গণপরিবহনে তীব্র ভোগান্তি: নারীরা নাজেহাল

0

সিটিনিউজ ডেস্ক::গত পাঁচ দিনে রাজধানীর গণপরিবহণে গণভোগান্তি চরমে উঠেছে। বিষয়টি সুরাহার জন্য আজ বুধবার বিকালে সরকারের সাথে পরিবহন মালিক সমিতির বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, গণভোগান্তির জন্য দায়ীদের চিহ্নিত না করে ব্যবস্থা না নিলে জনভোগান্তিই শুধু বাড়বে না, যাত্রীভাড়াও বাড়বে। কারণ সিটিং সার্ভিস বন্ধ করা হলেও যাত্রীভাড়া কমানো যায়নি। পরিবহন মালিকরা এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ভাড়া ভাড়ানোর জন্য জনভোগান্তির পথ বেছে নিয়েছেন।

রাজধানীর বিভিন্ন রুটে সিটিং সার্ভিস, গেইট লক, বিরতিহীন কিংবা স্পেশাল সার্ভিস বন্ধের নির্দেশনা রবিবার থেকে কার্যকর হয়েছে। ফলে গাদাগাদি, ঠাসাঠাসি করে গাড়িতে যাত্রী উঠাচ্ছেন বাসের ড্রাইভার-হেলপাররা। আর যাত্রী টইটুম্বর না হওয়া পর্যন্ত গাড়ি ছাড়া হচ্ছে না। আবার বেশি যাত্রী যেন দাঁড়াতে পারে সেজন্য বেশ কিছু সিট সরিয়ে ফেলা হয়েছে। অথচ ভাড়া নেয়া হচ্ছে আগের সেই সিটিং সার্ভিসের মতোই। এসব নৈরাজ্যে সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী নারী যাত্রীরা। ধাক্কাধাক্কির মাঝে কেউ কেউ বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে যাচ্ছেন, কেউ বা আবার গাড়িতে উঠতে গিয়ে পড়ে গিয়ে দুর্ঘটনায় আহত হচ্ছেন।

এদিকে সিটিং থেকে লোকালে রূপান্তরিত হওয়ায় তাদের সঙ্গে আগে থেকেই লোকাল চালানো বাস কর্মচারীদের দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করেছে। ফলে বর্তমানে গণপরিবহনে আরও বেশি নৈরাজ্য শুরু হয়েছে। আর এতে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে নারী যাত্রীদের। বাসে সিট তো দূর দাঁড়ানোর মতো জায়গাও পাচ্ছেন না তারা। অথচ ভাড়া নেয়া হচ্ছে আগের সেই সিটিং সার্ভিসের মতোই। আবার দুই/একটা গাড়ি নামে মাত্র ভাড়া কমালেও ভেতরের সব জায়গা পূর্ণ হওয়ার পর গেটেও কয়েকজনকে বাদুরের মতো ঝুলিয়ে নিচ্ছে।

এছাড়া সিটিং সার্ভিস আর লোকাস সার্ভিস নাটকে রাস্তায় গাড়িও কম নামানো হচ্ছে। এতে যাত্রীদের ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। বিশেষ করে নারী যাত্রীদের ভোগান্তির মাত্রা সীমাহীন।

রাজধানীর শাহবাগ, ফার্মগেট, আগারগাঁও, মিরপুর, টেকনিক্যাল মোড়, মহাখালী, কাকরাইল মোড়, পল্টন মোড়, বাড্ডা এলাকায় দেখা গেছে নারী যাত্রীদের ভোগান্তির এই চিত্র। এছাড়া অন্য যাত্রীদেরও হয়রানি করা হচ্ছে নানাভাবে।

এই সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) বিভিন্ন প্রতিশ্রুতিও বাস্তবায়ন হচ্ছে না।

অভিযোগ রয়েছে, বাস-মিনিবাসের জন্য যাত্রীদের অপেক্ষায় থাকতে হবে না, ভাড়া কমে যাবে- এমন আশ্বাস দিয়ে মালিক সমিতি সিটিং সার্ভিস বন্ধের ঘোষণা দিলেও সেই মালিকেরাই এখন তা মানছেন না। সাধারণ যাত্রী ও যাত্রী অধিকার নিয়ে কাজ করে এমন ব্যক্তিদের অভিযোগ, এই জনভোগান্তির নেপথ্যে রয়েছেন মালিক-শ্রমিক সমিতির সঙ্গে যুক্ত কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা।

৪ এপ্রিল মালিক সমিতি সিটিং সার্ভিস বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৫ এপ্রিল থেকে যা কার্যকর হয়। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে মাঠে নামেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) ভ্রাম্যমাণ আদালত। তবে এ বিষয়ে বিআরটিএর কোনো পূর্ব প্রস্তুতি ছিল না বলে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। সূত্র বলছে, ১৫ এপ্রিল বিকেলে এক বৈঠক করে বিআরটিএ জানিয়ে দেয়, মালিক সমিতির সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে তারা ঢাকায় পাঁচটি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করবে। অভিযান শুরুর পর অনেক মালিক বাস-মিনিবাস চালানো বন্ধ করে দেন। পাশাপাশি তাঁরা ঠাসাঠাসি করে যাত্রী নিয়ে সিটিং সার্ভিসের ভাড়াও আদায় করছেন।

মঙ্গলবার সচিবালয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের কাছে বাস-মিনিবাসে মানুষের ভোগান্তির বিষয়টি উল্লেখ করে নিজের অসহায়ত্বের কথাই জানান। তিনি বলেন, ‘কেউ নানা অজুহাতে যদি গাড়ি না চালায়, আমরা কি আমাদের দেশের বাস্তবতায় জোর করে গাড়ি নামাতে পারব? আর গাড়ির সঙ্গে যারা জড়িত, তারা খুব সামান্য মানুষ না, তারা অনেকেই খুব প্রভাবশালী।’ মন্ত্রী স্বীকার করেন, ব্যস্ত সময়ে যে পরিমাণ বাস-মিনিবাস চলে, সে তুলনায় কম চলছে। জনগণের দুর্ভোগ ও কষ্ট হচ্ছে। মন্ত্রী বলেন, আজ বুধবার এ বিষয়ে পর্যালোচনা সভা হবে।

বিআরটিএ সূত্র বলছে, আজ বিকেলে মালিক-শ্রমিকনেতা ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠক হবে। এরপর বিভিন্ন বাস-মিনিবাস কোম্পানির মালিকদের নিয়ে বৈঠক করা হবে।

মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলো অতীতেও নানা দাবি আদায়ে ধর্মঘট ডেকে জনগণকে জিম্মি করেছে। চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব তারেক মাসুদ, সাংবাদিক মিশুক মুনীরসহ পাঁচজনের প্রাণহানির ঘটনায় গত ফেব্রুয়ারিতে বাসচালক জামির হোসেনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন আদালত। এর প্রতিবাদে নৌপরিবহনমন্ত্রীর বাসায় বসে মালিক-শ্রমিকনেতারা ধর্মঘটের ডাক দিয়ে ঢাকাসহ সারা দেশ অচল করে দেন।

সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের কিছু কর্মকর্তা এবং যাত্রী অধিকার নিয়ে কাজ করেন এমন কয়েকজনের সন্দেহ, মালিকদের সিটিং সার্ভিস বন্ধের সিদ্ধান্ত মূলত বাস-মিনিবাসের ভাড়া বাড়িয়ে নেয়ার কৌশল। কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে গত চার দিন যত্রতত্র (লোকাল) বাস থামিয়ে গাদাগাদি করে যাত্রী তুলে সিটিং সার্ভিসেরই ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। কিছুদিন পর হইচই থেমে গেলে ভাড়া বাড়িয়ে কিছু পরিবহন কোম্পানি পুনরায় সিটিং সার্ভিসে চলা শুরু করবে। কারণ সিটিং সার্ভিসেরও চাহিদা আছে। অতীতে ভাড়া বৃদ্ধির জন্য লোকাল বাস-মিনিবাসকে সিটিংয়ে পরিণত করা হয়েছে। এবার সিটিংকে লোকাল করে সব বাসেরই ভাড়া বাড়িয়ে নেয়া হয়েছে। বিআরটিএ মালিকদেরই ফাঁদে পা দিয়েছে। এবারও সিটিং সার্ভিস ইস্যুতে জনভোগান্তির পেছনে সরকারি দলের প্রভাবশালী কয়েকজন নেতার ভূমিকার বিষয়টি আলোচনায় রয়েছে।

সিটিং সার্ভিস মোটরযান আইনে নেই। আইন প্রণয়নের দায়িত্ব সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় ও বিআরটিএর। আর আইন প্রয়োগের দায়িত্ব পুলিশ ও বিআরটিএর। কিন্তু অতীতে সেই আইন প্রয়োগ হয়নি।

বিআরটিএ, যাত্রী কল্যাণ সমিতি ও সাধারণ মালিকদের তথ্যমতে, দু-তিন দিন ধরে ঢাকায় চলাচলকারী বাস-মিনিবাসের ৪০ শতাংশ বন্ধ রাখা হয়েছে। এর মধ্যে আজিমপুর থেকে গাজীপুর পথে চলাচলকারী ভিআইপি পরিবহনের অধিকাংশ বাস-মিনিবাসই বন্ধ। সিটিং সার্ভিস নাম দিয়ে চলা এই বাসে উঠলেই যাত্রীকে ৫০ টাকা গুনতে হয়।

যাত্রী অধিকার নিয়ে কাজ করে এমন ব্যক্তিদের ভাষ্য, দীর্ঘদিন ধরেই ঢাকায় সিটিং সার্ভিস নাম দিয়ে বাড়তি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। মেশকাত, সুপ্রভাত, গাজীপুর পরিবহন, লাব্বাইক পরিবহন একাধিকবার লোকাল থেকে সিটিং এবং সিটিং থেকে লোকালে পরিবর্তন করা হয়েছে। কেরানীগঞ্জ থেকে মিরপুর চিড়িয়াখানা পর্যন্ত চলে দিশারী পরিবহন। এই কোম্পানির বাসে কেরানীগঞ্জ থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত যত্রতত্র যাত্রী তোলা হয়। গুলিস্তান থেকে আবার সিটিং হয়ে যায়। এভাবে একেক সময় একেক ব্যবস্থায় চলে ঢাকার পরিবহন।

ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির সাধারণ সম্পাদক খোন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, ‘যাত্রীদের সুবিধার কথা ভেবেই আমরা সিটিং সার্ভিস বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কদিন সময় দিলে ঠিক হয়ে যাবে।’ তিনি আরও বলেন, গণমাধ্যমে সিটিং সার্ভিসের বিরুদ্ধে লেখালেখির কারণেই তাঁরা তা বাতিলের সিদ্ধান্ত নেন। এখানে সন্দেহ করার কোনো বিষয় নেই। সবার সহযোগিতা পেলে শৃঙ্খলায় চলে আসবে।

অবশ্য পরিবহন মালিকেরা যখন যা খুশি তা করেন বলে দাবি বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরীর। তিনি বলেন, এবার ভাড়া কমানোর কথা বলে সিটিং সার্ভিস বন্ধ করা হয়েছে, কিন্তু ভাড়া কমেনি। উল্টো যাত্রীদের মারধর ও বাস থেকে জোর করে নামিয়ে দেয়ার ঘটনা ঘটেছে। সরকার ও গণমাধ্যম কয়েক দিন হইচই করে থেমে যাবে। একপর্যায়ে যাত্রীরা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হবে। মনে হচ্ছে, এটাই মালিকদের উদ্দেশ্য।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.