চট্টগ্রামে মোছলেম উদ্দিন বনাম জাবেদের বাদ বিবাদের রাজনীতি

0

জুবায়ের সিদ্দিকী : চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোছলেম উদ্দিন আহমদ এক সময়ের তুখোড় ছাত্রনেতা ছিলেন। চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের ১৯৭২-৭৩ কমিটির সাধারন সম্পাদক ছিলেন। ১৯৬৭-৬৮ সাল থেকে তিনি ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় ভুমিকা পালন করেছেন। ৬ দফা ও ১১ দফা আন্দোলন, ৬৯ এর গন অভ্যুত্থানের সময় তাকে দেখেছি রাজপথে। ১৯৭২ সালে তিনি যখন চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সাধারন সম্পাদক আমি তখন ওই কমিটির সহ-সাধারন সম্পাদক ছিলাম। তৃনমুলের রাজনীতি করেন মোছলেম উদ্দিন আহমদ। সাম্প্রতিক সময়ে একজন প্রতিমন্ত্রী একটি জনসভায় মোসলেম উদ্দিনের কড়া সমালোচনা করেছেন। একজন রাজনীতিবিদকে এভাবে আক্রমণ করে কথা বলায় সম্ভবত মানুষ অন্ত:ত তার অনুসারীরা দু:খ পেয়েছেন। রাজনীতিতে মতপার্থক্য বিভেদ, পছন্দ-অপছন্দ, ব্যক্তিস্বার্থ থাকতেই পারে, তবে এভাবে প্রকাশ্যে জনসভায় একজন প্রতিষ্ঠিত রাজনীতিবিদকে হেয় প্রতিপন্ন করা কারো কাম্য নয়। চট্টগ্রামে মোছলেম উদ্দিন আহমদ রাজনীতি করেছেন এম, এ আজিজ, জহুর আহমদ চৌধুরী, আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু, এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীসহ সিনিয়র অনেক নেতার সাথে। বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ট সহচর ছিলেন মোছলেম উদ্দিন আহমদ।

রাজনীতিতে শেষ বলে কোন কথা নেই। মানুষ ভুল ত্রুটির উর্ধ্বেও নয়। মোছলেম উদ্দিনের কোন দোষ থাকলে তা দলীয় ফোরামে উঠতে পারে তবে প্রকাশ্যে জনসভায় বিষোদগার করা মোটেও সমীচিন হয়েছে বলে মনে হয় না। অনেক আগেই অর্থাৎ ৭৫ এর পর থেকে রাজনীতিতে না থাকলেও আমি বঙ্গবন্ধুর একজন আদর্শের সৈনিক। পত্রিকায় পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অনেক রাজনীতিবিদের সান্নিধ্যে যাওয়ার আমার সুযোগ হয়েছে। মোছলেম উদ্দিনকে কাছ থেকে দেখেছি। সাবলীল, স্পষ্টবাদী, পরিশ্রমি ও ত্যাগী একজন নেতা হিসেবে তিনি চট্টগ্রামের রাজনীতিতে পরিচিত। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আমলে ছাত্রলীগ ও চট্টগ্রামের রাজনীতিতে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে তার পথচলা ছিল সংগ্রামী ও ত্যাগের। হামলা মামলা থেকে তিনি রেহায় পাননি।

এখনও তিনি রাজনীতিতে অত্যন্ত সক্রিয় এবং দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের কান্ডারী হিসেবে দলকে আগলে রেখেছেন। মরহুম আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু যখন দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি তখন সাধারন সম্পাদক ছিলেন মোছলেম উদ্দিন আহমদ। মরহুম আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর অত্যন্ত আস্থাভাজন ও স্নেহভাজন মোছলেম উদ্দিন বাবু ভাইয়ের খুবই ঘনিষ্ট ছিলেন। এখন তিনি দলের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। সকল নেতাকর্মী যে তার অনুসারী তা নয়, বিপক্ষে অনেকে আছেন। কিন্তু এভাবে প্রকাশ্যে কোন জনসভায় একজন জননন্দিত নেতাকে হেয় প্রতিপন্ন করা কোন যুক্তিতে আসে না। আমরা দু:খিত ও ব্যথিত। চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের মানচিত্রে মোছলেম উদ্দিনের কি কোন অবদান নেই? তিনি ভুলত্রুটির উর্ধ্বে নন। এই জন্য প্রকাশ্যে জনসভায় এমপি-বা মন্ত্রী তার চরিত্র হনন করতে পারেন কি না তা নিয়ে দেখা দিয়েছে প্রশ্ন। একজন মোছলেম উদ্দিন অনেক সংগ্রামে, অনেক ত্যাগের একজন পরীক্ষিত রাজনীতিবিদ। রাজনীতির মধ্যে সহনশীলতা, ধৈর্য, নিষ্ঠা এবং পরমত সহিষ্ণুতা থাকা আবশ্যক। নিজেদের দলের এবং নিজেদের মধ্যে কাঁদা ছোড়াছুড়ি সুষ্ঠু রাজনীতির বহি: প্রকাশ হতে পারে না।

ছোটকাল থেকে ছাত্রজীবনের শুরু থেকে ছাত্রলীগের রাজনীতির পথ ধরে মোছলেম উদ্দিন এতদুর এসেছেন অনেত ত্যাগ ও সংগ্রামের বিনিময়ে। সমালোচনা যদি প্রকাশ্যে জনসভায় হয় তবে বলবো, এটা দু:খজনক। বর্তমান সময়ে রাজনীতিবিদদের মধ্যে শিষ্টাচার বহির্ভুত রাজনৈতিক বক্তব্য রাজনীতিকে কলুষিত করছে। দেশ যখন এগিয়ে চলছে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন দেশের উন্নয়ন নিয়ে ব্যস্ত ও দলকে সংঘটিত করছেন তখন নেতাদের এ ধরনের বক্তব্য দলের ভাবমুর্তি ক্ষুন্ন করে। শীর্ষ নেতাদের মধ্যে সম্প্রীতি বিনষ্ট হচ্ছে। রাজনীতির মানচিত্রে এ ধরনের আক্রমণাত্বক ভাষা কোন শিষ্টাচারের মধ্যে পড়ে না। বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিল। ইউসিবিএল ব্যাংকের এক গোলযোগকে কেন্দ্র করে সারাদেশের পত্রপত্রিকা যখন বাবুর বিরুদ্ধে লেখালেখি করছে এখন তখন আজকের সুর্যোদয়ে এই সাহসী সন্তান বাবুর পক্ষে আমাদের প্রতিবেদন ছাপা হয়। এরপর তার ব্যক্তিগত সহকারী নুর মোহাম্মদের মাধ্যমে আমাকে ডেকে পাঠান। বুকে জড়িয়ে ধরেন আমাকে। তিনি দক্ষিন চট্টগ্রামের রাজনীতির আলোকবর্তিকা ছিলেন। কোন অহংকারবোধ তাঁর মধ্যে ছিল না।

বর্ষিয়ান আওয়ামী লীগ নেতা আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ও সোলতান উল কবির চৌধুরীর মধ্যে দক্ষিণ জেলায় গ্রুপিং-দ্বন্দ্ব থাকলেও ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল আপন ভায়ের মত। দুজনই ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা। এ ধরনের রাজনীতিবিদের বড় অভাব বর্তমান সময়ে। আমরা সাধারন মানুষ যা দেখছি তা মোটেই দলের জন্য, সুষ্ঠ রাজনীতির জন্য শুভ নয়। সেই ৬৮ ও ৬৯ সাল থেকে রাজনীতির পথে রাজপথে ছিলাম। কিন্তু কখনো বর্তমান বর্তমান সময়ের মতো রাজনীতিবিদদের আক্রমণাত্বক ভাষা শুনিনি। ৭৫ এর পনের আগষ্ট বঙ্গবন্ধু স্ব-পরিবারে নিহত হওয়ার পর চট্টগ্রাম শহরের মুহুরীপাড়ায় মৌলভী সৈয়দ আহমদের সাথে যখন আমি যোগাযোগ করি তখন লিফলেট ও অস্ত্র তুলে দেন আমার হাতে। তার নির্দেশে নগরীতে অনেক অপারেশনে যোগ দিয়েছিলাম। তিনিও রাজনীতিবিদ ও মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তার আচার ব্যবহার এতই মধুর ও সৌহাদ্যপূর্ন ছিল যে, জীবনকে উৎসর্গ করতে সেদিন প্রস্তুত ছিলাম। এমন ধরনের উদার, মুক্তমনা, আন্তরিক রাজনীতিবিদের অভাব প্রত্যেকটি বড় দলে। একজন প্রতিমন্ত্রীর বোয়ালখালীতে দেয়া বক্তব্য ছিল অসঙ্গতিপুর্ন ও রাজনীতির শিষ্টাচার বহির্ভুত।

এ কথা উল্লেখ করে বোয়ালখালী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নুরুল আলম চৌধুরী বলেন,’ উনার কোন অভিযোগ থাকলে তা দলীয় ফোরামে বলতে পারতেন। এতে করে তিনি দলের সুনাম ও ভাবমুর্তি বিনষ্ট করেছেন।

দক্ষিন জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি হাবিবুর রহমান এ ব্যাপারে বলেন, ভুলত্রুটি থাকতে পারে তবে এটা বসে সমাধান করা উচিত। দেশ যখন জঙ্গিবাদ রুখতে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে এ সময় নিজেদের মধ্যে কাঁদা ছোড়াছুড়ি করা উচিত নয়।

এদিকে মোছলেম উদ্দিন-মন্ত্রী জাবেদ এর বিরোধকে কেন্দ্র করে কিছু নেতা নিরব রয়েছেন। অন্যরা দুই নেতার পক্ষে অবস্থান নিয়ে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। প্রতিমন্ত্রী জাবেদের জেলায় ছয় সংসদ সদস্যও দ্বির্ধাবিভক্ত। এর মধ্যে সাতকানিয়া লোহাগাড়া আসনের এমপি নদভী, চন্দনাইশের এমপি নজরুল ইসলাম ভুমি প্রতিমন্ত্রী জাবেদের সাথে রয়েছেন। অন্যদিকে পটিয়ার এমপি সামশুল হক চৌধুরী, বাঁশখালীর এমপি মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী, মহিলা সংসদ সদস্য ওয়াসিকা আয়েশা খান জেলা আওয়ামী লীগের সাথে আছেন। প্রতিটি উপজেলায় এই দ্বন্দ্বের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। অঙ্গসংগঠনগুলোতেও এই দলাদলীতে আক্রান্ত। একজন নেতা বলেছেন, কখন কে কার আপন বুঝা যায় না।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত বছরের শেষের দিকে সংসদ সদস্য শামসুল হক চৌধুরীর ভাই মুজিবুল হক চৌধুরী নবাবের সাথে কর্ণফুলী আওয়ামী লীগের নেতা জাহাঙ্গীর চৌধুরীর দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এই দন্দ্বের জের ধরে মইজ্যারটেকে সড়ক অবরোধ সহ তুলতালাম কান্ড ঘটলে জাবেদ-শামসুর মধ্যে বিরোধ বাড়ে। এর পর থেকে শামসুল হক চৌধুরীর সঙ্গে জেলা আওয়ামী লীগের সখ্যতা বাড়তে থাকে। এ ছাড়া বেশ কয়েকজন নেতা পছন্দ অপছন্দ ও স্বার্থের কারনে কখনো মন্ত্রীর সাথে, কখনো জেলা আওয়ামী লীগের পক্ষে অবস্থান নেই। গ্রুপ ভারী করতে গিয়ে একসময় মোছলেম ও জাবেদ বিরোধী নেতারাও এখন আপন হয়ে উঠেছেন। এই বিরোধ এখন তৃনমুল পর্যায়ে ছড়াচ্ছে।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.