চট্টগ্রামবাসীর জোয়ার ভাটার জীবন

0

জুবায়ের সিদ্দিকী- 

চট্টগ্রামে চোখের সামনে ভেসে গেল আলনায় রক্ষিত কাপড়, জুতা, সেন্ডেল, ম্যাগাজিন, বই, পত্রিকা, রান্নাঘরের পেয়াঁজ, আলু, তরিতরকারী। পারটেক্স এর তৈরী ড্রেসিং টেবিল, আলমারী, সবকিছু যেন পানিতে ডুবে গেল। ঘরের ভেতর ফ্রিজগুলোও পানিতে ডুবে গেছে। এভাবেই আমার আগ্রাবাদ বেপারী পাড়ায় পৈত্রিক ভিটেতে প্রথম জোয়ারের পানির মুখোমুখি হলাম ২০০৭ সালে। আমার চাকুরী জীবনের কষ্টার্জিত অর্থে তিলে তিলে গড়ে তোলা সংসারের যাবতীয় আসবাবপত্র চোখের সামনে নদীর জোয়ারের পানিতে ডুবে যায়। আগ্রাবাদের বেপারীপাড়ায় বিগত ৫০ বছরে এভাবে কোনদিন জলাবদ্ধতা হয়নি।

২০০৭ সাল থেকে ২০১৬ পর্যন্ত ৯ বছর নিজের বাড়িতে কখনো কোমর সমান, কখনো বা হাটু পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ এলাকার সিডিএ, বেপারী পাড়া, হালিশহর, ছোটপুল, এক্সেস রোড়, মুহুরী পাড়া, বিল্লাপাড়া, বলিরপাড়া, শান্তিবাগ, হালিশহর হাউজিং এষ্টেটের কিছু অংশ যখন সকাল বিকাল পানিতে ডুবে থাকতো তখন বন্দর কর্তৃপক্ষ দুই বছর আগে বন্দর রিপাবলিক ক্লাবের পাশে মহেশখালে একটি অস্থায়ী বাঁধ নির্মান করেছিলেন। এটাও এক ধরনের স্যুইচ গেটের মত তৈরি করা হয়। বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজেদের অর্থে এটি নির্মান করেছিলেন। বাঁধ নির্মানের পর ঘুর্নিঝড় রোহানুর আমাদের ২৭নং ওয়ার্ডে আর জোয়ারের পানি আসেনি। কিন্তু ৩৭ ও ৩৮ নং ওয়ার্ড জলমগ্ন হয়ে গেল।

এতে করে সে সব এলাকার মানুষ বিক্ষুদ্ধ হয়ে বাঁধ ভাঙ্গার চেষ্টা করে ব্যর্থ হল। এর পর এই বাঁধের কার্যক্রমের অর্ন্তভুক্ত থাকা জোয়ারের পানি ঠেকাতে প্রতিবন্ধকতাগুলো নিস্ক্রিয় করে রাখা হল। প্রবেশ করতে লাগলো জোয়ারের পানি ও সাথে যখন বৃষ্টি যোগ হয় তখন এই পানি সময়মত নামতে না পারায় মানুষ পানি বন্দী হয়ে পড়ে ৪-৫ দিন। যে কারনে এবারের পবিত্র রমজানে পর পর ২ বার মানুষ পানিবন্দী থাকার পর বাঁধটি অপসারন করা হয়। এখন প্রতিদিন সকাল বিকাল ২ বার জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হচ্ছে জনপদ ও লোকালয়। ২ বছর এভাবে প্রতিদিন না আসা পানি এখন বেড়েছে বহুগুন।

আগ্রাবাদ এক্সেস রোড়, হালিশহর, সিডিএ আবাসিক এলাকা, বেপারী পাড়া, খাতুনগঞ্জ, বাকলিয়া, পাথরঘাটা সহ নগরীর এক তৃতীয়াংশ প্রতিদিন জলমগ্ন হচ্ছে। মানুষ পানিবন্দী জীবন অতিবাহিত করছে। ২০০৭ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত জোয়ারের পানিতে সংসারের আসবাবপত্র ও দুর্ভোগ দুর্গতির কথা চিন্তা করে পরিবার নিয়ে গত মার্চে নিজের ভিটা ছেড়ে সিডিএ আবাসিক এলাকায় ভাড়া বাসায় চলে এলাম। এখন হাটু পানি থেকে কোমর পানিতে এলাম। তবে ছয় তলায় অবস্থান করায় ঘরে পানি প্রবেশ করতে না পারলেও রাস্তাগুলো থাকে সকাল বিকাল হাটু থেকে কোমর পানিতে প্লাবিত।

চট্টগ্রাম মহানগরীর মুরাদপুর, বহর্দ্দারহাট, বাকলিয়া, খাতুনগঞ্জ, চাক্তাই, আছদগঞ্জ, হালিশহর, আগ্রাবাদ সর্বত্র এখন দিনে দুইবার জোয়ারের পানি প্রবেশ করছে। অতীতে পানি ২-৩ ঘন্টার পর নেমে যেত। এখন পানি নামতে সময় লাগে ৭-৮ ঘন্টা। ঈদের দিন দুপুর ১টায় জোয়ারের পানি আসে সিডিএ আবাসিক এলাকায়। সে পানি নামে রাত ৯টার পর। এ এক অমানবিক জীবন। কোন মানুষ গুরুতর অসুস্থ হলে এমুলেন্স আসা দুরে থাক, ডাক্তারের কাছেও নেওয়া যাবে না। মৃত মানুষকে দাফন কাপনের ব্যবস্থাও করা যায় না। জরুরী কাজে ঘরের বাইরে যাওয়ার উপায় নেই। ২০ টাকার রিক্সা ভাড়া জোয়ারের সময় হয় ১০০ টাকা। এর পর রিক্সা সংকট তো আছেই। রিক্সা ছাড়া জোয়ারের সময় কোন যানবাহন চলাচল করতে পারে না। মানুষের দুর্ভোগ ও দুর্গতি এই আগ্রাবাদ হালিশহর এলাকায় না আসলে কেউ অনুধাবন করতে পারবে না।

আগ্রাবাদ এক্সেস রোড় ও হালিশহর, সিডিএর, বেপারী পাড়া, মুহুরী পাড়া, বিল্লাপাড়া, গোসাইলডাঙ্গা সহ বিভিন্ন জনপদের মানুষের কোন ব্যবসা বানিজ্য চলছে না। থমকে পড়েছে মানুষের জীবনযাত্রা। সিডিএ আবাসিক এলাকা একটি অভিজাত এলাকা। এখানে বসবাসকারীদের অনেকের রয়েছে প্রাইভেট কার, মাইক্রো ও জীপ। জোয়ার ভাটার এই খেলায় এই যানবাহনগুলো অলস পড়ে থাকে পার্কিং স্পেসে। আমাদের বিল্ডিং এর পার্কিং স্পেসে পড়ে আছে ১২-১৩ টি গাড়ী। এই গাড়িগুলো সবসময় দেখা যায় আমার মত বন্দী হয়ে আছে ছাদের নিচে। রাজপথে কেউ ছুটতে পারে না। সিডিএর ২৮ নং রোড়ে আমি যে এ্যাপার্টমেন্টে বসবাস করছি সেখানে ২০টি ফ্ল্যাট। এভাবে সুন্দর সুন্দর এ্যাপার্টমেন্টগুলো যেন জোয়ারভাটার নিরব সাক্ষী হয়ে আছে প্রতিদিন।

প্রতিটি ফ্লোরে ৪টি ফ্ল্যাট। কেউ আমার মত ভাড়াটিয়া। অনেকে এক বা একাধিক ফ্ল্যাট ক্রয় করে সুন্দর নান্দনিক ইন্টেরিয়র ডেকোরেশন করে ঘর সাজিয়েছেন। ছয়তলায় আমার পাশেই ফ্ল্যাট ক্রয় করে অত্যাধুনিক রুচি সম্মত ডেকোরেশন করে বসবাস করেন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও শিপিং এজেন্ট শ্রদ্ধাভাজন গিয়াস উদ্দিন ভাই। আগ্রাবাদের অরুপ ভবনে উনার অফিস। অত্যন্ত সদালাপী, উদার, আন্তরিক এই মানুষটির কোন অহংকার নেই। আমি মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। একজন ছোটখাটো গনমাধ্যম কর্মী। কিন্তু না, তিনি আমাকে এবং আমার পরিবারকে যেন মায়া মমতার বন্ধনে আবদ্ধ করেছেন। আগ্রাবাদ বেপারী পাড়া, ছোটপুল ও সিডিএ আবাসিক এলাকার অনেক মানুষ নিজের বাড়িঘর ছেড়ে অন্য এলাকায় চলে যাচ্ছেন শুধু পানির কারনে।

পানিবন্ধীর এই জীবন থেকে পরিত্রান পাওয়ার উদ্দেশ্যে। আমার মনে হয় চট্টগ্রাম শহরটা একটা বড় ডাষ্টবিন। এখানে আবর্জনার ভাগাড়, জলাবদ্ধতা, জোয়ারের পানি, ভাঙ্গা সড়ক, যানজট প্রতিদিনের স্বাভাবিক চিত্র। প্রায় তিন যুগেরও বেশি সময় ধরে সংবাদকর্মী হিসাবে চট্টগ্রামে আমার কর্মজীবন। সরকার আসে যায়, মেয়র, মন্ত্রী, এমপিরা যখন ক্ষমতায় থাকেন তখন কথা বলেন একরকম। ক্ষমতার বাইরে গেলে কথা বলেন অন্যরকম। সাংবাদিকতা জীবনে অনেক এমপি-মন্ত্রীর সান্নিধ্যে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। এদের ফাঁকাফাঁকি ও খাঁজুরা আলাপ বাস্তবতার সাথে কখনো এক হয় না। বর্তমান সরকারের আমলে মহানগরীতে শত কোটি টাকা খরচ করে ফ্লাইভার তৈরী হচ্ছে। অথচ ফ্লাইওভারের নিচে যানবাহনের পরিবর্তে নৌকা চলে এক ঘন্টার বৃষ্টিতে।

এই এমপি-মন্ত্রীরা কিভাবে নির্বাচিত হয়েছেন জনগন তা জানেন। মানুষ একবার ক্ষেপে উঠলে গনেশ উল্টে যেতে সময় লাগবে না। যারা আজ সরকারী দল করে আখের গুছাতে ব্যস্ত জনগনকে দুর্ভোগ দুর্গতিতে ফেলে তাদের মনে রাখা উচিত, ক্ষমতা ও কারাগার যেমন কাছাকাছি তেমনি ক্ষমতার পালাবদল হলে জনগনও তাদের ছেড়ে কথা বলবে না। মানুষের পিঠ যখন দেওয়ালে ঠেকে যায় তখন মানুষ এই সব রাজনীতি ব্যবসায়ীদের ঘৃনার চোখে দেখে।

এদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও ভালবাসা অবশিষ্ট থাকে না। চট্টগ্রামবাসীর সামনে মুলা ঝুলানোর মত ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে চাক্তাই ও মহেশখালের মুখে স্যুইচ গেইট নির্মানের প্রতিশ্রুতি। এই প্রতিশ্রুতি কবে বাস্তবায়ন হবে, জনগন তা জানেন না। আল্লাহ তাদের হেদায়েত দান করুন। আমার মত নালায়েক নাখান্দা লাখ লাখ অসহায় মানুষ পানিবন্দী জীবন থেকে মুক্তিপাক এই ফরিয়াদ করি আল্লাহর কাছে। জোয়ার ভাটার সাথে জীবন এখন দুর্বিসহ, অমানবিক। যা কোন সভ্য সমাজে বা দেশে কল্যানও করা যায় না। আমরা যেন এক মঘের মুল্লুকে বসবাস করছি।

এ বিভাগের আরও খবর

আপনার মতামত লিখুন :

Your email address will not be published.