধা নিয়ে ইমিগ্রেশন শাখায় বেশি জনবল নিয়োগ দিয়েছেন সিএমপির ওই শীর্ষ কর্মকতা। গত ৭-৮ বছরে এ শাখায় ঘুরে ফিরে নিয়োগ পেয়েছেন ২০০৫ ব্যাচের কিছু পুলিশ সদস্য। যাদের বেশিরভাগের গ্রামের বাড়ি কক্সবাজার জেলায়। 

সুত্রটি বলছে, জোট সরকার আমলে নিয়োগ পাওয়া এসব পুলিশ সদস্যরা ঘুরেফিরে ইমিগ্রেশন শাখায় কাজ করতে বেশি আগ্রহী। একবার বদলী হলে ফের তদবির করে ফিরে আসেন ইমিগ্রেশন শাখায়। উর্দ্ধতন কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে বাগিয়ে নেন বদলির আদেশ। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা, ইমিগ্রেশন শাখায় বদলী হয়ে কিছু পুলিশ সদস্য দায়িত্ব পালনের নামে যুক্ত হয়ে পড়েন রোহিঙ্গা পাচারসহ নানা অনিয়মে। গোপনে গড়ে তোলেন সিন্ডিকেট।

নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (ইমিগ্রেশন) আরেফিন জুয়েল বলেন,’ হ্যাঁ এটা সত্য। কিছু পুলিশ সদস্য ইমিগ্রেশন থেকে একবার বদলি হলে উর্দ্ধতন মহলে নানা তদবির করে ফের পুরনো জায়গায় ফিরে আসেন। ইতিপুর্বে কিছু পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে ওমরার নামে সৌদি আরবে রোহিঙ্গা পাচারের অভিযোগ উঠেছে। বিষয়টির তদন্তও চলছে।

জানা গেছে, একজন পুলিশ সদস্য ইমিগ্রেশন শাখায় ছয় মাসের অধিক দায়িত্ব পালনের নিয়ম নেই। সিএমপির সাবেক কমিশনার (পদোন্নতি পেয়ে বর্তমানে র‌্যাবে কর্মরত) আবদুল জলিল মন্ডল চলতি বছর ২০ জানুয়ারী এ সংক্রান্ত আদেশ জারি করেছিলেন। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে এ নিয়ম মানা হচ্ছে না। একবার বদলি হলে কয়েকমাস পর ঘুরেফিরে সেখানেই পোস্টিং নিতে গোপনে চলে টাকার খেলা। প্রশ্ন উঠেছে, ২০০৬ সাল থেকে এ যাবত ঘুরে ফিরে ২০০৫ সাল ব্যাচের পুলিশ সদস্যরা ইমিগ্রেশন শাখায় কর্মরত থাকছেন কিংবা থেকেছেন। এ সময়ে অন্তত এক লাখ রোহিঙ্গা ওমরা ভিসায় সৌদি আরব গিয়ে আর ফিরেনি। এসব রোহিঙ্গা সেখানে গিয়ে বাংলাদেশি পরিচয়ে বসবাস করছে।

নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ায় ক্ষুন্ন হচ্ছে বাংলাদেশিদের সুনাম। বর্তমানে ওমরা ভিসা বন্ধ থাকলেও গত ৮-১০ বছর বিমানবন্দর দিয়ে কেন রোহিঙ্গা পাচার বন্ধ করা যায়নি। পুলিশ সদর দপ্তরের একটি কমিটি এসব বিষয় তদন্ত করে দেখছে বলে জানিয়েছে গোয়েন্দা সুত্র। পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত আইজি পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বলেন, ’সিএমপির সাবেক এক কর্মকর্তা সহ ইমিগ্রেশন শাখার কিছু পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে ওমরার নামে সৌদি আরবে রোহিঙ্গা পাচারকাজে সহায়তার অভিযোগ উঠেছে। গোয়েন্দা পতিবেদনের ভিত্ত্বিতে বিষয়টি এখনও তদন্তাধীন। জানতে চাইলে সিএমপি পুলিশ কমিশনার ইকবাল বাহার বলেন,’ইমিগ্রেশন পুলিশের সহায়তায় রোহিঙ্গা পাচারের কোন বিষয় পুলি সদর দপ্তর সরাসরি তদন্ত করছে কি করছে না তা আমার জানা নেই। ইমিগ্রেশন শাখায় কর্মরত কোন পুলিশ সদস্য রোহিঙ্গা পাচারে যুক্ত থাকার তথ্য প্রমান পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

২০০৫ সাল ব্যাচের যেসব পুলিশ সদস্য ইমিগ্রেশন বিভাগে দায়িত্ব পালন করছেন তারা হলেন, পরিদর্শক আবদুল্লাহ আল হারুন, মো: ওসমান, নেজাম উদ্দিন। ইতিপুর্বে দায়িত্ব পালন করেছেন উপ পরিদর্শক মোজাহেদ, রাশেদ, জমির, সহকারী উপ পরিদর্শক নাসিব, বখতেয়ার ও আরিফ। গোয়েন্দা সুত্র জানায়, পরিদর্শক আবদুল্লাহ আল হারুনের বিরুদ্ধে রয়েছে একাধিক অভিযোগ। ২০০৫ ব্যাচের এ পুলিশ সদস্য প্রথম ইমিগ্রেশন বিভাগে যোগ দেন ২০০৬ সালে। উপ পরিদর্শক থাকা কালে ২০১৫ সাল পর্যন্ত একাধিকবার ইমিগ্রেশন শাখায় কর্মরত থাকেন। চলতি বছর উপ পরিদর্শক থেকে পরিদর্শক পদে পদোন্নতি পান। পদোন্নতি পেয়ে ফের ইমিগ্রেশন শাখায় বদলির আদেশ বাগিয়ে নেন তিনি।

অভিযোগ আছে, চলতি বছর এপ্রিলে সিএমপির ওই শীর্ষ কর্মকর্তা পদোন্নতি পেয়ে ঢাকায় বদলি হন। চট্টগ্রাম ত্যাগকালে হারুনের বদলির আদেশে স্বাক্ষর করলেও আদেশের তারিখ দেখানো হয় ২০ দিন আগের। এর আগে ইমিগ্রেশন শাখায় ২০০৬ সাল থেকে উপ পরিদর্শক হিসেবে তিনবার দায়িত্ব পালন করেন হারুন। সুত্রটি বলছে, বর্তমানে ওমরা ভিসা বন্ধ থাকলেও বিগত ১০-১১ বছর ধরে ইমিগ্রেশন শাখার শাসন করছে ২০০৫ ব্যাচের কিছু অসাধু পুলিশ সদস্য। যাদের অধিকাংশই কক্সবাজার জেলার বাসিন্দা। সেখানকার একটি সিন্ডিকেট ওমরা ভিসার নামে সৌদি আরবে রোহিঙ্গা পাচার করছে। সুত্রটি জানায়, পদোন্নতি পেয়ে কিংবা বদলিসুত্রে অসাধু পুলিশ সদস্য ইমিগ্রেশন শাখা ছাড়লেও রোহিঙ্গা পাচারের বিষয়টি দেখভালের দায়িত্ব দিয়ে আসেন আরেকজনকে। গোয়েন্দা প্রতিবেদনে যাদের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা পাচারকাজে সহায়তার অভিযোগ উঠেছে তারা হলেন পরিদর্শক আবদুল্লাহ আল হারুনের মামাতো ভাই এসআই মোজাহিদ, এসআই রাশেদ, জমির ও মোজাহিদ। অবশ্য তারা এখন ইমিগ্রেশন শাখায় নেই।

চোরাচালানীদের সহযোগিতা এবং রোহিঙ্গা পাচারকাজে যুক্ত থাকার অভিযোগ উঠায় ইমিগ্রেশন পুলিশের (বর্তমানে নেই) সহকারী উপ-পরিদর্শক বখতেয়ারের বিরুদ্ধে ২০১৫ সালের ৪ জানুয়ারী একটি সাধারন ডায়রী করেছিলেন ইমিগ্রেশন বিভাগের তৎকালীন পরিদর্শক প্রদীপ কুমার দাশ। জানা গেছে, এক বছর আগে বিমানবন্দরে জেলা কর্মকর্তা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিসে নিয়োগ পান আনার কলি নামের এক নারী কর্মকর্তা। তিনি পরিদর্শক হারুনের আপন বোন। অভিযোগ আছে, নারী কর্মকর্তা আনার কলিকে বিমানবন্দরে বদলি করিয়ে আনতে জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিসের কিছু কর্মকর্তাকে মোটা অংক দিয়ে ম্যানেজ করা হয়েছে।

রোহিঙ্গা পাচারের সাথে ইমিগ্রেশন পুলিশের অসাধু কর্মকর্তা ছাড়াও জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিসের কিছু কর্মকর্তাও জড়িত। জানাতে চাইলে,’ জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিসের উর্দ্ধতন কর্মকর্তা বলেন, এ অফিসের কোন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা পাচার সংক্রান্ত কোন অভিযোগ পাইনি। জানা গেছে, ইমিগ্রেশন শাখায় বর্তমানে কর্মরত আছেন ৫৯ জন। এর মধ্যে একজন অতিরিক্ত উপ পুলিশ কমিশনার, একজন সহকারী পুলিশ কমিশনার। মঞ্জুরিকৃত ৩ জনের বিপরীতে পরিদর্শক আছেন ৭ জন, ১৯ জনের বিপরীতে এসআই আছেন ২৫ জন, ৩ জনের বিপরীতে এএসআই আছেন ১২জন, দুই জনের বিপরীতে কনষ্টেবল আছেন ১৫জন।

আমাদের সৌদি আরব ব্যুরো প্রধান মোরশেদ রানা জানান,’ সৌদি আরবে নানা অপরাধে জড়িতদের অধিকাংশই রোহিঙ্গা নাগরিক। বাংলাদেশি পাসপোর্ট ব্যবহার করে সৌদিতে অবস্থান নেয়ায় বদনাম হচ্ছে দেশের। তিনি বলেন, প্রকৃত পক্ষে বাংলাদেশের নাগরিকরা শান্তশীষ্ট ও পরিশ্রমি হিসেবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশংসিত।

এ বিভাগের আরও খবর

Comments are closed.