মিরসরাইয়ে পানিবন্দী লক্ষাধিক মানুষ : বজ্রপাতে নিহত ১
এম আনোয়ার হোসেন, মিরসরাই : মিরসরাইয়ে ভারী বর্ষণও পাহাড়ি ঢলের পানিতে তলিয়ে গেছে প্রায় তিন হাজার বসতঘর। পানিবন্দী হয়ে আছে উপজেলার লক্ষাধিক মানুষ। বজ্রপাতে নৈশ প্রহরী আবুল বশর (৬০) নামে এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন । পানিতে তলিয়ে গেছে শত শত একর আউশ রোপা, ভেসে গেছে প্রায় ৬ শতাধিক পুকুরের মাছ। গ্রামীণ সড়কগুলোর উপর দিয়ে বইছে পানির স্রোতে। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। এতে দুর্ভোগে পড়েছে স্কুল কলেজের শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ীসহ এলাকার মানুষ। মিরসরাই ডিগ্রি কলেজ, নিজামপুর বিশ^বিদ্যালয় কলেজ, বড়তাকিয়া জাহেদিয়া দাখিল মাদ্রাসাসহ অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পানি ঢুকে শিক্ষা কার্য্যক্রম ব্যাহত হয়ে পড়ে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্রের তেমন কোন ক্ষতি না হলেও আসবাবপত্র পানিতে ডুবে যায়।
উপজেলার খইয়াছড়া ইউনিয়নের ফেনাপুনী, গোভনীয়া, আমবাড়িয়া গ্রামের প্রায় ৫ শ পরিবারের বসতঘর হাঁটু পানিতে ডুবে আছে। ছোট ছোট বাচ্চাদের রাখা হয়েছে খাটের ওপর। বাহিরে বের হওয়ার কোন সুযোগ নেই। বাড়ির উঠান ডুবে আছে কোমর পানিতে। পথঘাট, পুকুর তলিয়ে গেছে পানির নিচে।
স্থানীয় ইব্রাহীম, সুফিয়া বেগম, আমিন মিয়া জানান, সোমবার সারাদিন বৃষ্টি হলেও তেমন পানি ছিল না। কিন্তু সন্ধ্যা থেকে প্রচুর বৃষ্টিও পাহাড়ি পানি নেমে আসায় বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, পুকুর, জমির ফসল পানিতে তলিয়ে যায়। এলাকার প্রায় ৫ শত পরিবারের লোকজন ভোররাতে রান্নাবান্না করতে না পেরে শুধু পানি খেয়ে রোজা রেখেছে। কিন্তু ইফতার কিভাবে করবে, বাচ্চাদের কিভাবে খাওয়াবে তা নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেছে। ওয়াহেদপুর ইউনিয়নের মসজিদিয়া, নয়দুয়ার, বুজর্গনগর গ্রামের মানুষ পানিবন্দি হয়ে আছে।
খৈয়াছড়ার ফেনাফুনী এলাকার বাসিন্দা ফয়েজ আহম্মদও গোভনীয়া এলাকার বাসিন্দা মোশাররফ হোসেন জানান, দীর্ঘ প্রায় ৮ বছর যাবত ভারী বর্ষণ হলে পাহাড়ি ঢলে এসব এলাকা তলিয়ে যায়। পানি নিষ্কাশনের যথোপযুক্ত ব্যবস্থা না থাকার ফলে এমন দশা বিরাজ করে বলে জানান তারা।
খৈয়াছড়া ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক ইউপি সদস্য মোহাম্মদ শাহজাহান জানান, ইউনিয়নের ফেনাফুনী ও পশ্চিম গোভনীয়া এলাকার প্রায় ২ শত পরিবার পানিবন্দী। এসব এলাকার বসতঘরে পানি প্রবেশ করে রান্নাবান্না বন্ধ, গ্রামীণ সড়কে বুক পরিমাণ পানি উঠে দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে জনজীবন।
স্থানীয় বাসিন্দা খাজা মঈন উদ্দিন অভিযোগ করেন, কামারিয়া খাল, মঘাদিয়া-সাহেরখালী খালের ওপর বিভিন্ন স্থাপনা নির্মান করে খাল দখলের কারণে খৈইয়াছড়া, মঘাদিয়া, মায়ানী ইউনিয়নের মানুষ বৃষ্টি হলে দুর্ভোগে পড়ে।
এদিকে মঙ্গলবার দুপুরে মিরসরাই উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যানও চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামীলীগের সদস্য আলহাজ¦ মো. গিয়াস উদ্দিন পানিবন্দী এলাকা খৈয়াছড়ার ফেনাফুনী ও গোভনীয়া এলাকা পরিদর্শন করেন। এসময় তিনি বাড়ি বাড়ি গিয়ে পানিবন্দী মানুষের খোঁজখবর নেন এবং আর্থিক সহায়তাও প্রদান করেন।
ওয়াহেদপুর ইউনিয়নরে চেয়ারম্যান ফজলুল কবির ফিরোজ জানান, ওয়াহেদপুর ইউনিয়নের মাইঝগাঁও, ছোট কমলদহ, উত্তর ওয়াহেদপুর, মধ্যম ওয়াহেদপুর, দক্ষিন ওয়াহেদপুর, সাতবাড়িয়া, জাফরাবাদ, গাছবাড়িয়া, পদুয়া এলাকায় প্রায় ১ হাজার পরিবারের বসতঘর পানিতে তলিয়ে আছে। ছোট কমলদহ বাজারসহ গ্রামীণ সড়কগুলোর ওপর দিয়ে পানির স্রোত বইছে। স্রোতে ভেঙ্গে গেছে নিজামপুর রেলষ্টেশন সড়ক মিয়াচাঁন সড়কসহ কয়েকটি সড়ক। ভেসে গেছে বেশকিছু পুকুরের মাছ। ছোট কমলদহ তহসিল অফিসে পানি ঢুকে নষ্ট হয়ে গেছে মানুষ গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র। জোরারগঞ্জ ইউনিয়নের খিরমুরারী এলাকায় বসতঘরে পানি ঢুকে ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে হয়েছে প্রায় শতাধিক পরিবার। পানির কারণে ভেঙ্গে পড়েছে কয়েকটি মাটির তৈরি ঘর।
উপজেলার ওচমানপুর ইউনিয়নের মুহুরী প্রজেক্ট এলাকার বাসিন্দা ইউসুফ খাঁন জানান, বাঁশখালী গ্রামের মানুষ রান্নাবান্না করতে না পারায় শুকনো খাবার খেয়ে দিন কাটাচ্ছেন। বন্ধ রয়েছে শিক্ষার্থীদের স্কুলে যাওয়া। সামান্য বৃষ্টিতে পুরো গ্রাম তলিয়ে যায় পানির নিচে। স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মাছ চাষের দোহাই দিয়ে পানি নিষ্কাশনের খালও সরকারি কালভার্ট অবৈধভাবে বন্ধ করে দেওয়ায় অনেকদিন ধরে পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন প্রায় ২ শতাধিক পরিবারের প্রায় ৬ শতাধিক মানুষ। মুহুরীপ্রজেক্ট বাজারের পশ্চিম পার্শ্বের এলাকাটিতে জমে আছে কোমর সমান পানি। এপার থেকে ওপারে যেতে দুর্গন্ধযুক্ত পানি পার হতে হচ্ছে এলাকাবাসীদের। শুধু সড়কেই নয় ময়লা দূষিত পানি ইতোমধ্যে ঘরে প্রবেশ করে জনজীবন বিষন্ন করে তুলেছে।
ছড়িয়ে পড়ছে পানিবাহিত বিভিন্ন রোগবলাই। বিশেষ করে দুর্ভোগে পড়েছে শিশু, নারী ও বয়স্করা: খাবার রান্নায় ব্যবহৃত হচ্ছে দূষিত পানি। এছাড়া টিউবওয়েল পানির নিচে থাকায় বিশুদ্ধ পানির অভাব দেখা দিয়েছে।
মৎস্যচাষী কামরুল হোসেন জানান, টানা বর্ষন ও পাহাড়ি ঢলে ওই এলাকার অনেকে প্রকল্প থেকে মাছ ভেসে গেছে। এতে কয়েক লক্ষাধিক টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
করেরহাট ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এনায়েত হোসেন নয়ন জানান, একটি খালের প্রায় ১ হাজার ফুট বাঁধ ভেঙ্গে সরকারতালুক গ্রামের প্রায় শতাধিক পরিবারের বসতঘর হাঁটু পরিমাণ পানিতে তলিয়ে যায়। পাহাড়ি ঢলের কারণে ক্ষতিগ্রস্থ হয় এলাকার কাঁচা পাকা সড়ক। এছাড়া করেরহাট, জোরারগঞ্জ, হিঙ্গুলী, দুর্গাপুর, সাহেরখালী, কাটাছড়া, মিরসরাই সদর ইউনিয়নের বেশির ভাগ এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে।
বড়তাকিয়া জাহেদিয়া দাখিল মাদ্রাসার সুপার আলা উদ্দিন জানান, পাহাড়ি ঢলে মাদ্রাসার বিভিন্ন কক্ষে পানি ঢুকে পড়ার কারণে মাদ্রাসার শিক্ষা কার্য্যক্রম বন্ধ ছিল। তবে পানি ঢুকে পড়ায় আসবাবপত্রের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশংকা করা হচ্ছে। পানি নিষ্কাশনের পথগুলো বন্ধ করে বসতবাড়ি নির্মাণ করার ফলে এই এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা দিচ্ছে।
মিরসরাই উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা বুলবুল আহম্মদ জানান, মিরসরাইয়ে চলতি মৌসুমে প্রায় ৫ হাজার হেক্টর জমিতে আউশ রোপা লাগানো হয়েছে। সোমবারের বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে প্রায় ৪ হাজার হেক্টর রোপা পানিতে তলিয়ে গেছে। এরআগেও ওই রোপাগুলো পানিতে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এবার পানি দ্রুত নেমে না গেলে কৃষক ব্যাপক লোকসানে পড়বে।
মিরসরাই উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মাহমুদুল হক জানান, অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের কারণে হিংগুলী, জোরারগঞ্জ, দুর্গাপুর, মিরসরাই সদর, খইয়াছড়া, ওয়াহেদপুর এলাকার প্রায় ছয় শতাধিক পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। এতে প্রায় ৩ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
মিরসরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জিয়া আহমেদ সুমন জানান, অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে কারণে বিভিন্ন এলাকায় মানুষ পানিবন্দি হয়ে আছে। চেয়ারম্যানদের মাধ্যমে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। যেখানে প্রয়োজন সেখানে শুকনো খাবার দেওয়ার জন্য চেয়ারম্যানদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
বজ্রপাতে নিহত : মিরসরাইয়ে বজ্রপাতে আবুল বশর (৬০) নামে এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। তিনি বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড নির্মিত মুহুরী প্রজেক্টের স্লুইচ গেইটের নৈশ প্রহরী হিসেবে কাজ করতেন। আবুল বশর সোনাগাজী উপজেলার সোনাপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা। মঙ্গলবার (১৩ জুন) সকাল সাড়ে ৭ টায় দায়িত্ব পালন শেষে বাঁধের উপর নির্মিত বিশ্রামাগারে ঘুমানোর সময় তিনি বজ্রপাতে আক্রান্ত হন।
স্থানীয় মৎস্য চাষী আনোয়ার হোসেন বলেন, প্রতিদিনের ন্যায় আবুল বশর রাতে স্লুুইচ গেইট পাহারা শেষে বাঁধের পাশে নির্মিত ঘরে ঘুমায়। এসময় ভোরে হওয়া বজ্রপাতে তিনি আক্রান্ত হয়ে ঘটনাস্থলে মৃত্যুবরণ করেন। আবুল বশর ৪ মাস পূর্বে নৈশপ্রহরীর দায়িত্বে যোগ দেন।
স্থানীয় ওচমানপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মফিজুল হক এই বিষয়ে তিনি অবগত নন বলে জানান।