কল্যাণ বড়ুয়া মুক্তা, বাঁশখালী : বাঁশখালীবাসীর দীর্ঘদিনের অপেক্ষমান বেড়িবাঁধের কাজ অবশেষে শুরু হলেও শুরুতেই নানা ধরনের অসঙ্গতির অভিযোগ উঠেছে স্থানীয়দের মাঝে। তার উপর স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সাথে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান গুলো কোন ধরনের যোগাযোগ না করারও অভিযোগ করেছেন জনপ্রতিনিধিরা। তবে বর্তমানে আগামী ২০১৮ সালের জুলাই মাসকে সামনে রেখে বেড়িবাঁধের নির্মাণাধীন এলাকায় বেশকিছু পাথর মজুদ করেছে সংশি¬ষ্ট টিকাদারগণ। অপরদিকে অনেক স্থানে বিভিন্ন জায়গা বালি আনলেও অনেকে আবার সাগর থেকে বালি উত্তোলন করে কাজ করার প্রক্রিয়া করছে। তাছাড়া সাগরের লবণাক্ত পানি ব্যবহার করায় কাজের টেকসই মান নিয়ে নানাভাবে প্রশ্ন তুলছে স্থানীয় জনগণ।
বাঁশখালীবাসী ১৯৯১ এর ঘূর্ণিঝড়ের পর থেকে বার বার জোয়ার ভাটার তান্ডবে নানা ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হলেও দীর্ঘদিন অপেক্ষমান থাকার পর বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর বাঁশখালী উপকূলে স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণের কার্যক্রম হাতে নেয়। এরই প্রেক্ষিতে বাঁশখালীর উপকূলীয় খানখানাবাদ, বাহারছড়া, গন্ডামারা, ছনুয়া এলাকায় বেড়িবাঁধ নির্মাণের ব¬ক তৈরী করার জন্য ইতিমধ্যে পাথরের মজুদ করা হয়েছে। ৩৩টি প্যাকেজে কাজ পায় ৬টি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। ২শ ৫১ কোটি টাকার এই কাজ শুরু হওয়ায় বাঁশখালীবাসী দীর্ঘদিনের স্বপ্নের বাস্তবায়ন হতে চললেও সাধারণ জনগণ নানামুখী শংকায় আছে এইকাজ যথাযথ ভাবে হবে কিনা। যদি নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে কাজ করা হয় তাহলে আবারো দীর্ঘ যুগ যুগ অপেক্ষা করতে হবে উপকূলবাসীর অভিশপ্ত বেড়িবাঁধের দুঃখ থেকে মুক্তি পেতে।
বাঁশখালীর সচেতন জনগণ প্রশাসনিক কঠোর নজরদারির পাশাপাশি সেনা তদারকিতে এই কাজ করার জন্য প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। বাঁশখালীর খানখানাবাদ, বাহারছড়া, গন্ডামারা ও ছনুয়ার এলাকা সরজমিনে ঘুরে দেখা যায় বেড়িবাঁধ এলাকায় ব¬ক নির্মাণের কাজ শুরু হওয়ায় বেড়িবাঁধ সংলগ্ন জনগণ তাদের আশায় বুক বাঁধলেও তা কতটুকু দীর্ঘস্থায়ী হবে তা নিয়ে রয়েছে নানা ধরনের শংকা। তবে স্থানীয় সাংসদ আলহাজ্ব মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী তিনি কোন কিছুতেই অনিয়ম সহ্য করা হবে না বলে ঘোষনা দিলেও তা কতটুকু কার্যকর হবে তা এখন সময়ের ব্যাপার।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, বর্তমান কাজের মধ্যে পুকুরিয়ায় ১২শ ৬৯ মিটার, সাধনপুরে ২১শ ৭৯ মিটার, খানখানাবাদে ৪ হাজার ৫শ মিটার, বাহারছড়ায় ৬শ মিটার, গন্ডামারায় ১৪শ মিটার, ছনুয়ায় ৩ হাজার ২শ মিটার স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণ কাজ করা হবে উপরোক্ত বরাদ্দের প্রেক্ষিতে। প্রতিটি কাজকে আলাদা প্যাকেজের মাধ্যমে টেন্ডার করা হয়েছে। তার মধ্যে হাছান ব্রাদার্স ২০টি প্যাকেজ, মেসার্স মশিউর রহমান এন্ড চৌধুরী ৮টি প্যাকেজ, মোস্তফা এন্ড সন্স্ ২টি প্যাকেজ, মেসার্স আরাধনা এন্টারপ্রাইজ ২টি প্যাকেজ, মেসার্স নিজাম ট্রেডার্স ১টি প্যাকেজ এর টেন্ডার মূলে কাজ পেয়েছেন। অপরদিকে আলম এন্ড ব্রাদার্স বিগত বেশ কিছুদিন যাবৎ থেকে মাটির কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
বাঁশখালীবাসী বিগত ১৯৯১ এর ২৯শে এপ্রিলের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের পর থেকে বেড়িবাঁধ নিয়ে নানা ধরনের সমস্যায় ভুগে আসছে। প্রতি অমাবশ্যা-পূর্ণিমার জোয়ারে উপকূলীয় জনগণ ভাঙা বেড়িবাঁধের মাধ্যমে পানি প্রবেশ করায় সাধারণ জনগণকে নানা ভাবে ভোগান্তির শিকার হতে হয়। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে বাঁশখালীর উপকূলীয় বেড়িবাঁধ নির্মাণের যে তোড়জোড় শুরু করেছিল দ্রব্য মূল্য বৃদ্ধি না হলে এর আগেই এর কাজ শুরু হতো। প্রথম পর্যায়ে ২শ ৯ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রদানের পর কাজ শুরু হলে এতদিন কাজের প্রায় সমাপ্তির পথে থাকতো। কিন্তু দ্রব্য মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় এই কাজ পুনঃ টেন্ডারের মাধ্যমে ২শত ৫১ কোটি টাকায় বাজেটে উন্নীত করা হয়।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, বিগত দিনে গন্ডামারা ইউনিয়নের বাংলা বাজার এলাকা, খানখানাবাদের ঈশ্বর বাবুর হাট এলাকা, কাথারিয়া ইউনিয়নের বেড়িবাঁধ, শেখেরখীর ইউনিয়নের অভ্যন্তরীন বেড়িবাঁধ, ছনুয়া ও পুঁইছড়ি ইউনিয়নের অভ্যন্তরীন বেড়িবাঁধের উন্নয়নমূলক কার্যক্রম হয়েছে। এদিকে বাঁশখালীর সাধনপুর এলাকায় শঙ্খ নদীর ভাঙন। খানখানাবাদ, বাহারছড়া, সরল, গন্ডামারা ও ছনুয়ায় বঙ্গোপসাগরের ভাঙন এছাড়াও কাথারিয়া, পুঁইছড়ি, শীলকূপ, শেখেরখীল এলাকার অভ্যন্তরীন বেড়িবাঁধের ভাঙন রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে এবং ইতিমধ্যে বেশ কিছু এলাকায় বেড়িবাঁধের মাটির কাজ হয়েছে। ১৯৯১ এর ২৯শে এপ্রিলের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে বাঁশখালীর উপকূলীয় এলাকার অর্ধ লক্ষাধিক মানুষ অকালে প্রাণ হারায়।
এছাড়া কোটি কোটি টাকার সম্পদ চিরতরে হারিয়ে যায়। বাঁশখালীর উপকূলে স্থায়ী বেড়িবাঁধ না থাকায় বিগত দিন গুলোতে বাঁশখালীর উপকূলীয় এলাকার কয়েক কিলোমিটার জায়গা সাগর গর্ভে বিলীন হয় এবং স্থায়ী বেড়িবাঁধ না থাকায় যেকোন অমাবশ্যা পূর্ণিমা সাগরে জোয়ারের পানিতে ভাসতে হয় উপকূলবাসীকে। একদিকে বঙ্গোপসাগর, অপর দিকে শঙ্খ নদীর ভাঙন সব মিলিয়ে বাঁশখালীর ভাঙন রোধ করতে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের কোন বিকল্প নেই। এই গুরুত্ব বিবেচনা করে বাঁশখালীর সাংসদ সরকারের মাধ্যমে যে বিশাল অংকের বরাদ্দ আনতে সক্ষম হয়েছেন সে কাজের যথাযথ বাস্তবায়ন চায় স্থানীয় জনগণ।
বাঁশখালীর খানখানাবাদ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবু ছিদ্দিক আবু বলেন, আমার এলাকায় বেড়িবাঁধের নির্মাণ কাজ এবং ব¬ক তৈরীর কাজ শুরু হলেও কাজের শুরুতেই লবণাক্ত পানি ব্যবহার এবং সাগর থেকে বালি তুলে কাজ করা হচ্ছে। যার ফলে এই কাজ কতটুকু টেকসই হবে তা নিয়ে নানা ভাবে প্রশ্ন তুলেন তিনি। তিনি বলেন, আমার এলাকায় কাজ করা হলেও যেসব টিকাদার এই এলাকায় কাজ করছে তারা ধরনের জনপ্রতিনিধিদের সাথে সমন্বয় সাধন করছেনা। একই ভাবে বললেন ছনুয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রেজাউল হক চৌধুরী ও গন্ডামারা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আরিফ উল¬াহ। তারা বলেন, টিকাদাররা কাজ পরিচালনার জন্য বিভিন্ন ভাবে জিনিসপত্র মজুদ করলেও আমাদের সাথে কোন ধরনের সমন্বয় করছে না।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-প্রকৌশলী ধীমান কৃষ্ণ চৌধুরী বলেন, বর্তমান কাজে যে ভাবে টেন্ডার আহবান করা হয়েছে। সে অনুসারে কাজ করতে বাধ্য ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। পাউবো’র পক্ষ থেকে কাজে কোন ধরনের অনিয়ম সহ্য করা হবে না। তিনি কাজে প্রশাসনের পাশাপাশি সর্বস্তরের জনগণকে সহযোগিতার আহবান জানান এবং কাজে অনিয়ম এবং দুর্নীতি হলে সাথে সাথে অবহিত করার জন্য আহবান জানান।
বেড়িবাঁধের কাজ সম্পর্কে জানতে চাইলে বাঁশখালীর সাংসদ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অর্থ ও পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী কমিটির সদস্য আলহাজ্ব মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী বলেন, আওয়ামীলীগের রাজনীতি হচ্ছে উন্নয়নের রাজনীতি। এ ধারাকে বিশ্বাস করে বাঁশখালীর সাংসদ নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে এলাকার উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছি। বাঁশখালীর উপকূলে স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণ কাজ শেষ হলে উপকূলবাসী দীর্ঘদিনের অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবে। তিনি উন্নয়ন কাজে কোন ধরনের অনিয়মকে প্রশ্রয় দেবে না বলে দৈনিক আজাদীকে জানান। তিনি বলেন বাঁশখালীর উপকূলীয় বেড়িবাঁধ নির্মাণে কোন ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতির আশ্রয় না নেওয়ার জন্য আহবানের পাশাপাশি নিমার্ণ কাজ যথাযথ ভাবে সম্পাদন করা হবে আশ্বাস প্রদান করেন।
বাঁশখালীর উপকূলে দীর্ঘদিনের অপেক্ষমান বেড়িবাঁধ নির্মাণ কাজে শুরু থেকেই নানা অনিয়ম এবং অসঙ্গতি রোধ করা সম্ভব না হলে আবারো উপকূলবাসী নানা ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে। এজন্য উপকূলবাসী সরকার এবং উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।