চট্টগ্রাম পরিণত হচ্ছে জলাবদ্ধ নগরী, ঝুঁকির মুখে ৪২ লাখ মানুষ

0

জুবায়ের সিদ্দিকী::এখনো বর্ষাকাল বেশ দুরে থাকলেও চৈত্রের আগাম বর্ষণে বন্দরনগরী চট্টগ্রামে বিস্তীর্ণ সড়ক, অলিগলি পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে সর্বমহলে উদ্বেগ উৎকন্ঠা ছড়িয়ে পড়েছে। শুক্রবার(২১ এপ্রিল) সকাল ছয়টা থেকে ১২ টা পর্যন্ত ৬২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতে শহরের অধিকাংশ এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। এতে চরম দুর্ভোগে পড়ে নগরবাসী। অধিকাংশ বাসাবাড়ির নীচতলায় ও দোকানপাটে পানি ঢুকে ভোগান্তি চরমে উঠেছে। অনেক দোকানের মালামাল নষ্ট হয়ে গেছে।
মাঝারি বর্ষনেই নাগরিক জীবনের যে নাজুক অবস্থা হয়েছে আগামী বর্ষায় এর চেয়েও তীব্র জলাবদ্ধতার দু:সহ বিড়ম্বনার আশঙ্খা করছেন নগরবাসী। পরিস্থিতি উত্তরনে চাক্তাই খালসহ নগরীর খালগুলো দ্রুত খনন ও নালার গভীরতা বাড়ানোর উপর জোর দিয়েছেন নাগরিকরা।

চসিকের মতে, জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি দিতে অস্থায়ী ব্যবস্থা হিসেবে বিভিন্ন সড়ক উচুকরন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। কিন্তু এক এলাকার সড়ক উচু করলেই নতুন করে অন্য এলাকা পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক মধ্য চৈত্রের দুই ঘন্টার বর্ষনে নগরীর আগ্রাবাদ বানিজ্যিক এলাকা, এক্সেস রোড, ছোটপুল, শান্তিবাগ, সিডিএ আবাসিক এলাকা, বেপারী পাড়া, মুহুরী পাড়া, সিজিএস কলোনী. হালিশহর হাউজিং এষ্টেট, মুরাদপুর, বাদুরতলা, কাপাসগোলা, বাকলিয়া, চকবাজার কাঁচাবাজার, কাতালগঞ্জ, বহদ্দারহাট, চান্দগাঁও, নাছিরাবাদ, পতেঙ্গা, দেওয়ানবাজার ও কালুরঘাট শিল্পাঞ্চল সহ বিস্তীর্ন এলাকা তলিয়ে যায়।
এবারের বর্ষনে যে সব স্থানে কোনদিন পানি উঠেনি সে ধরনের অনেক এলাকায়ও নালা উপচে সড়কে পানি গড়িয়ে যেতে দেখা গেছে। অপরদিকে, মুরাদপুর ফ্লাইওভারের নির্মান কাজ এবং নিচের সড়ক প্রশস্তকরন কাজে বিভিন্ন ভবন ভেঙ্গে ফেলায় নগরীর প্রধান সড়কে জলাবদ্ধতার পাশাপাশি তীব্র যানজটও সৃষ্টি হয়। এ সময় নগরবাসীকে অবর্ননীয় দুর্ভোগের মুখোমুখি হতে হয়।


নগরীর বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারা জানান, নালা নর্দমাগুলোর মাটি উত্তোলনের পর তা অন্যত্র সরিয়ে না নিয়ে শুকানোর নাম করে সড়কের পাশে ফেলে রাখা হয়। ফলে তা ধুলো আকারে আবার নালায় গিয়ে পড়ছে। এর মধ্যে বৃষ্টি হলে তা সরাসরি নালায় জমা হয়। এ কারনে নালাগুলো ভরাট হয় বৃষ্টির পানি দ্রুত সড়কে উঠে যাচ্ছে। এদিকে চৈত্রের সামান্য বর্ষনে নাগরিক জীবনে এমন নাজুক পরিস্থিতি চট্টগ্রামবাসীকে ভাবিয়ে তুলেছে।
গত কয়েক বছরে বৃষ্টিপাতের পাশাপাশি জোয়ারের পানিতে তলিয়ে দেশের প্রধান বানিজ্যিক কেন্দ্র চাক্তাই খাতুনগঞ্জে কোটি কোটি টাকার মজুদ পণ্য নষ্ট হওয়ায় উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে ব্যবসায়ীদের মাঝে।
সম্প্রতি চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে চাক্তাই খাতুনগঞ্জ আড়তদার সাধারন ব্যবসায়ী কল্যান সমিতি চাক্তাই খাল খনন ও জলাবদ্ধতা নিরসন করে ব্যবসায়ীদের রক্ষার দাবী জানিয়েছেন। ব্যবসায়ীদের দাবী.’ দেশের অন্যতম প্রধান বানিজ্যিক কেন্দ্র চাক্তাই খাতুনগঞ্জ চরম অবহেলিত। আমরা আজ অস্তীত্ব সংকটে। বৃষ্টির কারনে জলাবদ্ধতা তো আছেই। এর সাথে কয়েক বছর ধরে যোগ হয়েছে মওসুমি জোয়ারের পানি। জোয়ারের পানি ব্যবসা প্রতিষ্টানে ঢুকে ব্যবসায়ীদের কোটি কোটি টাকার পন্য ক্ষতিগ্রস্থ করে। ফলে ব্যাংকের ঋন শোধে ব্যবসায়ীরা ব্যর্থ হন। শুষ্ক মওসুমে জলাবদ্ধতা নিরসনে কাজ শুরু করার আশ্বাস দেয়া হলেও এখন পর্যন্ত তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ দেখা যায়নি। ২০০৮ সালে জাতীয় নির্বাচনের পুর্বে লালদীঘির ময়দানে আয়োজিত মহাসমাবেশে প্রধানমন্ত্রী নিজেই চট্টগ্রামের উন্নয়নের দায়িত্ব কাঁধে নেয়ার কথা ঘোষণা করেছিলেন, কিন্তু সারা দেশের পাইকারী ও খুচরা ব্যবসার প্রাণকেন্দ্র চাক্তাই খাতুনগঞ্জ কেনই বা এত অবহেলিত, এ অবহেলার নেপথ্যে কারন কী, কার স্বার্থে কে এই চট্টগ্রামকে কোনঠাসা করে রখেছে এসব আকার আমরা অবগত নই। অথচ চট্টগ্রাম বাঁচলেই দেশ বাঁচবে এ কথা সবার জানা। চট্টগ্রাম নাগরিক অধিকার ফোরামের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে,’ চট্টগ্রামের মৌলিক সমস্যার একটি হচ্ছে এ জলাবদ্ধতা। সামান্য বৃষ্টিতেই চট্টগ্রাম শহরের বেশিরভাগ এলাকা কাদাপানিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। দুই ঘন্টার সামান্য বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতার কারনে রাস্তাঘাটের চিত্র দেখলেই অনুমান করা যায় কি পরিমান ক্ষতি হয়েছে। চাক্তাই খালের আশপাশের এলাকার মানুষের দীর্ঘদিনের দাবী অবিলম্বে অবৈধ দখলদারদের কাছ থেকে খাল উদ্ধারের মাধ্যমে খাল খননের উদ্যোগ না নিলে দুর্ভোগ কেবল বাড়বে।
নগরীর বহদ্দার হাট থেকে আরেকটি খাল খননের উদ্যোগও নিয়েছিল সিটি কর্পোরেশন। কিন্তু তার কোন বাস্তবায়ন দীর্ঘ এক বছরেও পরিলক্ষিত হয়নি। অন্যদিকে অভিযোগ উঠেছে, চাক্তাই খালের মুখসংলগ্ন কর্নফুলীর চরে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ পাইকারী মৎস্য বাজার তৈরী করেছে। এতে সহযোগিতা করেছে খোদ সিটি কর্পোরেশন। আত্মঘাতী এ সিদ্ধান্তের কারনে চাক্তাই খালের পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। ভরাট হয়ে ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে এ খাল।
স্থানীয়দের অভিযোগ মতে,’বন্দরের দায়িত্ব হচ্ছে নদী খনন ও নৌ-যান চলাচল নির্ভিগ্ন করা। আর সিটি কর্পোরেশনের দায়িত্ব নগরীর নালা নর্দমা পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করা, মাটি অপসারন, খালের গভীরতা বৃদ্ধির মাধ্যমে পানি চলাচল সচল রাখা। অথচ সরকারের এই দুটি সংস্থা, উল্টোপথে হাটছেন। আগ্রাবাদ ও বৃহত্তর হালিশহর বাসীর দীর্ঘদিনের প্রানের দাবী ছিল মহেশখালের মুখে স্ল্যুইচ গেইট নির্মান। গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে জনগনের দাবীর মুখে স্যুইচ গেইট নির্মানের ভিত্তিপ্রস্তর করেন নৌ-পরিবহন মন্ত্রী শাহজাহান খান। এতে উপস্থিত ছিলেন মেয়র আ.জ.ম নাছির উদ্দিন ও স্থানীয় সংসদ সদস্য এম.এ লতিফ। বন্দরের কলোনী সংলগ্ন মহেশখালে একটি অস্থায়ী বাঁধ নির্মানও করা হয়। এ অস্থায়ী বাঁধ নির্মানের ফলে আগ্রাবাদ অঞ্চলে জলাবদ্ধতা কিছুটা কমে আসলেও এক পর্যায়ে দীর্ঘমেয়াদী জলাবদ্ধতার মুখে পড়ে বিশাল এলাকার মানুষ। অপরদিকে এই অস্থায়ী বাঁধ নির্মানের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাবাসি আন্দোলন শুরু করে।
সকল মহলের একমাত্র প্রানের দাবী ছিল, ’মহেশখালের মুখে স্যুইচ গেইট নির্মান’ করতে হবে। এতে করে কোন এলাকা প্লাবিত হবার সম্ভাবনা থাকবে না। অপরদিকে মহেশখালের, আশপাশের এলাকার জনসাধারনের মতে, মহেশখালের মাঝখানে বন্দর রিপাবলিক ক্লাব সংলগ্ন অস্থায়ী বাঁধ নির্মানের ফলে গোটা মহেশখাল এখন ভরাট হয়ে মাঝখানে গাছপালা গজিয়ে উঠেছে। জমাট বাধা ময়লা আবর্জনার দুর্ঘন্ধে এসব এলাকার বাড়িঘরের দরজা জানালা বন্ধ রাখতে হয়। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে মশার উপদ্রুব। জলাবদ্ধতা বন্দরনগরী চট্টগ্রামের একটি দুর্বিষহ সমস্যা।
এক গবেষনায় জানা যায়, ৪০-৪৫ লাখ জনগোষ্টির মধ্যে ১২ লাখ মানুষ প্রতি বছর বর্ষায় অবর্ননীয় দুর্ভোগে ভোগান্তিতে পড়েন। এটিকে চট্টগ্রামের নাগরিক জীবনের মারাত্বক ব্যাধি হিসেবে উল্লেখ করা যায়। বৃষ্টির পানিতে প্রতি বছর বর্ষায় নগরীর নির্মাঞ্চল প্লাবিত হয়। অসংখ্য ঘরবাড়ি, দোকান পাটে পানি ঢুকে ব্যাপক ক্ষতি ও দুর্ভোগের সৃষ্টি হয়। অফিস-আদালত. ব্যবসা বানিজ্য, শিক্ষা প্রতিষ্টান স্থবির হয়ে যায়। চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতার অন্যতম প্রধান কারন হচ্ছে, খাল ও নালা নর্দমা ভরাট ও দখল হয়ে যাওয়া। এ ক্ষেত্রে খাল ভরাট হয়ে যাওয়ার নেপথ্যে নগরীর আবর্জনা যেমন রয়েছে, তার চেয়ে বেশি দায়ী পাহাড় বেয়ে আসা মাটির শ্রোত। নি:সন্দেহে এটি একটি প্রাকৃতিক সমস্যা, যা নগরবাসী বয়ে বেড়াচ্ছে। এ ছাড়া নগরজুড়ে অপরিকল্পিত ড্রেনেজ ব্যবস্থা এবং যত্রতত্র ভবন নির্মানও কম দায়ী নয়। চট্টগ্রাম নগরীতে ছোট বড় ১১৮টি খাল রয়েছে। ১৮২ কিলোমিটার দীর্ঘ এসব খালের মধ্যে এখনও ১১০ কিলোমিটার খালের পাড় কাচা। চট্টগ্রামের দু:খ খ্যাত এই জলাবদ্ধতা নিরসনে ১৯৮৮ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত তিনটি বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এ ছাড়া সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে প্রত্যেক বছরই এ খাতে অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয় এবং বর্ষার আগে খালের আবর্জনা অপসারন সহ জলাবদ্ধতা প্রতিরোধে নানাবিধ কার্যক্রম পরিচালিত হয়। কিন্তু এ পর্যন্ত কোন উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। জলাবদ্ধতার সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের। সংস্থাটি বিভিন্ন নানা নর্দমার মাটি অপসারন করলেও এ ক্ষেত্রে রয়েছে যথাযথ নজরদারীর অভাব। অনেক সময় দিনের পর দিন নালার অপসারনকৃত মাটি পাড়ে পড়ে থাকে দিনের পর দিন। এক পর্যায়ে আবারো নালায় দিয়ে পড়ে। এদিকে আবহায়া অধিদপ্তরের তথ্য মতে, একাধিক প্রাকৃতিক দুর্যোগের আশঙ্কা করা হচ্ছে চলতি এপ্রিল মাসে। এর মধ্যে অতিবৃষ্টির পাশাপাশি রয়েছে মৃদু থেকে তীব্র তাপপ্রবাহের শঙ্কা। আবার বঙ্গোপসাগরের নিন্মাঞ্চল থেকে হতে পারে ঘুর্নিঝড়। সম্ভাবনা রয়েছে বজ্রবৃষ্টির। সব মিলিয়ে মাসটিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাস হিসেবে আখ্যায়িত করছে আবহাওয়াবিদরা। ৯১ এর ২৯ এপ্রিলের ভয়াল ছবি এখনো উপকুলবর্তী মানুষের চোখে ভাসে। এসব সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি সামনে রেখে অবিলম্বে যদি নালা নর্দমার ময়লা অপসারন করা না হয় তবে গোটা চট্টগ্রাম নগরী কোমর পর্যন্ত পানিতে ডুবে যেতে পারে।
কারন হিসেবে বিশেষজ্ঞদের মতে, শহর রক্ষাবাঁধের করুন হাল, স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে চার-পাঁচ ফুট উচ্চতায় জোয়ারের পানি হলে চট্টগ্রাম নগরবাসী আক্রান্ত হতে পারে। এ ছাড়া অতিবৃষ্টি ও জোয়ারের কারনে সৃষ্ট জলোচ্ছাসও দীর্ঘমেয়াদী রুপ নিতে পারে। এ কারনে নালা নর্দমা ও খালের মাটি অপসারনের উদ্যোগকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে চসিককে। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞদের মতে,’চট্টগ্রাম বন্দর বাঁচাতে কর্নফুলী নদীর পাড়ের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ, পরিকল্পিত ড্রেজিং, শহর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ, বর্জ্য ফেলা বন্ধ ও মৌসুমী জোয়ারের পানি ঢোকা বন্ধ না করলে চট্টগ্রাম পরিনত হবে দেশের জলাবদ্ধ নগরী।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.