চট্টগ্রামে “অচিনবাবা”তোলপাড়

 জুবায়ের সিদ্দিকী – 

চট্টগ্রাম শহরের দক্ষিণ পাহাড়তলীর উত্তর ফতেয়াবাদ ব্রাম্মনপাড়ার পশ্চিম পাশে প্রায় এক একর জায়গায় গড়ে উঠা কথিত ’অচিন বাবার মাজার’ নিয়ে রহস্য ক্রমশ ঘনীভুত হচ্ছে। বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী একজন ব্যক্তির কেন ’জানাযা’ পড়ানো হলো? জানাযার আগে একই মঞ্চে শহর থেকে জমায়েত হওয়া হিন্দু ভক্তরা কেন উলু ধ্বনি দিল এবং বৌদ্ধরাও বা কেন প্রার্থনা করল? মৃত লোকটি কি হিন্দু, মুসলিম না কি বৌদ্ধ ছিলেন? ’অচিন বাবার নামে’ কোটি টাকায় জায়গা কিনে রাতের আধারে অস্বাভাবিক গতিতে কি উদ্দেশ্যে নীল টিন দিয়ে স্থাপনা তৈরী করা হলো। অচিন বাবার কথিত মাজার গড়ে তুলে সংঘবদ্ধ একটি চক্র এলাকার নিরীহ মানুষের জমিজমা হাতিয়ে নিতে চক্রান্তে লিপ্ত নয় তো? এসব প্রশ্ন এখন এলাকাবাসীর মুখে মুখে।

প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে দিয়ে কথিত অচিন বাবা সম্পর্কে পাওয়া গেল চাঞ্চল্যকর তথ্য। জানা গেছে, অচিন বাবার প্রকৃত নাম বিশ্বজিৎ বড়ুয়া ওরফে বাবলু। তার ছোট ভাইয়ের নাম সত্যজিৎ বড়ুয়া ওরফে টিকলু। তাদের বাবার নাম মানিক বড়ুয়া। মায়ের নাম মঞ্জুশ্রী বড়ুয়া। মানিক বড়ুয়া ছিলেন একজন রিকশা ম্যাকানিক। মা মঞ্জুশ্রী বড়ুয়া নগরীর আগ্রাবাদে একটি বেসরকারী ঔষধ কোম্পানীতে চাকরি করতেন। নগরের মোগলটুলী এলাকার সন্তোষভুষন বড়ুয়ার বাড়িতে ভাড়ায় থাকতেন তারা। সেখানে ছিলেন ১৩-১৪ বছর। ১৯৯৬ সাল থেকে আশকার দীঘি এলাকায় শতদল ক্লাবের পাশে একটি বাড়িতে বসবাস শুরু করেন। এর আগে মোগলটুলি ভাড়া বাসায় থাকাকালে বেরা বড়ুয়া নামে এক মেয়ের সাথে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে বিশ্বজিতের।

প্রেমের সম্পর্কের সুত্র ধরে নব্বই দশকের শুরুতে রেবা বড়ুয়া ও বিশ্বজিৎ পরস্পর কোর্ট ম্যারেজ করেন। কিন্তু এ বিয়ে মেনে নিতে পারেনি রেবার পরিবার। রেবা বড়ুয়ার বড় বোনের নাম পারিকা বড়ুয়া। তার স্বামীর নাম কানু লাল বড়ুয়া। ২০০৬ সালে মারা যান তিনি। তারা থাকেন পাথরঘাটা আরসি চার্চ রোড় এলাকায়। পারিকা বড়ুয়া বিএনপি নেতা আবদুল্লাহ আল নোমানের অনুসারী। নগরের নিউমার্কেটের দোতলায় তার স্বামী কানু লাল বড়ুয়ার মালিকানাধীন কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্টান রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম লাকি টেইলার্স। পারিকা বড়ুয়ার ঘনিষ্ট সুত্র জানায়, ১৯৮০ সালে বিশ্বজিতের সাথে রেবা বড়ুয়ার পরিবারের অন্য সদস্যদের মতো মেনে নিতে পারেননি পারিকা বড়ুয়াও। বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত থাকলেও এরশাদ সরকার আমলে পারিকা এবং তার স্বামী ছিলেন প্রভাবশালী। বিশ্বজিতের সাথে (অচিন বাবা) কোর্টম্যারেজ করলেও পরে রেবা বড়ুয়াকে বিয়ে দেয়া হয় হাটহাজারি উপজেলার দক্ষিন মাদার্শা এলাকার বড়ুয়া পাড়ার এক যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসীকে। বিয়ের পর পর রেবা বড়ুয়া স্বামীর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দিলে ঢাকা চলে যান বিশ্বজিৎ বড়ুয়া। ১৯৮৩ সালে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম ফিরে আসেন তিনি।

মোগলটুলী এলাকার এক বাসিন্দা বলেন,’জিন্স প্যান্ট আর কালো গেঞ্জি পরে ভবঘুরের মত চলাফেরা করত বিশ্বজিৎ। চুল রাখত লম্বা। কেউ কিছু জানতে চাইলে দার্শনিকের মত জবাব দিত। জানা গেছে, যুক্তরাষ্টে যাওয়ার কয়েক বছর পর গ্রীনকার্ড পান রেবা বড়ুয়া। রোগে আক্রান্ত হয়ে যুক্তরাষ্ট্রেই যান রেবার স্বামী। ১৯৮৩ সালের দিকে দেশে ফিরে আসেন তিনি। ফিরে এসে পুনরায় সম্পর্ক স্থাপন করে বিশ্বজিতকে নিয়ে ফের যুক্তরাষ্ট্র পাড়ি দেন রেবা বড়ুয়া। কথিত অচিন বাবা সম্পর্কে জানতে নগরীর আরসি চার্চ রোড় এলাকায় রেবার বড়বোন পারিকা বড়ুয়ার সঙ্গে কথা বললে, তিনি বিশ্বজিৎ বড়ুয়াকে সাধক দাবী করেন। আরও বলেন,’তিনি খুব ভাল লোক ছিলেন। এক শ্রষ্টাতে বিশ্বাসী ছিলেন।সবসময় ধ্যানে মগ্ন থাকতেন। সবার উপকার করতেন।

কারো থেকে এক টাকাও নিতেন না। সাধক কখনো নিজেকে সাধক পরিচয় দেন না বলে মন্তব্য করে পারিকা বড়ুয়া বলেন.’ আদর্শ দেখে ভক্তরা তাকে সাধকের আসনে বসিয়েছেন। তিনি (বিশ্বজিৎ) জিয়াউল হক মাইজভান্ডারীর ভক্ত ছিলেন। কয়েক বছর ছিলেন তার সান্নিধ্যে। উত্তর ফতেয়াবাদ ব্রাম্মন পাড়ার পশ্চিম পাশে যেখানে তাকে সমাহিত করা সেই ৪৩ গন্ডা জমিটি ভক্তদের টাকায় কেনা। ভক্তরা অনেক বছর ধরে এ টাকা জমিয়েছেন।’ কথিত অচিন বাবাকে শাহানশাহ জিয়াউল হক মাইজভান্ডারী (ক:)এর ভক্ত দাবী করা হলেও তার ছেলে গাউছিয়া হক মঞ্জিলের সাজ্জাদানশীন সৈয়দ মোহাম্মদ হাসান মাইজভান্ডারী (ম.জি.আ) সম্প্রতি  একটি আঞ্চলিক দৈনিককে বলেছেন ’অচিন বাবার সাথে কোন পরিচয় কখনো ছিল না।

এমনকি নামও শুনিনি। অচিন বাবা হযরত জিয়াউল হক মাইজভান্ডারীর অনুসারী বলে পরিচয় দেয়া সম্পর্কে তিনি বলেন, কেউ নিজ থেকে এমন কাজ করলে তো বলার কিছু নেই। পারিকা বড়ুয়া জানান, অচিন বাবা যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেলেও মোবাইল ফোনে চট্টগ্রাম থেকে তার সঙ্গে যোগাযোগ করতেন ভক্তরা। শতদল ক্লাবের পাশের বাড়িতে আস্তানায় ভক্তরা আসা যাওয়া করতেন। ভক্তদের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে মোবাইল ফোনে কথা বলিয়ে দিতেন ছোট বাবা বলে পরিচিত সত্যতিৎ বড়ুয়া। জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার পর কিড়নি ও লিভারের জটিল রোড়ে আক্রান্ত হন বিশ্বজিৎ বড়ুয়া। কিডনি প্রতিস্থাপনের পর দীর্ঘদিন ডায়ালাইসিস করিয়েছিলেন তিনি। অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে পড়ায় নিউইয়র্কে অন্য এক বাংলাদেশিকে বিয়ে করেন রেবা বডুয়া। কিন্তু বিশ্বজিতের খরচ চালিয়ে যান তিনি। দীর্ঘদিন রোগে ভোগার পর গত ২৩ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রে মারা যান তিনি। গত ১২ মে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ১ নম্বর দক্ষিণ পাহাড়তলীর ফতেয়াবাদের ব্রাম্মান পাড়ায় সমাহিত করা হয় কথিত অচিন বাবাকে।

তবে বিশ্বজিতকে সেখানে যে রীতিনীতিতে সমাধিস্থ করা হয় তা নিয়ে জনমনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। তাদের প্রশ্ন, এক ব্যক্তি সব ধর্মের সাধক হলো কিভাবে? বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী হয়ে বিশ্বজিতের জানাযা কেন পড়ানো হলো? ১৩ মে বিশ্বজিতের কথিথ ’জানাযায়’ অংশগ্রহনকারী ফতেয়াবাদ এলাকার বাসিন্দা আবু মুছা জানান, বেলা ১১টার দিকে দক্ষিণ পাহাড়তলীর হাজি পাড়া সড়ক দিয়ে পশ্চিমে ব্রাম্মন পাড়ায় ঢোকে একটি লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স। সেটিতে ছিল একটি কফিন। কফিনবাহী অ্যাম্বুলেন্সের সামনে ছিল ১৫-১৬টি মোটর সাইকেলের বহর। পেছনে ছিল শতাধিক নারী পুরুষ। তবে তারা কেউ স্থায়ী বাসিন্দা নয়।

সকাল থেকে সমাধিস্থলে জমায়েত হয় ’অচিন বাবার’ পাঁচ শতাধিক ভক্ত। তাদের কেউ হিন্দু, কেউ বৌদ্ধ এবং কেউ মুসলিম। তবে বেশিরভাগ ভক্ত ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী। হালিশহর, পাথরঘাটা, পটিয়া, রাউজান থেকে এসেছিলেন তারা। সমাধিস্থলে কফিনটি আনার পর হিন্দু ধর্মাবলম্বী নারী পুরুষ উলু ধ্বনি দিতে থাকেন। এরপর অনুষ্টিত হয় অচিন বাবার কথিত জানাযা। জানাযায় ইমামতি করেন সালেহ সুফিয়ান নামের এক ব্যক্তি। জানাযার পর বৌদ্ধধর্মের অনুসারীরা প্রার্থনা করেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, কথিত জানাযার পর নীল টিন দিয়ে বিশেষ কায়দায় তৈরী একটি ঘরে সমাধিস্থ করা হয় বিশ্বজিৎ বড়ুয়াকে। সমাহিত করার পর ভক্তরা লাইন ধরে অনেকটা মাইজভান্ডার দরবারের আদলে কথিত অচিন বাবাকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। সমাধিস্থল ছেয়ে যায় শোক সম্বলিত ব্যানারে ব্যানারে। স্থানীরা জানান, ’অচিন বাবার’ অনুসারী একটি গ্র“প উত্তর ফতেয়াবাদের ব্রাম্মানপাড়ায় গোপাল জিউর মন্দিরের অদুরে ৮৬ শতক নাল জমি ক্রয় করে চলতি মাসের শুরুতে। এরপর শুরু হয় সীমানা দেয়াল নির্মান। ১২ দিনের মধ্যে গড়ে তোলা হয় কথিত বাবার স্থাপনা। তবে কাজ চলে রাতের বেলায়।

নির্মানকাজ চলাকালে রাতে গাড়ি নিয়ে আসতো কিছু লোক। কিন্তু তাদের কাউকে চিনেন না স্থানীয়রা। কথিত অচিন বাবার জানাযা পড়ানো ইমাম সালেহ সুফিয়ান বলেন, ’জানাযার আগে বা পরে অচিন বাবার চেহারা দেখার সুযোগ ছিল না। কারন সেটি ছিল কফিনের ভেতর। মৃত ব্যক্তির নাম জানা কিংবা জানাযা পড়ানোর আগে ইমাম হিসেবে ওই ব্যক্তির চেহারা দেখা আপনার কর্তব্যের মধ্যে পড়ে কিনা প্রশ্ন করা হলে তিনি নিরুত্তর থাকেন। বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী একজন মানুষের জানাযা পড়ানো, কোটি টাকায় জায়গা কিনে রাতারাতি মাজার বানানোর চেষ্টায় এলাকাবাসী বিস্মিত ও ক্ষুদ্ধ। এ ঘটনার পর থেকে ক্ষোভে ফুসসে স্থানীয় বাসিন্দারা। এদিকে অচিন বাবার নামে কথিত মাজার সৃষ্টি করে তামাশা বন্ধ করতে জরুরী পদক্ষেপ নেয়ার জন্য গত ২৭ মে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছে হাটহাজারীর ওলামা পরিষদ নামের একটি সংগঠন।

স্থানীয়দের অভিযোগ, মুলত একটি চক্র অচিন বাবা নামের কথিত মাজার সৃষ্টি করে দক্ষিন পাহাড়তলী এলাকায় নানা কৌশলে নিরিহ মানুষের জায়গা জমি হাতিয়ে নেওয়ার তৎপরতায় লিপ্ত রয়েছে। জানা গেছে, অদুর ভবিষ্যতে ফতেয়াবাদে উপশহর গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের। উক্ত ওয়ার্ডের সাবেক কমিশনার জাফর আলম জানান,এদেরকে সাত দিনের আল্টিমেটাম দেয়া হয়েছে। এখান থেকে কথিত মাজার অপসারন না করলে জনগনকে নিয়ে উচ্ছেদ করা হবে। তিনি আরও বলেন, ’বিগত দিনে নন্দিরহাটে যে সা¤প্রদায়িক দাঙ্গা লাগানোর চেষ্টা হয়েছিল, সেখানকার উস্কানীদাতারাই এই অপকর্মে লিপ্ত।

এ বিভাগের আরও খবর

Comments are closed.