চট্টগ্রামের চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ ধ্বংসের পথে

0

জুবায়ের সিদ্দিকী-

বার আউলিয়ার স্মৃতি বিজড়িত পুন্যভুমী চট্টগ্রাম দেশের ব্যবসা বানিজ্য ও আমদানী-রপ্তানীর প্রসিদ্ধ স্থান হিসেবে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলেও ব্যাপক পরিচিত। এই চট্টগ্রামের ব্যবসা বানিজ্যের খ্যাতির পেছনে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে চাক্তাই ও খাতুনগঞ্জের নাম। কর্ণফুলী নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে উঠা ব্যবসা বানিজ্যের প্রাণকেন্দ্র চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। সাম্প্রকিত বছরগুলোতে এসব এলাকায় জলাবদ্ধতার কারনে ব্যবসা-বানিজ্যে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে।

অনেক ব্যবসায়ী লোকসান গুণে দেওলিয়া হয়ে গেছেন। অনেকে মুখ ফিরিয়ে অন্য ব্যবসায় চলে গেছেন। ওয়াল ষ্ট্রিট খ্যাত এই বানিজ্য কেন্দ্র এখন নানা সমস্যায় ধুঁকছে। কর্নফুলীর তীর ঘেঁষেই এখানকার ব্যবসা-বানিজ্য গড়ে ওঠে। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে সারাদেশের ব্যবসা বানিজ্য চাক্তাই খাতুনগঞ্জের মাধ্যমে প্রচলন শুরু হয়। সেই মোগল ও নবাবী আমল থেকে শুরু হয়ে এখনো খাতুনগঞ্জের নামড়াক রয়েছে। তবে কালের পরিক্রমায় স্বকীয়তা ও ঐতিহ্য হারাতে বসেছে।

ষোড়শ শতকের মাঝামাঝি শুরুতে গৌড়ের সুলতান মাহমুদ শাহর আমলে পর্তুগীজ বণিকদের মাধ্যমে এ জনপদে ব্যবসা বানিজ্যের প্রচলন শুরু হয়। কর্ণফুলীর তীরে গড়ে ওঠা পোতাশ্রয় বা চট্টগ্রাম বন্দর বাণিজ্য নতুনমাত্র রুপ দেয়। পর্তুগীজদের পথ ধরে ইংরেজ, ওলন্দাজ, ফরাসি, আরমেনিয় প্রভৃতি দেশের বণিকরা এ দেশের সাথে নৌপথে বাণিজ্য শুরু করে। কালক্রমে চট্টগ্রাম হয়ে উঠে বানিজ্য নগরী। নৌপথে সহজ যোগাযোগের কারনে চাক্তাই খাতুনগঞ্জ ব্যবসা বানিজ্যের পাদপীঠ হয়ে উঠে। সারাদেশের ব্যবসা বানিজ্য এখান থেকে পরিচালিত হয়ে আসছিল। মুলত চাক্তাই ও রাজাখালী খালের তীরে এই বাণিজ্যকেন্দ্র গড়ে উঠে। বানিজ্যের প্রধান মাধ্যমে খাল দুটি অব্যাহত দখল দুষণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। বর্তমানে খাল দুটির এক তৃতীয়াংশ বেদখল হয়ে গেছে। কর্ণফুলী নদীর তীরে খাতুনগঞ্জের ব্যবসা-বানিজ্য প্রচলন শুরু হয় বলে প্রবীণ ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন।

হামিদুল্লাহ খাঁ খাতুনগঞ্জ বাজারটি প্রতিষ্টা করেন। কর্নফুলী নদীর তীরে বাজারটি অবস্থিত। নৌপথে দেশ বিদেশের বণিকরা নৌকা-সাম্পান নিয়ে মালামাল উঠানামা করতেন। তাই বিবি খাতুনের নামের সাথে গঞ্জ সংযোজিত হয়ে খাতুনগঞ্জে রুপ নেয়। অপরদিকে ভৌগোলিক অবস্থার কারনে কর্ণফুলী নদীর চাক্তাই খালকে ঘিরে বাণিজ্যের প্রসারতা ঘটে। খাতুনগঞ্জ ছাপিয়ে চাক্তাই এলাকায়ও ব্যবসা-বানিজ্যের প্রচলন ও বিস্তার লাভ করে।

কালক্রমে তা কোরবানীগঞ্জ, আছদগঞ্জ ও আশপাশের এলাকায় বিস্তিৃতি পায়। সারাদেশের ব্যবসায়ীরা চাক্তাই ও খাতুনগঞ্জ এলাকাকে যুক্তরাজ্যের ওয়াল ষ্ট্রিট এর ব্যবসাবানিজ্যের তীর্থভুমিতে পরিণত করেছে। মুলত নবাবী আমলে কর্নফুলী নদী তীরে খাতুনগঞ্জ ও চাক্তাই এলাকায় বানিজ্য কেন্দ্র গড়ে বলে জানিয়েছেন প্রবীনরা। শুরুর দিকে নদীপথে বানিজ্য চলে আসলেও পরবর্তীতে গরুর গাড়ি, ঠেলাগাড়ির প্রচলন শুরু হয়। সড়ক পথের উন্নয়নের পর কদর কমে আসে ঠেলাগাড়ি ও গরুরগাড়ির। ট্রাক, মিনি ট্রাকে পন্য পরিবহনের প্রচনতা বেড়ে যায়। এখনো প্রতিদিন পন্যবাহী শত শত ট্রাক আসা যাওয়া করে। হাজার হাজার ব্যবসায়ী শ্রমিকের কোলাহলে মুখরিত থাকে এ বানিজ্যিক পাড়া।

চাক্তাই খাতুনগঞ্জ জলাবদ্ধতার শিকার
চাক্তাই খাতুনগঞ্জ জলাবদ্ধতার শিকার

তবে নৌপথে এখনো মালামাল পরিবহন হয়ে আসছে এ বানিজ্যপাড়ায়। দেশের বিভিন্ন নৌকায় মালামাল আনা নেওয়া হয়। বৃটিশ পাকিস্তান আমলেও ব্যবসা বানিজ্যের প্রসারতা লাভ করে। পাথরঘাটা ও খাতুনগঞ্জের লামারগঞ্জ এলাকায় বড় বড় নৌকা ভিড়ত। শত শত বনিকের পদচারনায় মুখরিত থাকত এই গঞ্জ। পাকিস্তান আমলে বাংলাদেশের আমদানী বানিজ্যের শতকরা ৯০-৯৫ ভাগই খাতুনগঞ্জ চাক্তাই এলাকা থেকে পরিচালিত হত।

গরুর গাড়ি ও পালতোলা নৌকা-সাম্পানযোগে মালামাল পরিবহন করা হত। সেই চাক্তাই খাতুনগঞ্জ এখন প্রতিবছর জলাবদ্ধতার শিকার। জলাবদ্ধতা এই বানিজ্যপাড়ার জন্য এখন অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ দুর্বিপাক ছাড়াই জোয়ারের পানিতে ডুবে যাচ্ছে চাক্তাই খাতুনগঞ্জ। কয়েক বছর ধরে এখানে সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। বর্তমানে তা প্রকট আকার ধারন করেছে। এতে ব্যবসায়ীদের বড় ধরনের ক্ষতি গুনতে হচ্ছে। বিগত দুই বছর ঘুর্নিঝড়ে সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় দুইশ কোটি টাকার মালামাল নষ্ট হয়ে গেছে। এতে বড় ক্ষতি গুনতে হয়েছে ব্যবসায়ীদের। ব্যবসায়ীরা জানায়, ক্যাপিটাল ড্রেজিং এর মাটিতে কর্নফুলী নদীর চাক্তাই ও রাজাখালী খালের মোহনা দীর্ঘদিন ধরে ভরাট হয়ে রয়েছে। একই কারনে তৃতীয় কর্নফুলী সেতুর গোড়ায় নদীর এক তৃতীয়াংশ ও মাটি, পলি জমে ভরাট হয়ে গেছে।

এতে জোয়ারের পানি প্রবাহ বাধা পেয়ে চাক্তাই খাতুনগঞ্জে ঢুকে পড়েছে। ঘুর্নিঝড় রোয়ানুতে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে দোকানপাট, ব্যবসায়ী প্রতিষ্টান ও গুদামে পানি ঢুকে শত কোটি টাকার পন্য নষ্ট হয়ে যায়। গত বছর কোমেনের আঘাতে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসেও একই পরিমান ক্ষতি গুনতে হয়েছিল ব্যবসায়ীদের। বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়াও গত ঈদের আগে ও পরে জোয়ারে ডুবেছে চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জলোচ্ছ্বাস ও জোয়ারের পানিতে এভাবে বার বার ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পেতে ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছে।

গত বছরের মে মাসে সিটি মেয়রকে ১০ দফা দাবী নিয়ে স্মারকলিপি দিয়েছে খাতুনগঞ্জ ট্রেড এন্ড ইন্ডাষ্ট্রিজ এসোসিয়েশন। এর মধ্যে অন্যতম দাবী ছিল, চাক্তাই, রাজাখালী, রাজাখাল খনন করে পুর্বাবস্থায় ফিরে আনা, খালের মুখে স্যুইচ গেইট স্থাপন, মেরিন ড্রাইভ সড়ক নির্মান ও কর্নফুলী সেতু এলাকায় নদী খনন করা। কিন্তু সেসব দাবী এখনো উপেক্ষিত রয়ে গেছে। উপরন্তু চাক্তাই খালের মুখে কর্নফুলী নদীর চরে বিশাল এলাকাজুড়ে স্থাপন করা হয়ে পাইকারী মৎস্য বাজার। পুরনো ফিশারীঘাট উচ্ছ্বেদ করে ব্যবসায়ীদের জোরপুর্বক নতুন মৎস্যবাজারে দোকান কিনতে বাধ্য করা হয়েছে।

যারা অর্থের অভাবে কিনতে পারেননি সেই দরিদ্র জেলে সম্প্রদায় পথে বসেছে। এই অপকর্মের নেপথ্যে সহায়তা দিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। নদী খনন করে বন্দর রক্ষা করাই যাদের লক্ষ্য হওয়া প্রয়োজন, সেই বন্দরই নদী দখলের সাহায্যকারী! ব্যবসায়ীদের দাবী, চাক্তাই খাতুনগঞ্জের ৭ হাজার ব্যবসায়ী প্রতিষ্টান রয়েছে। দুই থেকে আড়াই হাজার দোকান ও গুদাম জোয়ারের পানিতে ডুবে যায়। এ অবস্থায় খালের মুখে নির্মিত পাইকারী মৎস্যবাজারটি ব্যবসা বানিজ্যের তীর্থস্থানটি ধব্বংস ত্বরান্বিত করবে। খাল খননের উদ্যোগ না নিলে এবং খালের উপর অবৈধভাবে নির্মিত স্থাপনা উচ্ছ্বেদ না করলে এ চাক্তাই খাতুনগঞ্জ এলাকার ব্যবসাবানিজ্যে সহসাই লালবাতি জ্বলবে। এসব এলাকার জলাবদ্ধতা স্থায়ী রুপ নিতে পারে।

বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও প্রবীন আওয়ামী লীগ নেতা আলহাজ্ব নুরুল আমিন শান্তি বলেন,’ চাক্তাই খাতুনগঞ্জ এলাকার ব্যবসায়ীদের দু:খ, কষ্ট দেখার কেও নেই। প্রতিবছর জলাবদ্ধতার কারনে হাজার কোটি টাকার সম্পদহানি হয়। দুয়েক ঘন্টার পানিতে কোমর পরিমান পানি জমে থাকে। এ অবস্থায় চাক্তাই খালের মুখের পাশে নির্মিত মৎস্যবাজার বিপর্যয় ড়েকে আনবে।

ব্যবসায়ীরা ইতিমধ্যে চাক্তাই খাতুনগঞ্জের উপর থেকে চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। চট্টগ্রামের ইতিহাস ঐতিহ্যজুড়ে নদী কেন্দ্রীক ব্যবসা বানিজ্য এখন প্রায় নেই বললেই চলে। একই বক্তব্য চট্টগ্রাম চাল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি বাবু শান্তদাশগুপ্তের। বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও আওয়ামী লীগ নেতা বাবু শান্তদাশ গুপ্ত বলেন, জরুরী ভিত্ত্বিতে চাক্তাই ও রাজাখাল খনন ও অবৈধ উচ্ছ্বেদ করে পানিপ্রবাহ সচল করা না হলে আগামী বর্ষায় স্থায়ী বিপর্যয় নেমে আসতে পারে।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.