চট্টগ্রামে ব্যাটারীচালিত রিকশা – নেপথ্যে কোটি টাকার প্লেট বানিজ্য চলছে!

0

জুবায়ের সিদ্দিকী :     চট্টগ্রামের সচেতন মহল ও যাত্রী সাধারনের তীব্র প্রতিবাদের পরও নগরীতে পাগলা ঘোড়ার মত ছুটে চলেছে ব্যাটারীচালিত অটোরিকশা। সাধারন রিকশার সাথে চারটি পাওয়ারফুল ব্যাটারী ও একটি মোটর জুড়ে দিয়ে তৈরী করা হয়েছে আজব যানবাহন ব্যাটারীচালিত রিকশা। অত্যন্ত দ্রুতগতি সম্পন্ন এসব রিকশায় নেই স্পিড কন্ট্রোল ব্যবস্থা বা ব্রেক। ভাল খারাপ সব রাস্তায় সমান তালে চলতে থাকে এসব গাড়ি।

ফলে নগরীতে প্রতিদিন ছোট বড় শতাধিক দুর্ঘটনার জন্ম দিচ্ছে ব্যাটারী রিকশা। সরকারের কোন অনুমোদন নেই, সিটি কর্পোরেশনের লাইসেন্স নেই, বিআরটিএ কর্তৃপক্ষের কোন ছাড়পত্রও নেই, তারপরও অদৃশ্য এক ক্ষমতার জোরে এসব গাড়ি চলছে নগরীর রাস্তায়। এসব ব্যাটারী রিকশা নিয়ে প্লেট আর স্টিকার বানিজ্যে নেমেছে নগরীর বেশকিছু ব্যাটারী রিকশা ও সিএনজি অটোরিকশা সংগঠন। হাইকোর্টে রিট আবেদন করে প্রকাশ্যে কয়েক কোটি টাকার বানিজ্য করছে এসব সংগঠন। সংগঠনগুলো অবৈধভাবে বানিজ্যে জড়িত থাকলেও প্রশাসন রহস্যজনক নিরব।
অপরদিকে প্লেট আর ষ্টিকার লাগিয়ে নগরে রাজার বেশে চলছে ব্যাটারীচালিত রিকশা ও নম্বরবিহীন সিএনজি। হাইকোর্টের নির্দেশের পর নম্বরবিহীন সিএনজি অটোরিকশার বিরুদ্ধে ব্যবস্থার কথা জানান নগর পুলিশ। জানতে চাইলে নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার একেএম শহিদুর রহমান বলেন,’ ব্যাটারীচালিত রিকশার ব্যাপারে আমাদের এই এই মুহুর্তে কোন ডেভলপমেন্ট নেই। তাদের একটা রিট থাকাতে আমরা কোন পদক্ষেপ নিতে পারছি না। তবে নম্বরবিহীন সিএনজি অটোরিকশার বিরুদ্ধে সহসা অভিযান শুরু হবে। এসব গাড়ি রাস্তায় পেলে জব্দ করা হবে।

নগরীতে প্রায় তিন বছর ধরেই চলছে ব্যাটারীচালিত রিকশা। দুই তিনটি সংগঠনের অধীনে এসব রিকশা নগরীতে চলতে শুরু করে। হঠাৎ করে জনপ্রিয়তা পাওয়াতে দিনে দিনে বাড়তে থাকে এ রিকশা। দ্রুত ও কম ব্যয়ে যাতায়াতের কারনে এ বাহন যেমন জনপ্রিয়তা পায়, তেমনি বেশি দুর্ঘটনার কারনে সবার কাছে আতঙ্কের নামও হয়ে উঠে এই রিকশা। যে কারনে ব্যাটারী রিকশা বন্ধে বিভিন্ন মহল থেকে সুপারিশ আসতে থাকে। সর্বশেষ গত বছর হাইকোর্ট ঢাকা ও চট্টগ্রাম নগরীতে ব্যাটারী রিকশা নিষিদ্ধ ঘোষনা করে। পরবর্তীতে রিট আবেদনের মাধ্যমে চট্টগ্রামে ব্যাটারী রিকশা চলাচলের সুযোগ পায়। আর এ সুযোগে বেশকিছু সংগঠন গজিয়ে উঠে । মুলত প্লেট বিক্রি করাই এসব সংগঠনের মুল কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রিট নিয়ে আসলেই সেই সংগঠনের নামে দ্রুত বাজারে প্লেট ব্যবসা শুরু হয়। যার কারনে সব ব্যাটারী রিকশা চালক ও মালিক এ সুযোগ পাওয়ার কথা। কিন্তু নগরীতে শুধু প্লেট সংবলিত ব্যাটারী রিকশাগুলোর কপালেই জুড়ে এ সুযোগ। এই অবস্থা নগরীর নম্বরবিহীন সিএনজি অটো রিকশার ক্ষেত্রেও। হাইকোর্টের রিটের নামে নম্বরবিহীন অটোরিকশা সংগঠনগুলো স্টিকার বানিজ্যে নেমেছে। প্রতিটি নম্বরবিহীন সিএনজি অটোরিকশায় সংগঠনের ষ্টিকার লাগাতে খরচ করতে হয় ৩ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত। তার উপর প্রতিমাসে নির্দিষ্ট অংকের চাঁদা তো আছেই।

 

প্লেট ও ষ্টিকার বানিজ্য বন্ধে পুলিশের কোন পদক্ষেপ থাকবে কিনা জানতে চাইলে নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার একেএম শহিদুর রহমান বলেন,’এ রকম কোন অভিযোগ আমাদের কাছে নেই। সমিতিভুক্ত হয়ে তারা মামলা চালায়। মামলার খরচ যোগানোর জন্য সদস্যদের কাছ থেকে চাঁদা তোলে। যদি এ ক্ষেত্রে কোন অনিয়মের অভিযোগ পাই তবে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেব।’ সুত্র মতে, নগরীতে ব্যাটারী রিকশা সংগঠন আছে ১৮টি। এসব রিকশা রাস্তায় নামার জন্য সংগঠনগুলো থেকে এক হাজার থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকার বিনিময়ে, তিন, চার বা ছয় মাসের জন্য প্লেট নিতে হয়। এ ছাড়া রিকশা প্রতি আছে মাসিক চাঁদাও। এ ক্ষেত্রে প্রতিটি সংগঠনের অধীনে প্রতিমাসে কোটি টাকার চাঁদাবাজি চলছে।
একই অবস্থা নম্বরবিহীন সিএনজি চালিত অটোরিকশার ক্ষেত্রেও। দীর্ঘদিন থেকে নম্বরবিহীন এসব সিএনজি অটোরিকশা ষ্টিকার লাগিয়ে রাস্তায় থাকলেও প্রশাসন তেমন কোন অভিযান চালান না। হাইকোর্টের রিটের অভিযোগে এসব নম্বরবিহীন অটোরিকশার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অনিহা প্রকাশ করে পুলিশ। ২০১৩ সালের নভেম্বর মাসে চট্টগ্রাম অটোরিকশা অটোটেম্পু শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারন সম্পাদক হারুনুর রশিদ এ রিট আবেদন করেন। তখন হাইকোর্ট এক নির্দেশনায় এসব অটোরিকশা চলাচলে বাধা না দেওয়ার জন্য নির্দেশনা দিয়েছিল। কিন্তু সম্প্রতি তাদের রিট আবেদনটি খারিজ করে হাইকোর্ট পুর্নাঙ্গ রায় দেন।
হাইকোর্টের বিচারপ্রতি মির্জা হোসেইন হায়দার ও বিচারপ্রতি একেএম জহিরুল হকের সমন্বয়ে গঠিত ব্যাঞ্চ রিটটি খারিজ করে দিয়ে এসব অটোরিকশা জব্দ করার জন্য নির্দেশ দিয়েছে হাইকোট। এদিকে হাইকোর্টের নির্দেশের পরও নগরীতে সংগঠনের স্টিকার লাগিয়ে ’এএফআর’ ’চট্টমেট্রো-গ-১২’ লিখে গাড়িগুলো চালানো হচ্ছে। যোগাযোগ করা হলে চট্টগ্রাম অটোরিকশা অটোটেম্পো শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারন সম্পাদক হারুনুর রশিদ বলেন, আমরা সর্বোচ্চ আদালতে আপীল করবো। ষ্টিকার বানিজ্যের বিষয়ে তিনি বলেন,’ সংগঠনে ভর্তি ফি বাবদ ১২০০ টাকা এবং প্রতিমাসে ৩০০ টাকা করে আমরা চাঁদা নিয়ে থাকি। এসব টাকা সদস্যদের উন্নয়নে ব্যয় করা হয়। ষ্টিকার নিয়ে ১০-১৫ হাজার টাকা আদায় করার কথা সত্য নয়।
নগরীর বিভিন্ন এলাকা সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, সাধারন রিকশার পাশাপাশি নগরীতে ব্যাটারীচালিত রিকশা ও নম্বরবিহীন সিএনজি অটোরিকশা চলছে সমানতালে। কোন কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রনে না থাকায় এগুলোর সঠিক পরিসংখ্যান নেই কারো কাছে। এসব রিকশার পেছনে কর্পোরেশনের নম্বর প্লেটের পরিবর্তে রয়েছে বিভিন্ন মালিক সমিতির নাম, ঠিকানা, সদস্য নম্বর এবং সভাপতি ও সাধারন সম্পাদকের সই ও মোবাইল নম্বর সহ প্লেট। এটাই তাদের লাইসেন্স।
চট্টগ্রাম ব্যাটারীচালিত অটোরিকশা চালক মালিক সমিতি, চট্টগ্রাম ব্যাটারীচালিত অটো রিকশা মালিক লীগ, চট্টগ্রাম সিটি রিকশা মালিক ফেডারেশন, চট্টগ্রাম মহানগর ব্যাটারীচালিত অটোরিকশা চালক মালিক ফেডারেশন, ব্যাটারীচালিত রিকশা চালক মালিক মহাজোট, চট্টগ্রাম ব্যাটারিচালিত রিকশা মালিক চালক সংগ্রাম পরিষদ, রিকশাচালক মালিক ফোরাম, চট্টগ্রাম মহানগর ব্যাটারিচালিত রিকশা মালিক সমিতি, রিকশামালিক শ্রমিক ঐক্যজোট প্রভৃতি নামে প্রায় ১৮টি অবৈধ সমিতি রয়েছে নগরীতে। নামে বেনামে সংগঠিত হয়ে এসব সংগঠন প্রতিমাসে কোটি টাকা আদায় করছে।
রাস্তায় চলার অনুমতি, চোর, পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের ম্যানেজ করার নামে এসব রিকশা থেকে চাঁদা আদায় করা হয় বলে জানা গেছে। প্রতিটি ব্যাটারী রিকশার প্লেট প্রতিটি বিক্রি হয়ে ১ হাজার থেকে ৩ হাজার টাকায়। সে হিসেবে প্রতিবার প্লেট বদলীয়ে সংগঠনগুলো হাতিয়ে নেয় ২ থেকে ৩ কোটি টাকা। অপকর্মের মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে আছেন চট্টগ্রাম সিটি রিকশা মালিক ফেডারেশন। প্লেট ব্যবসায় সালামত আলীর নেতৃত্বে এ সংগঠন নিয়ন্ত্রন করে নগরীর প্রায় অর্ধেক রিকশা।
সম্প্রতি পুরো নগরীর ব্যাটারী রিকশার প্লেট ব্যবসা নিজের আয়ত্বে আনতে সালামত আলী নগরীর ১০৮ রিকশা মালিককে সংগঠিত করেছে। এদের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রন করছে প্লেট ব্যবসা। তবে এ ক্ষেত্রে সালামত আলীর অভিমত হচ্ছে, আমরা হাইকোর্টে গেছি, আমাদের টাকা খরচ হয়েছে। এ খরচ তুলে আনতে আমরা সদস্যদের কাছ থেকে চাঁদা তুলছি।
সংশ্লিষ্টদের মতে, গত ২৩ মার্চ নগরীতে ব্যাটারীচালিত রিকশা বন্ধ করে দেয় পুলিশ। এরপর ১৯ এপ্রিল নগরীতে ব্যাটারীচালিত রিকশা চালক মালিকদের এক সভায় আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ এমপি বলেন,’ আ.জ.ম নাছির উদ্দিন মেয়র নির্বাচিত হলে চট্টগ্রামে আবার ব্যাটারী রিকশা চলবে। পরবর্তীতে ২৫ এপ্রিল থেকে অবাধে চলছে ব্যাটারীরিকশা।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.