চাল নিয়ে চালবাজিতে কষ্টে আছে মানুষ

0

জুবায়ের সিদ্দিকী :: চট্টগ্রামে চালের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধিতে সাধারন মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। নগরীর পাইকারী বাজার চাক্তাই, পাহাড়তলী, খাতুনগঞ্জ ঘুরে দেখা গেছে, এক মাসের ব্যবধানে মোটা চালের দাম বেড়েছে কেজিতে তিন থেকে পাঁচ টাকা। চালের বস্তাপ্রতি ১০০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত দাম বেড়েছে। এ ছাড়া গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিতে বেড়েছে এক টাকা থেকে দুই টাকা।

তবে পাইকারী বাজারে চালের দাম স্থিতিশীল থাকার সম্ভাবনা থাকলেও খুচরা বাজারে দাম কমার সম্ভাবনা নেই বলে চাল ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন। নগরীর রেয়াজুদ্দিন বাজার, কাজির দেউরি বাজার, চকবাজার সহ বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা যায়, খুচরা বাজারে প্রতি কেজি স্বর্ণা সিদ্ধ চাল ৪২ টাকা, ভারতীয় বেতি ৪০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। মিনিকেট (আতপ) এক নম্বর ৪৮ টাকা, জিরাশাইল (নবান্ন) ৫২ টাকা. আতপ বেতি এক নম্বর ৪৮ টাকা, দেশি পাইজার ৪৭ টাকা, দিনাজপুরী পাইজার ৫০ টাকা, কাটারিভোগ ৬০ টাকা, চিনিগুড়া ৯৫ টাকা, ২৯ বেতি ৪২ টাকা, পাইজাম চিকন ৪৬ টাকা, বেতি আতপ চিকন ৪৪ টাকা, সিদ্ধ জিরাশাইল চিকন ৪৮ টাকা, সিদ্ধ মিনিকেট চিকন ৪৫ টাকা ও সিদ্ধ মোটা ৪০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

রেয়াজুদ্দিন বাজারের এক চাল ব্যবসায়ী বলেন,’ চালের বর্তমান যে দাম সেটা সরকার চাইলে কমাতে পারে। সিন্ডিকেট চালের দাম নিয়ন্ত্রন করে থাকে। এ সিন্ডিকেট ভেঙ্গে দিতে পারলে চালের দাম নিয়ন্ত্রনে থাকবে। জানা গেছে, সরকার ধান চাল সংগ্রহ কার্যক্রম শুরুর পরই চালের দাম হু হু করে বেড়ে যায়। গত জানুয়ারী মাসে আমন ধান গোলায় উঠার পরও চালের দাম বেড়েছে। গত সপ্তাহে আরেক ধাপ বেড়েছে। আড়তদার ও পাইকারী ব্যবসায়ীদের দাবী উত্তরবঙ্গের মিল মালিক ও ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কারসাজিতে চালের দাম দফায় দফায় বেড়ে চলেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশে চালের বাজার নিয়ন্ত্রন করে উত্তরবঙ্গের মিল ও ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। বোরো ও আমন মৌসুমে কৃষকদের কাছ থেকে কম দামে চাল কিনে গুদামজাত করেন তারা। বাজারে সঙ্কট সৃষ্টি করে বাজার অস্থির করে তোলেন তারা। নওগাঁ. দিনাজপুর, আশুগঞ্জ, ময়মনসিংহ, সান্তাহার (বগুড়া), রাজশাহী, কুষ্টিয়া সহ বিভিন্ন জেলায় তিন শতাধিক চাল মিল ব্যবসায়ী রয়েছে। এদের মধ্যে প্রায় ৩০ জন বড় মিল মালিক ও ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট ধান চালের বাজার নিয়ন্ত্রন করে।

চট্টগ্রামের বড় পাইকারী বাজার পাহাড়তলী ও চাক্তাই ব্যবসায়ীরা জানান, নওগাঁ, মহাদেবপুর, আশুগঞ্জ, দিনাজপুর, পাবনা, ঈশ্বরদীর মোকামগুলো থেকে বেশিরভাগ চাল আসে চট্টগ্রামে। আশুগঞ্জ থেকে বেতি, ইরি জাতের, দিনাজপুর থেকে মিনিকেট, পাইজাম, চিনিগুড়া, কারারিভোগ জাতের আতপ এবং নওগাঁ, পাবনা, ঈশ্বরদি থেকে সিদ্ধ জাতের চাল আসে এখানে। প্রতিদিন ৪৫০ থেকে ৫০০ মেট্রিকটন চাল চাক্তাইয়ের আড়তগুলোতে আসে। ৫০ কেজি বস্তায় ১৬-২৪ টাকা কমিশন পান আড়তদাররা।

আর পাহাড়তলী পাইকারী বাজারে আসে প্রতিদিন ৪০০ থেকে ৪৫০ মেট্রিক টন চাল। এদিকে চাক্তাই খাতুনগঞ্জ চালের বাজার থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, বেতি বিক্রি হচ্ছে বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) এক হাজার ৮৫০ টাকা, যা এক সপ্তাহ আগে ছিল এক হাজার ৭৫০টাকা। একমাস আগে এক হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি হয়েছিল ভারতীয় বেতি। মিনিকেট ২৮ এক সপ্তাহে আগে ১২০ টাকা বেড়ে বিক্রি হয় ২২ শ’ থেকে সাড়ে ২২’শ টাকায়। এক মান আগে এক হাজার ৪০০ টাকায় বিক্রি হওয়া বেতি ২৯ বিক্রি হচ্ছে দুই হাজার টাকায়।

পাহাড়তলী বাজারের একজন চাল ব্যবসায়ী জানান, গত দুই মাসে প্রতি বস্তায় দুই’শ থেকে তিন’শ টাকা পর্যন্ত দাম বেড়েছে। এ সপ্তাহে নতুন চাল বাজারে আসায় কিছুটা কমার সম্ভাবনা আছে। তবে পাইকারী বাজারে দাম কমার প্রভাব খুচরা বাজারে পড়েনি। চলতি মৌসুমে সরকার মোটা সিদ্ধ চাল ৩৪ টাকা করে কেনার যে ঘোষনা দিয়েছে, এতে করে আগামীতে খুচরা বাজারে চালের দাম কমার সম্ভাবনা নেই।

কারন এখন মোটা সিদ্ধ চালের বাজার প্রতি ৫০ কেজি বস্তা ১৮’শ থেকে ১৮’শ ৫০ টাকা। আর সরকার কিনছে ৫০ কেজি বস্তা ১৭’শ টাকা হিসেবে। এসব চাল খুচরা বাজারে গেলেও দাম কমার সম্ভাবনা থাকবে না। চট্টগ্রাম রাইস মিলি মালিক সমিতির সভাপতি বাবু শান্ত দাশগুপ্ত বলেন,’ গত ১০ দিনের ব্যবধানে চাল বস্তাপ্রতি ২০০ থেকে ২৫০ টাকা বেড়েছে। সরকার যদি চালের উপর অর্ধেক শুল্ক কমিয়ে দেয়, তাহলে চালের দাম বস্তাপ্রতি ২০০-২৫০ টাকা কমে যাবে। উল্লেখ্য চাল আমদানী নিরুৎসাহিত করতে আমদানী শুল্ক বাড়িয়েছে সরকার।

চাল আমদানীতে ২৫ শতাংশ কাস্টমস ডিউটি (শুল্ক) এবং ৩ শতাংশ রেগুলেটরি ডিউটি (আরডি) নির্ধারিত রয়েছে। ২৮ শতাংশ শুল্ক গুনতে হয় ব্যবসায়ীদের। এ অজুহাতে ব্যবসায়ীরা চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে চাল আমদানীকারকরা শুল্ক কমানোর দাবী করে আসছেন।

খাদ্য মন্ত্রনালয়ের তথ্য অনুযায়ী গত অর্থ বছরে (২০১৫-১৬) বেসরকারীভাবে ২৫৭ দশমিক ২৪ হাজার মেট্রিক টন চাল আমদানী করা হয়। অথচ চলতি অর্থবছরে ২০১৬-১৭ সাড়ে সাত মাসে ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত আমদানী হয়েছে মাত্র ৪১ দশমিক ১৩ হাজার মেট্রিক টন চাল। দশকের পর দশক ধরে খাদ্য ঘাটতির দেশ হিসেবে কলঙ্কতিলক ছিল বাংলাদেশের ললাটে।

গত ৭-৮ বছরে বিশ্ব দেখেছে এক নতুন বাংলাদেশ, যারা নিজেদের খাদ্য নিজেরা উৎপাদন করতে এবং কিছু পরিমান খাদ্য রপ্তানীর কথাও ভাবতে পারে। আমন ও বোরো মৌষুমে আবার বাম্পার ফলনের শিরোনাম এসেছে পত্রিকায়। রেকর্ড পরিমান ধান উৎপাদনের কারনে বিভিন্ন মৌসুমে কৃষকদের ন্যায্যমুল্য থেকে বঞ্চিত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু একই সঙ্গে লক্ষ্যনীয় ছিল যে, খাদ্যশস্যের বাজার কয়েক বছর ধরে কমবেশি স্থিতিশীল।

কিন্তু চলতি বছরে সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জের বিশার হাওরা অঞ্চলে প্রকৃতির রোষ ও মানবসৃষ্ট দুর্যোগ হানা দেওয়ার পর ফের উৎকন্ঠা চালের বাজার ফের অস্থির হয়ে উঠবে না তো? এরই মধ্যে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, হাওরে বন্যার অজুহাতে বাজারে চালের দাম বাড়াচ্ছে চাতালম মালিকরা। কিছুদিন আগে আমন ধানের মজুদ শেষ এই অজুহাতে বাড়ানো হয়েছিল এক দফা। সব মিলিয়ে এক মাসে কেজিপ্রতি ৫ থেকে ৬ টাকা বাড়ানো হয়েছে চালের দাম। বাজারে চাল নিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজির কারনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সমাজের নিম্ন আয়ের মানুষরা। সিন্ডিকেট রোধ করার দায়িত্ব সরকারের।

খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেছেন,’বছরে এখন ১৫ থেকে ২০ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত হয়। হাওরে বন্যার কারনে উৎপাদন এক মৌসুমে ছয় লাখ টন কম হলেও চালের বাজারে বিরুপ প্রভাব সৃস্টি হওয়ার কথা নয়’’। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এ ধরনের বিরুপ প্রভাব দৃশ্যমান এবং তার প্রতিরোধে সরকারের পদক্ষেপ নেই।

খাদ্যমন্ত্রী বলেছেন, কিছু অসাধু ব্যবসায়ী, মজুদদার ও অসাধু মিল মালিকরা প্যানিক সৃষ্টি করে চালের দাম বাড়ানোর চেষ্টা করছেন। তিনি নেপথ্যে কারসাজিতে কারা লিপ্ত তাদের চিহ্নিত করেছেন। তবে তাদের দমনের ক্ষমতা তো ক্রেতাদের হাতে নেই। সে কাজটি করতে হবে সরকারকে এবং খুব দ্রুদ সময়ে। সামনে রজমান মাস। নতুন বছরের বাজেটও আসছে। এ দুটি উপলক্ষকে কেন্দ্র করে প্রতিবছর চাল সহ নিত্য প্রয়োজনীয় পন্যের উপর চাপ পড়ে।

সরকার হাওর অঞ্চলে এক বছরের জন্য কৃষিঋন আদায় স্থগিত, ফসল ও মাছ চাষে স্বল্প সুদে ঋন প্রদান সহ কয়েকটি ভাল পদক্ষেপ নিয়েছে। চালের বাজার সহনীয় ও স্বাভাবিক রাখার জন্যও পদক্ষেপ নিতে হবে। অন্যথায় বাজার অস্থির হবে, যার প্রতিক্রিয়া শুধু অর্থনীতিতে নয় পড়বে রাজনীতিতেও।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.