সাংবাদিকতা ও মানহানি মামলা

0

এডভোকেট সালাহ্উদ্দিন আহমদ চৌধুরী লিপু–

ইতিহাস থেকে জানা যায়, প্রায় ১৬০ বছর পূর্বে চীন দেশে সংবাদপত্রের সৃষ্টি। সংবাদপত্র সমাজের দর্পন, সভ্যতার মেরুদন্ড, একটি দেশের হৃৎপিন্ড ও মুক্ত চিন্তার মাধ্যম। সংবাদপত্র শিল্পে বাংলাদেশ অনেক দূরে এগিয়ে গেছে। দেশে এখন বিপুল পরিমানে সংবাদপত্র প্রকাশিত হচ্ছে। বাংলাদেশে বর্তমানে গণ মাধ্যমের অবাধ স্বাধীনতা বিদ্যমান আছে। অতীতে গণ মাধ্যমের এত অবাধ স্বাধীনতা ছিলনা। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদ মতে, সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী হবেন।

২৮ (২) অনুচ্ছেদ মতে, রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী পুরুষের সমান অধিকারী হবেন। ৩৯ (১) অনুচ্ছেদে, চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে। ৩৯ (২) অনুচ্ছেদে, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্র সমূহের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা বা নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা নিষেধ সাপেক্ষে (ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক্ স্বাধীনতার অধিকারের এবং (খ) সংবাদ ক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হয়েছে।
সাংবাদিকরা জাতির বিবেক।

সাংবাদিকতা একটি মহৎ পেশা। অনেক বৈরী পরিস্থিতিতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাংবাদিকরা সংবাদ সংগ্রহ করে থাকেন। আদর্শবান সাংবাদিকরা সর্বদা সত্য প্রকাশে নির্ভীক। তারা লেখেন অসীম সাহসের সাথে। সংবাদপত্রে সাংবাদিকদের ক্ষুরদ্বার লেখনির প্রভাবে কিছুটা হলেও সমাজের দুর্নীতি, অনিয়ম, অবিচার ও অনাচার প্রশমিত হয়। প্রায় সময় দেখা যায়, সাংবাদিকতা পেশার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অনেকে মানহানির মামলার সম্মুখীন হতে হয়। সত্য, বস্তুনিষ্ঠ ও নিরপেক্ষ সংবাদ পরিবেশন করা সাংবাদিকদের পবিত্র দায়িত্ব।

আবার অনেক সাংবাদিক বা লেখক পবিত্র এ দায়িত্বকে অপবিত্র করতে দেখা যায়, কতেক অসাধু লেখক, তথাকথিত বুদ্ধিজীবি বা সাংবাদিক কোন তথ্য উপাত্ত বিহীন উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে বা অন্যের প্ররোচনায় বা অন্যায় লাভে লাভবান হয়ে কোন ব্যক্তি বা পরিবারের মান-সম্মানের ব্যাঘাত ঘটাতে অপচেষ্টা করেন। তৎকারণে মানহানির মামলা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছ্।ে সাংবাদিক বা লেখকরা বস্তুনিষ্ট ও তথ্যনির্ভর সংবাদ পরিবেশন করলে মানহানি মামলার বিড়ম্বনা এড়ানো সম্ভব।

অপরদিকে ব্যক্তি বিশেষ সাংবাদিক বা লেখককে হয়রানি করার হীন উদ্দেশ্যে বিজ্ঞ আদালতে মানহানি দায়ের করে থাকেন। অনেকের মানহানি মামলা সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা নেই। তাই এখানে মানহানির সংজ্ঞা,অপরাধ ও শাস্তি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোকপাত করা হলো।
১৮৬০ সালে দন্ডবিধি আইন প্রণীত হয়। এ আইনে বিভিন্ন অপরাধের দন্ড বা শাস্তির জন্য ২৩টি অধ্যায়ে সর্বমোট ৫১১টি ধারা সন্নিবেশিত রয়েছে।

দন্ডবিধি আইনের ২১ অধ্যায়ে ৪৯৯ হতে ৫০২ ধারায় মানহানির অপরাধের সংজ্ঞা ও শাস্তির বিষয়ে বর্ণিত হয়েছে। দন্ডবিধির ৪৯৯ ধারায় মানহানির সংজ্ঞা- যদি কোন ব্যক্তি অপর কোন ব্যক্তির খ্যাতি বা সুনাম নষ্ট করার উদ্দেশ্যে বা তার খ্যাতি বা সুনাম নষ্ট হবে বলে জানা সত্বেও বা তার বিশ্বাস করার কারণ থাকা সত্বেও কথিত বা পঠিত হওয়ার জন্য অভিপ্রেত কথা বা চিহ্ন দ্বারা বা দৃশ্যমান কল্প মূর্তির সাহায্যে সে ব্যক্তি সম্পর্কিত কোন নিন্দাবাদ প্রণয়ন বা প্রকাশ করে, তবে সে ব্যক্তি উক্ত অপর ব্যক্তির মানহানি করেছে বলে গণ্য হবে।

যে কার্য মানহানির আওতায় পড়বেঃ- (১) যে মৃত ব্যক্তির জীবনকালে তার সম্পর্কে কোন নিন্দা করা হলে তার মানহানি ঘটত, সে মৃত ব্যক্তি সম্পর্কে অনুরূপ কোন নিন্দাবাদ এবং সে মৃত ব্যক্তির পরিবার পরিজনের বা অন্যান্য নিকট আত্মীয়ের মনকে পীড়িত করার উদ্দেশ্য অনুরূপ নিন্দাবাদ করলে, (২) কোন কোম্পানি বা সংঘ ব্যক্তি সমাবেশ সম্পর্কে সমষ্টিগত ভাবে কোন নিন্দাবাদ করলে। (৩) বিকল্প বা বিদ্রুপ রূপে কোন নিন্দাবাদ করলে।

অত্র আইনের ৫০০ ধারার বিধান মতে, যদি কোন ব্যক্তি অপর কোন ব্যক্তির মানহানি করে, তবে উক্ত ব্যক্তি দুই বৎসর পর্যন্ত যে কোন মেয়াদের বিনাশ্রমে কারাদন্ডে অথবা অর্থদন্ডে বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবে। অত্র আইনের ৫০১ ধারা বিধান মতে, যদি কোন ব্যক্তি এমন কোন বস্তু মুদ্রণ করে যে বস্ত অপর কোন ব্যক্তির মানহানিকর বলে সে জ্ঞাত হয় বা তার বিশ্বাস করার সঙ্গত কারণ থাকে, তবে উক্ত ব্যক্তি দুই বৎসর পর্যন্ত যেকোন মেয়াদের বিনাশ্রমে কারাদন্ডে অথবা অর্থদন্ডে বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবে।

অত্র আইনের ৫০২ ধারা বিধান মতে, যদি কোন ব্যক্তি মুদ্রিত বা খোদাই করা এমন মানহানিকর বিষয় সম্বলিত কোন দ্রব্য বিক্রয় করে বা বিক্রয়ার্থে উপস্থাপন করে, যে মালিকের বস্তুটি সে দ্রব্যে আছে বলে সে জ্ঞাত হয়, তবে উক্ত ব্যক্তি দুই বৎসর পর্যন্ত যেকোন মেয়াদের বিনাশ্রমে কারাদন্ডে অথবা অর্থদন্ডে বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবে।

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন- ২০০৬ (সংশোধিত ২০১৩) এর ৫৭ ধারার বিধান মতে, যদি কোন ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোন ইলেকট্রিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন যা মিথ্যা, অশ্লীল,বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেউ পড়লে, দেখলে বা শুনলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হতে উদ্বুদ্ধ হতে পারেন বা যার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইন শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে, আইন শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করতে পারে বা এ ধরণের তথ্যাদির মাধ্যমে কোন ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উস্কানি প্রদান করা হয়, তবে সে ব্যক্তি অনধিক ১৪ বৎসর কারাদন্ডে অন্যুন্য ০৭ বৎসর কারাদন্ডে বা অনধিক ১ কোটি টাকা অর্থদন্ডে দন্ডিত হবেন। এ ধারার অপরাধ সমূহ আমলযোগ্য ও অ-জামিনযোগ্য।

সততা ও নিষ্টা একজন সাংবাদিকের আদর্শ হলেও, কিছু সংখ্যক তথাকথিত সাংবাদিকের কারণে এ পেশার সুনাম ক্ষুন্ন হচ্ছে। ইদানিং অনেক খ্যাত, অখ্যাত ইলেকট্রিক মিডিয়া, প্রিন্ট মিডিয়া বা অনলাইন মিডিয়া ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে। স্বল্প শিক্ষিত, অর্ধ শিক্ষিত কতেক ব্যক্তি অখ্যাত কিছু ইলেকট্রিক মিডিয়া, প্রিন্ট মিডিয়া বা অনলাইন পত্রিকার পরিচয় পত্রের ব্যবহারের মাধ্যমে বিভিন্ন স্থানে নিজেকে বড় সাংবাদিক হিসেবে জাহির করে এবং তারা সাংবাদিক পরিচয়ে বিভিন্ন ধরণের অপরাধ সংঘটন করছেন।

তাদের দৌরাত্মে প্রথিতযশা, সৎ, নীতিবান ও আদর্শবান সাংবাদিকদের সুনাম ক্ষুন্ন হচ্ছে। নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ট সাংবাদিকতার মাধ্যমে সমাজ, দেশ ও জাতির কল্যাণ করা যায়। সাংবাদিক মহল থেকে তথ্যনির্ভর, নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ সচেতন পাঠক সমাজ অবশ্যই প্রত্যাশা করেন।
লেখকঃ রাজনীতিবীদ, সংগঠক ও কলামিষ্ট

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.