ঈদের কাপড় নয় মাথা গুজার ঠাই চায় মরিয়ম হাফেজরা

কল্যাণ বড়ুয়া মুক্তা, বাঁশখালী :  স্মরণকালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু বাঁশখালীর উপকূল দিয়ে আঘাত হানার পর দেখতে দেখতে মাস পেরিয়ে গেলেও এখনও পর্যন্ত বেশ কিছু পরিবার মানবেতর জীবন যাপন করছে। দিনের বেলায় নিজেদের বিলীন হয়ে যাওয়া ভিটা বাড়ীতে পলিথিন অথবা তেরপালের মাধ্যমে ছাউনী দেওয়া ঘরে অবস্থান করলেও রাতে জোয়ারের পানি অথবা অজানা বিপদের আশংকায় পার্শ্ববর্তী আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েই রাত পার করছে অনেকে। ইউনিয়ন পরিষদের তথ্য মতে রোয়ানুর তান্ডবে খানখানাবাদ ইউনিয়নের ৮ জন নিহত এবং ৯৭২টি বাড়ী সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত এবং ১২শ পরিবার আংশিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়।

বর্তমান রমজান মাসে খোলা বেড়িবাঁধ দিয়ে প্রতিনিয়ত জোয়ার ভাটার পানি ঢুকায় অনেক পরিবারে ঠিকমত ইফতারী অথবা সেহরী করার সেই সুযোগটুকু হয় না বলে জানান প্রেমাশিয়া এলাকার রোয়ানু আক্রান্ত মানুষ গুলো। তার এখনো পর্যন্ত স্থায়ী কোন বাড়ী নির্মাণ করতে না পারায় ঝড় বৃষ্টিতে নানা ভোগান্তির মাধ্যমে দিনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে তারা। গতকাল সরজমিনে বাঁশখালীর খানখানাবাদ ইউনিয়নের প্রেমাশিয়া রোসাঙ্গ্রী পাড়া, মৌলভী পাড়া, কালাগাজী পাড়া, দক্ষিণ প্রেমাশিয়া দিঘীর পাড়া, সুন্দরী পাড়া, সায় পাড়া, পশ্চিম রায়ছটা, উত্তর প্রেমাশিয়াসহ খানখানাবাদের বেশ কিছু এলাকা পরিদর্শন করে রোয়ানুর তান্ডবের চি‎হ্ন এখনো পর্যন্ত রয়ে গেছে ওই সব এলাকায়।

স্থানীয় জনগণের সাথে ঈদ এবং রমজান সম্পর্কে জানতে চাইলে তারা বলেন, যেখানে নিয়মিত জোয়ার ভাটার কারণে বাড়ীতে অবস্থান করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে সেখানে কিভাবে ঈদ করি আমরা। কথা হয় বয়োবৃদ্ধ মরিয়ম খাতুন (৮০)। তিনি বলেন জীবনের বেশ কিছু ঝড় তুফানে মুখোমুখি হয়েছি। শেষ পর্যায়ে এসে রোয়ানুর তান্ডবে শেষ সম্বল বাড়ীটা তছনছ হয়ে যায়। বর্তমানে মানবেতর জীবন যাপন করছি আমরা। সেখানে ঈদের আনন্দ কিভাবে আমরা আনন্দিত হবো। এখই ভাবে বললেন শামশুন নাহার (৫০)। তিনি বলেন রোয়ানুতে বাড়ীঘর বিলীন হওয়ার পর অনেক কষ্টে তেরপাল এবং ঘেরাবেড়া দিয়ে কোন রকমে দিনযাপন করছি। প্রতিদিন জোয়ার ভাটার পানি উঠে ঈদের কাপড় কিভাবে নেব এই অবস্থায়।

আমাদের কাছে ঈদের চেয়ে জীবনে বেঁচে থাকা অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ। কথা হয় একই এলাকার গৃহহারা হাফেজা খাতুনের সাথে। তিনি বলেন, দিনের বেলা এখানে তেরপাল দিয়ে ঘেরা বেড়া দেওয়া বাড়ীতে অবস্থান করলেও রাতের বেলায় আশ্রয় কেন্দ্রে গিয়ে থাকতে হয়। এখনো পর্যন্ত বাড়ীটি ঠিক করতে পারিনি। ঈদের দিনে নতুন কাপড় এবং ঈদের নানা আয়োজনের ইচ্ছা থাকলেও কিভাবে এসব ইচ্ছা পূরণ করবো জানি না। বাঁশখালীর খানখানাবাদ ইউনিয়নের বেশ এলাকা বিগত ১৯৯১ এর ঘূর্ণিঝড়ের পর থেকে জোয়ার ভাটার তান্ডবে একে একে বিলীন হয়ে গেলেও কার্যকর এবং স্থায়ী বেড়িবাঁধ না হওয়ায় দিন দিন ছোট হয়ে আসছে খানখানাবাদ ইউনিয়নটি।

এক সময়ের ঐতিহ্যবাহী খানখানাবাদ বাজার ও প্রেমাশিয়া বাজার এখন কালের সাক্ষী। খানখানাবাদ বাজারে কয়েকশ দোকান থাকলেও এখন তার কোন স্মৃতিচি‎হ্ন নেই। অপরদিকে প্রেমাশিয়া বাজারে কয়েকশ দোকান পাট থাকলেও বর্তমানে কয়েকটি দোকান রয়েছে। তারাও যেকোন মুহুর্তে অন্যত্রে স্থানান্তরিত হওয়ার পথে রয়েছে। দিন দিন বিলীন হচ্ছে খানখানাবাদের উপকূলীয় এলাকা। বাঁশখালীর খানখানাবাদ ইউনিয়নটি বাঁশখালীর ইতিহাস থেকে একদিন মুছে যাবে। যেভাবে জোয়ার ভাটার তান্ডবে একের পর এক বিলীন হতে বসেছে। এ ব্যাপারে স্থানীয় চেয়ারম্যান আবু ছিদ্দিক আবু বলেন, প্রতিটি দুর্যোগেই সীমাহীন দুর্ভোগে পোহাতে হয় খানখানাবাদবাসীকে।

স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণের জন্য বারবার বরাদ্দ আসলেও কার্যত তা যথাযথ কাজ না হওয়ায় জোয়ার ভাটার পানিতে ভাসতে হয় খানখানাবাদবাসীকে। বর্তমানেও রোয়ানুর তান্ডবের পর ২ কোটি ৪১ লক্ষ টাকা দিয়ে যে রিং বাঁধ করা হচ্ছে তাতেও প্রায় ১৭শ পরিবার এই বাঁধের বাইরে থাকবে। যেখানে এই এলাকার লোকজন নিয়মিত সেহরী ও ইফতার করতে পারে না সেখানে ঈদের আনন্দের ছেয়ে বেঁচে থাকা অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ। তিনি খানখানাবাদ উপকূলে স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণে সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেন। খানখানাবাদের রোসাঙ্গ্রী পাড়া ঘুরে কথা হয় আবদুল মতলব, নেজাম উদ্দিনসহ আরো অনেকের সাথে। তাদের মতে যতদিন পর্যন্ত এ এলাকায় স্থায়ী বেড়িবাঁধ হবে না ততদিন পর্যন্ত এই এলাকায় বসবাস করা দুর্বিসহ হয়ে পড়বে। তারা খানখানাবাদ বাসীকে বাঁচাতে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের দাবী জানান।

এ বিভাগের আরও খবর

Comments are closed.