পবিত্র ঈদ-উল-ফিতর

আবছার উদ্দিন অলি – 
‘ঈদ’ মানে আনন্দ আর ‘ফিতর’ মানে ভঙ্গ করা। অর্থাৎ আল্লাহর বান্দারা তার নির্দেশ মেনে চরম পরীক্ষায় লিপ্ত ছিল একমাস। তারা সাওম পালন, তারাবীহ আদায়, ইতেকাফে অংশগ্রহণ, যাকাত-ফিতরা আদায়ে মগ্ন ছিল। আর কঠিন ইবাদত হতে অব্যাহতির আনন্দই হলো ঈদ-উল-ফিতরের আনন্দ। এই ঈদ-উল-ফিতর শুরু হয় হিজরি দ্বিতীয় সাল থেকে। মুসলমানদের রোজাও ফরজ করা হয় হিজরি দ্বিতীয় সালে। বদরের যুদ্ধের পরপরই ঈদ-উল-ফিতরের আগমন ঘটে। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (দ.) ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ পরিবেশে ঈদ-উল-ফিতর পালন করতেন। ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের আনন্দ ও মাগফিরাতের ভ্রাতৃত্বের ও সহানুভূতির, ভালোবাসা ও মানবিকতার এক অপূর্ব মিলন আয়োজন হচ্ছে ঈদ-উল-ফিতরের পবিত্র দিন।

রোজার শেষে খুশির সওগাত নিয়ে পবিত্র ঈদ-উল-ফিতর সমাগত। চাঁদ দেখা সাপেক্ষে ৭ জুলাই পবিত্র ঈদ-উল-ফিতর। দীর্ঘ এক মাস সংযম সাধনার মাধ্যমে ‘আল্লাহ-ভীতি’ বা তাকওয়া অর্জন ও আত্মশুদ্ধির যে তাগিদ অনুভব করেন মুসলিম জাহানের ঈমানদারগণ, ঈদ-উল-ফিতর তার পূর্ণতার সুসংবাদ। রহমত, বরকত ও মাগফেরাতের মাস ‘মাহে রমজান’র একেবারে শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে বিশ্ব মুসলিম আবেগাপ্লুত কন্ঠে উচ্চারণ করছে ‘আলবিদা, মাহে রমজান’। আর সে সঙ্গে তারা অপেক্ষা করছে একটি দিনের। অপেক্ষা করছে ঈদ-উল-ফিতরের। বৈশিষ্ট্য ও তাৎপর্যে এই দিনটি বিশ্বমুসলিমের জীবনে অনন্যসাধারণ। দিনটি একদিকে যেমন হাসি-খুশী ও আনন্দের, অন্যদিকে দরিদ্র ও দুস্থদের ফিতরা বিতরণের দিন। উৎসবকে সম্পদ বন্টনের সাথে এক সূত্রে বেঁধে দেয়াতে দিনটি হয়ে উঠেছে মহান ও অতিশয় পবিত্র।

দীর্ঘ এক মাস কঠিন সিয়াম সাধনার পর আল্লাহ রাব্বুল আলামিন নিয়ামত হিসেবে দিনটি মুসলমানদের জন্যে নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। ঈদের সার্থকতা নিহিত রয়েছে অন্যের প্রতি দরদ, দায়বোধ ও সমভাবে সুখ-দুঃখ ভাগ করে নেয়ার মধ্যেই। ইসলাম নিজের খুশী, নিজের আনন্দ এবং নিজে ভোগ-বিলাসের মধ্যে জীবন-যাপনকে কোনভাবেই অনুমোদন দেয় না। কঠোর সিয়াম সাধনা আমাদেরকে একজন উপবাসীর, একজন তৃষ্ণার্তের, একজন কাতর মানুষের দুঃখ-কষ্টকে জানার ও অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ করে দেয়। মহান রাব্বুল আলামিন রমজান মাসকে বরকত, রহমত এবং মাগফিরাতের মাস হিসেবে বিশেষভাবে ঘোষণার মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে তার বান্দাদের জন্যে নাজাত ও আত্মশুদ্ধির এক মহামহিম সুযোগ করে দিয়েছেন। রোজার উদ্দেশ্য নিছক উপবাস নয়। আত্মা ও চিত্তের শুদ্ধিই হচ্ছে রোজার মুখ্য উদ্দেশ্য। মোমিন মুসলমান তিনিই, যিনি নিজেকে পরিবার, সমাজ ও দেশের জন্যে উৎসর্গীত করেছেন। শুধু নিজের বা পরিবারের জন্যে বাঁচা সত্যিকারের মোমিন মুসলমানদের লক্ষ্য হতে পারে না। বাঁচতে হবে সমাজ, জাতির কল্যাণ ও মঙ্গলের জন্যেই। আর এটিই সত্যিকারের মুসলমানদের জন্যে নির্দেশিত পথ।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, যাদের ওপর যাকাত প্রদান ফরজ হয়েছে তাদের বেশির ভাগই যাকাত দেন না। যদি সামর্থবান সবাই যাকাত দিতো তাহলে দেশে গরীব ও বেকার জনসংখ্যার পরিমাণ দিন দিন কমে যেতো। এভাবে এক সময় দেশ দারিদ্রমুক্ত হতো। আবার অনেক সম্পন্ন ও ধনাঢ্য ব্যক্তি যাকাত দেন লোক দেখানোর জন্যে, সামাজিক মর্যাদা লাভের আশায় ঢাকঢোল পিটিয়ে। এতে অনেক সময় দরিদ্র জনগণ যাকাত নিতে গিয়ে ভিড়ে পদপিষ্ট হয়ে মারা যায়। এটি ইসলাম বিরোধী। প্রকৃত মুসলমানরা গোপনে দরিদ্র ব্যক্তিদের বাড়িতে গিয়েই যাকাত প্রদান করে আসেন। যারা নিজেদের মোমিন মুসলমান দাবি করেন তাদের উচিত গরীবের হক আদায়ে ইসলাম নির্দেশিত পথ অনুসরণ করা।

বস্তুত পক্ষে সিয়ামের উদ্দেশ্য লক্ষ্য হচ্ছে এটিই। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন রোজাদারদের পুরস্কার তিনি নিজেই পদান করবেন এমন অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন পবিত্র কোরান মজিদে। একজন রোজাদারের ইবাদত কবুল করার নিশ্চয়তাও দিয়েছেন আল্লাহ পাক স্বয়ং। রোজার এমন মহিমা ও মর্যাদার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা রোজাদারের প্রতি তার করুণা ও সন্তুষ্টিরই প্রকাশ ঘটিয়েছেন। আর রোজা শেষে যে খুশির ঈদ, তা অবশ্যই নতুন জামা-কাপড় আর উপাদেয় খাবারের আয়োজনের মধ্যে নয় বরং তার মহিমাত্ব নিহিত রয়েছে সবার মধ্যে নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার মধ্যে। অভাবী, গরীব ও বঞ্চিতদের প্রতি সামর্থবানদের অধিকার প্রতিষ্ঠার মধ্যে। ইসলাম বলেছে, ধনীদের সম্পদে গরীবদের হক আছে। তাই ধনীদেরকে গরীব ও এতিমদের হক আদায় করতে হবে। এ কারণেই ইসলামে যাকাত ফরজ করা হয়েছে। প্রকৃত মুসলমানরা ইসলাম নির্দেশিত পথে অক্ষম ও অভাবী মানুষদের মধ্যে পর্যাপ্ত পরিমাণ যাকাত বন্টন করে তাদের স্থায়ীভাবে অভাব মুক্ত করে।

পবিত্র ঈদ-উল-ফিতরকে সামনে রেখে আমাদেরকে অবশ্যই নিজেদের জীবন যাপনে এবং অন্যের সুন্দর জীবন পরিচালনায় আমাদের দায়িত্ব পালন করার বিষয়টি গুরুত্বের সাথে ভাবতে হবে। ধর্মীয় আদেশ-নিষেধের প্রতি হতে হবে আরো বেশি যতœবান। সিয়াম সাধনা এবং পবিত্র ঈদ-উল-ফিতর উদ্যাপনের আনন্দ-উল্লাসের মধ্য দিয়ে যদি উৎসবের মূল শিক্ষাই আমাদের জীবনে কোনো ছায়াপাত না করে, তবে তা হবে আমাদের জন্যে বড় ব্যর্থতা। ঈদ উৎসব সফল হবে তখনই, যখন ইসলামের সাম্যে ও ভ্রাতৃত্বের সকল মর্মবাণী ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে প্রতিফলিত হবে। ঈদুল ফিতরে আমাদের কামনা, মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সকল আগ্রাসন ও জুলুম-নির্যাতন থেকে মুসলামানদের রক্ষা করুন, মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য, সংহতি, সহযোগিতা বৃদ্ধি করুন, সকলের ইহলৌকিক ও পরলৌকিক মুক্তি ও কল্যাণ দান করুন। মুসলিম জাহান এবং আমাদের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে বড় খুশির এই পবিত্র দিনটিতে সকলের প্রতি রইলো ঈদের শুভেচ্ছা ঈদ মোবারক।

এ বিভাগের আরও খবর

Comments are closed.