চট্টগ্রামে টেন্ডার নিয়ে ছাত্রলীগের দ্বন্দ্ব : সংঘাতের শঙ্কা

0

জুবায়ের সিদ্দিকী :: ছাত্রলীগ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার অর্ন্তকোন্দল, অভ্যন্তরীন দ্বন্দ্ব, চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি ও অবৈধ অর্থের কারনে নিজেদের মধ্যে সংঘাত-সংঘর্ষ যেন পিছু ছাড়ছে না। কমিটি গঠনের দুই বছর পার না হতেই দুইবার স্থগিত করা হয়েছে সাংগঠনিক কার্যক্রম। এই দুই বছরের বিভিন্ন সময় নিজেদের মধ্যে ২০ বারের বেশি হামলা পাল্টা হামলা সহ সংঘর্ষে জড়িয়েছে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা। সর্বশেষ গত ৫ মে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ফের সংঘর্ষে জড়ায় দুই গ্রুপের সদস্যরা। ওই দিন রাতে ক্ষুদ্ধ হয়ে ছাত্রলীগের চবি শাখার সকল কার্যক্রম স্থগিত করেছে কেন্দ্রীয় সংসদ।

বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের বিভক্তিও মুলত চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের দুই নেতাকে কেন্দ্র করেই। এই দুই নেতার অনুসারী বর্তমান ও সাবেক এক ডজন নেতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি প্রকল্পের মোট ৫১ কোটি টাকার টেন্ডার হাতিয়ে নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। এই টেন্ডারকে কেন্দ্র করেই সাম্প্রতিক দ্বন্দ্ব, সংঘাত-সংঘর্ষের মত ঘটনা ঘটেছে। ছাত্রলীগের একাধিক সুত্র জানায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু হলের দ্বিতীয় পর্যায়, জীববিজ্ঞান অনুষদের ৪র্থ ও শেষ পর্যায় এবং বঙ্গবন্ধু হলের প্রভোষ্ট ও আবাসিক শিক্ষকদের কোয়ার্টার নির্মান প্রকল্পে ৫১ কোটি টাকা টেন্ডারের ভাগ ভাটোয়ারা নিয়ে দুই ভাগে বিভক্ত হয়েছেন নগর আওয়ামী লীগ সভাপতি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী ও সাধারন সম্পাদক ও সিটি মেয়র আ.জ.ম নাছির উদ্দিনের অনুসারীরা।

এর মধ্যে যেমন রয়েছে চবি শাখা ছাত্রলীগের বর্তমান নেতারা তেমনি আছেন সাবেক ছাত্রনেতারাও। টেন্ডার ভাগ ভাটোয়ারার সমঝোতা না হওয়ায় ছাত্রলীগের দ্বন্দ্ব আরও চরম আকার ধারন করেছে। অভিযোগ আছে, এর মধ্যে একটি অংশে রয়েছেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সদন্য ও চবি ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ন সম্পাদক সুমন মামুন, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপ-সম্পাদকীয় কমিটির সহ-সম্পাদক ও চবি ছাত্রলীগের সাবেক সাধারন সম্পাদক নাসির হায়দার বাবুল, সদ্য স্থগিত কমিটির সাধারন সম্পাদক ফজলে রাব্বী সুজন এবং ছাত্রলীগের সদস্য রাকিব হোসাইন। তারা সবাই সাবেক মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারী।

এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতা নাসির হায়দার বাবুল বলেন,’ছাত্রলীগের কমিটি নিয়ে সমস্যা হলে সিনিয়র হিসেবে মাঝে মাঝে তাদের সঙ্গে বসতে হয়। এখানে অনেকে ঠিকাদারী প্রতিষ্টানের সঙ্গে জড়িত থাকায় টেন্ডার নিয়ে তুলতে চায়। আর আমি যেহেতু ঠিকাদারী প্রতিষ্টানের সঙ্গে জড়িত নেই তাই আমার সংশ্লিষ্টতার প্রশ্নই আসে না’। একই প্রসঙ্গে সাবেক যুগ্ন সাধারন সম্পাদক সুমন মামুন বলেন,’ছাত্র রাজনীতিতে থাকা অবস্থায় অর্থনৈতিক লেনদেনের সঙ্গে জড়িত না থাকাই শ্রেয়। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা যখন ছাত্রনেতাদের ব্যবহার করতে চায় তখনও ঝামেলা সৃষ্টি হয়।

আর ছাত্রলীগ নিয়ে সাবেক নেতাদের মাথা ঘামানোটাও সমস্যা। আমি সম্পুর্ন নিয়মতান্ত্রিক ও বৈধ উপায়ে ঠিকাদারী ব্যবসা করতেই পারি। তাই বলে এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত না। আর এবারের দরপত্রটি সম্পুর্ন ই-টেন্ডারিং এর মাধ্যমে হচ্ছে। এতে ভাগাভাগির কোন সুযোগ নেই। সদ্য স্থগিত কমিটির সাধারন সম্পাদক ফজলে রাব্বী সুজন বলেন,’ শাটল ট্রেনে দুই বন্ধুর মারামারিতে জোর করে রঙ মাখিয়ে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে সংগঠনের সম্মানহানীর জন্য।

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সকল সরকারী প্রতিষ্টানে ই-টেন্ডাংি প্রক্রিয়া চালু হয়েছে। এখানে জড়িত হওয়ার কোন সুযোগ নেই। আমার বা ছাত্রলীগের সম্পৃক্তার বিষয়টি সম্পুর্ন ভিত্তিহীন ও অবান্তর। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সদস্য রাকিব হোসাইন বলেন,’টেন্ডার প্রক্রিয়া ইজিপিতে হওয়ায় কাউকে পাইয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। যারা এসব বলে তারা না জেনেই বলে’। এদিকে সাবেক সিটি মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারীদের মধ্যে সমঝোতা হলেও ৫১ কোটি টাকার টেন্ডারকে কেন্দ্র করে বর্তমান সিটি মেয়র আ.জ.ম নাছিরের অনুসারীদের দুটি পক্ষ সৃষ্টি হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এর মধ্যে এক পক্ষে রয়েছেন চবি ছাত্রলীগের সাবেক সাধারন সম্পাদক এম এ খালেদ চৌধুরী, সাবেক সহ-সভাপতি জি.আর নবীন, সাবেক যুগ্ন সাধারন সম্পাদক কাজী তানজিম হোসেন, সাবেক সহ-সভাপতি অভ্র ঘোষ।

একই নেতার অনুসারী আরেক পক্ষে রয়েছেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সম্পাদক সাইফুল আলম লিমন, সদ্য স্থগিত কমিটির সভাপতি আলমগীর টিপু, সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আবুল মনসুর জামশেদ, সাবেক যুগ্ন সাধারন সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় সংসদের সদস্য নুর মোহাম্মদ নাজমুল। মুলত এই দুটি পক্ষেই চলছে বর্তমান দ্বন্দ্ব। এ ছাড়াও দুই নেতার অনুসারী তিনটি পক্ষকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন বর্তমান ও সাবেক এক ডজন নেতা।

এ নিয়ে তিন পক্ষের মধ্যে নগরীর জিইসি এলাকায় একটি কোচিং সেন্টারে তিন দফা বৈঠকও হয়েছে। কিন্তু তাতেও সমাধান হয়নি বলে ছাত্রলীগ সুত্রে জানা গেছে। তবে টেন্ডারের বিষয়টি স্বীকার করে ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সম্পাদক সাইফুল আলম লিমন বলেছেন,’আমার নিজের ঠিকাদারী প্রতিষ্টান রয়েছে। আমি আগেও ইজিপিতে এই টেন্ডারটি ড্রপ করেছিলাম। আমিই পেতাম কিন্তু প্রক্রিয়াগত ভুল থাকায় আমি টেন্ডার পাইনি। টেন্ডারটি আবারও ড্রপ করব।

ক্যাম্পাসের পরিবেশটা তো আমার জানা, ছোট ভাইরা আছে, তাদের বলব। তারা যদি পারে সহযোগিতা করবে’। তবে টেন্ডারের সঙ্গে ছাত্রলীগের জড়িত থাকার অভিযোগটি ভিত্তিহীন দাবী করে স্থগিত হওয়া কমিটির সভাপতি আলমগীর টিপু বলেন’ কমিটির গুটিকয়েক নেতাকর্মীর কারনে এসব সমস্যা হচ্ছে, যারা চায় কমিটি না থাকুক। ই-টেন্ডারের মাধ্যমে আহবান করা হলে যে কোন স্থান থেকেই ড্রপ করা যেতে পারে। ছাত্রলীগকে হেয় করার উদ্দেশ্যে এসব কথা রটানো হচ্ছে।

সংশ্লিষ্টদের সাথে আলাপ করে জানা যায়, সাবেক সিটি মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারীদের মধ্যে সমঝোতা হলেও টেন্ডারকে কেন্দ্র করে বর্তমান সিটি মেয়র আ.জ.ম নাছিরের অনুসারী দুই পক্ষের মধ্যে চলছে দ্বন্দ্ব। টেন্ডার হাতিয়ে নিতে রাজনীতিতে দীর্ঘদিন অনুপস্থিত শাখা ছাত্রলীগের সাবেক নেতাদের নিজেদের গ্রুপে বাগিয়ে নিয়ে দুটি পক্ষই ভারী করছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। একাধিক ছাত্রনেতা জানায়, গুটি কয়েক নেতা তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিল করে পকেট ভারী করার জন্য অনৈতিক কাজে জড়িয়ে সংগঠনকে কলুষিত করছে। তাদের কারনে পুরো কমিটিই শাস্তি ভোগ করছে।

টেন্ডারের ভাগ ভাটোয়ারা তারা পায় আর ব্যবহার করে জুনিয়র নেতাকর্মীদের। ফলে মামলা, পুলিশি হয়রানী সহ নোংরা গ্রুপিং রাজনীতির শিকার হয় জুনিয়ররা। আর তারা ঠিকই তাদের স্বার্থ হাসিল করে নেয়।

কয়েকজন সাবেক ছাত্রনেতার সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগকে ব্যবহার করে একাধিক নেতা কোটিপতি হলেও পরবর্তীতে নেতাকর্মীদের খবর রাখে না। বর্তমানে ৫১ কোটি টাকার টেন্ডার ভাগাভাগি নিয়ে যে মেরুকরন, একই গ্রুপের উপ-গ্রুপ সৃষ্টি ও অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়েছে তা রক্তক্ষয়ি সংঘাতে রুপ নিতে পারে যে কোন সময়।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.